কয়েকদিন থেকে আমার স্ত্রীর আচরণ বেশ রহস্যজনক মনে হয়েছে।কথা বার্তা চাল চলনে বেশ পরিবর্তন।বিশ বছরের সংসার জীবনে এই ধরনের আচরণ আগে কখনো দেখি নি।সব সময় কি যেন চিন্তা করে।আমার অগোচরে ও রাতে বারান্দায় গিয়ে কার সাথে যেন ফিসফিস করে কথা বলে।জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলে না। কয়েকদিন আগে আমাকে বলে প্রতিদিন ওকে ১০০০ টাকা করে হাত খরচ দিতে হবে। আমি বললাম প্রতিদিন কেন।বললো আমার অনেক খরচ, তাই লাগবে।বললাম তোমার যা কিছু লাগে সব তো আমি নিজে তোমাকে মার্কেটে নিয়ে কিনে দিই। ছেলেদের সব কিছু আমি নিজে কিনে আনি।তাহলে প্রতিদিন ১০০০ টাকার কি কাজ? স্ত্রী বললো আমার এককথা প্রত্যেক দিন লাগবে।ভাবলাম কি বিপদে পড়লাম! প্রতিদিন ১০০০ টাকা করে দিতে হবে।বললাম কিছু কম হলে হয় না। বললো একটাকা কম হলেও হবে না।বললাম এই করোনার সময়ে ব্যবসার অবস্থা ভাল না, কিভাবে দিবো?বললো আমি এতো কিছু বুঝি না দিতে হবে।মনে মনে বিধাতাকে ডাকছি, তিনি যদি এই বিপদ থেকে রক্ষা করেন। বললাম আচ্ছা দেখা যাবে।ও বললো কাল থেকে দিতে হবে, না হয় আমি নিজে মানি ব্যাগ থেকে নিয়ে নিবো। যাক সকালে ঘুম উঠে তার হাতে ১০০০ টাকা দিয়ে অফিসে রওয়ানা হলাম।ভাবলাম হয়ত সংসারের কোন জিনিস কিনবে।কারণ জামাকাপড় ও সংসারের নিত্যনতুন জিনিসপত্র কিনার প্রতি তার ঝোঁক রয়েছে।বিকালে বাসায় এসে বললাম টাকা আছে না খরচ করে ফেলেছ। বললো তোমার কি দরকার। আমি টাকা দিয়ে যা ইচ্ছে তা করবো।চিন্তা করলাম, বউ আমার এমনিতেই হার্টের রুগি। বেশী চেঁচামেচি করলে উত্তেজিত হয়ে হয়ত হার্টে কোন ক্ষতি হতে পারে।তাই ধীরে চল নীতিতে আগানোর পরিকল্পনা নিলাম।এভাবে প্রায় এক সপ্তাহ চলার পর একদিন ও কাউকে কিছু না বলে একা বের হলো।একা পায়ে হেঁটে গেইট অতিক্রম করে ,নিজে একটা অটোরিকশা ডেকে কোথায় যেন চলে গেল।ও সাধারণত গাড়ী ছাড়া বের হতো না। কখনো গাড়ী না থাকলে দারোয়ানকে দিয়ে অটোরিকশা আনিয়ে বের হতো।এই যে বের হলো, তা আমি পরে দারোয়ানের কাছে শুনেছি। যখন সে বের হয়েছে তখন আমি ছিলাম অফিসে, ছেলেরা ছিলো স্কুল কলেজে। বাসায় কাজের মেয়ে, নীচে দারোয়ান ছাড়া আর কেউ ছিলো না। অর্থাৎ সে নিজেকে পরিবারের সবার কাছ থেকে লুকিয়ে বের হয়ে প্রায় এক ঘন্টা পর আবার চলে আসলো।এসে দারোয়ানকে বললো, কাউকে কিছু না বলার জন্য।এভাবে আরো কিছুদিন চললো।প্রায় মাস চারেক চলার পর বিষয়টি আমার কাছে ধরা পড়ে।একদিন আমি হঠাৎ দুপুর ১২ টার দিকে বাসায় এসেছিলাম একটা প্রয়োজনীয় ডক্যুমেন্ট নেওয়ার জন্য।এসে দেখি বাসায় কাজের মেয়ে ও নীচে দারোয়ান ছাড়া কেউ নেই।দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম,তোমার ম্যাডাম কোথায়? সে বললো জানে না। বললাম আর কখনো গিয়েছে।সে বললো প্রতি সপ্তাহে একবার করে বের হয়।মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।এটা কি শুনলাম! ফোন করলাম ওর মোবাইলে।দেখি মোবাইল বন্ধ। মাথায় হাজারো চিন্তা, গেল কই।প্রতি সপ্তাহে এই একই সময়ে যায় কই। আরো চিন্তা করলাম বিয়ের এতো বছর পর কি তবে কারো সাথে কোন অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছে।এসব চিন্তা করতে করতে যখন মাথায় আগুন ধরে যাচ্ছিলো তখন এক বন্ধু ফোন করলো বললো, কিরে তুই কই? আমি বললাম কেন? বললো তুই কি সানমার ওশান সিটিতে? বললাম কেন? বললো না ভাবীকে দেখলাম সানমার ওশান সিটির ফুডকোটে বসে একজন অপরিচিত লোকের সাথে কফি খাচ্ছে।মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।নিজেকে সামলে বন্ধুকে বললাম, আরে এইমাত্র আমি ওকে সানমার ওশান সিটিতে নামিয়ে দিয়ে আসলাম।যার সাথে কফি খাচ্ছে ও আমার চাচাতে ভাই।বিদেশ থাকে কিছু কেনা কাটা করবে, তাই মার্কেটে গিয়েছে।ফোন রেখে কি করবো ভেবে পাচ্ছি না, হাত পা সব অবশ হয়ে যাচ্ছে।একবার চিন্তা করলাম ওশান সিটিতে গিয়ে হাতেনাতে ধরবো।পরে চিন্তা করলাম শহরের যে কোন এলাকা ও মার্কেটে গেলে পরিচিত লোক বা বন্ধু বান্ধবের সাথে দেখা হয়।সুতরাং ওখানে গেলে চেঁচামেচি হবে, তখন হয়ত আরো বেশী মানুষ জানতে পারবে তাই আবার অফিসে চলে গেলাম।সারাদিন স্টাফদের সাথে চেঁচামেচি করে কাটালাম, কোন কাজে মন বসছে না।শুধু একটা জিনিস মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সেটা হলো বউয়ের কথা ,সে কেন এমন করলো?একসময় খেয়াল করলাম মাথায় কোন কিছু কাজ করছে না, কি করবো তার কোন কুল কিনারা পাচ্ছি না।বিষয়টা কারো সাথে শেয়ার করবো কিনা তাও বুঝে উঠতে পারছি না।যাক সন্ধ্যার পর বাসায় এসে দেখি বড়ছেলে তার রুমে কানে হেডফোন লাগিয়ে অন লাইনে কি যেন করছে।ছোট ছেলে আরেক রুমে ট্যাবে গেইম খেলছে সাথে টিভিতে রেসলিং দেখছে।অন্য দিকে আমার স্ত্রী লাইট নিভিয়ে অন্ধকারে ওড়না দিয়ে মাথা পর্যন্ত ঢেকে কাত হয়ে শুয়ে আছে।আমি রুমে ঢুকে লাইট দিয়ে জামাকাপড় খুলে ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে কাজের মেয়েকে বলি এককাপ চা দিতে।টেবিলে বসে ভাবছি কিভাবে শুরু করবো।বউকে আমি যতটুকু চিনি, গত বিশ বছরে সে কোন ভুল স্বীকার করে নি।শুধু একটা স্বীকার করে সেটা হলো,”আমাকে বিয়ে করে সে ভুল করেছে”। যাক চা খেয়ে আবার রুমে এসে দরজার লক লাগিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় ও কার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো।কোন উত্তর করে না। অথচ আগে যে কোন সময় আমি কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে সে মোটামুটি দশটা আক্রমণাত্মক উত্তর দিতো।কিন্তু আজ ব্যতিক্রম।বললাম ছিঃ,এই বয়সে ছেলের বয়সী একটা ইয়ং ছেলের সাথে বসে কফি খেয়েছ, লজ্জা করে না। তাও কোন উত্তর করে না। আরো অনেক প্রশ্ন করার পর শুধু একটা কথা বললো।তুমি যা ইচ্ছা ভাবতে পার, তবে আমি কোন অন্যায় ও পাপ করি নি।চেঁচামেচি শুনে ছোটছেলে বড়টাকেও ডেকে এনে দরজা নক করছে।দরজা খুলে দেখি ছোটটা অঝোরে কাঁদছে আর বড়টা চেহারা মলিন করে দাঁড়িয়ে আছে।ছেলেদের এই অবস্হা দেখে চিন্তা করলাম আর সিন ক্রিয়েট করা ঠিক হবে না। কারণ ছেলেদের উপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।যাক চুপ করে রইলাম।রাতে কোন রকমে খেয়ে অন্য রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।খেয়াল করে দেখলাম বউ ঐ যে বিছানায় শুয়েছে উঠে আর কিছু খায় নাই।অবশ্য এটা তার পুরানো অভ্যাস। কখনো আমার সাথে রাগ করলে দুই একদিন না খেয়ে থাকে।পরে আবার জোর করে খাওয়াতে হয়।অর্থাৎ আমার উভয় সংকট কিছু বললেই খাওয়া বন্ধ।রাতে অন্য রুমে গিয়ে শুয়ে থাকা।একধরনের জ্বালা যন্ত্রণা আর কি? পরে আবার আমাকেই রাগ ভাঙাতে হয়। রাতে আর ঘুমাতে পারি নি। পরের দিন অফিসে গিয়ে ভাবলাম ওর বাবা মাকে বিষয়টা জানাই।
ফোন করে ওনাদেরকে বিষয়টা জানিয়ে সন্ধ্যায় আসতে বললাম।সন্ধ্যায় বাসায় এসে দেখি, ওর বাবা, মা, বড়ভাই ভাবী সবাই বাসায়।আমি আসার আগেই ওনারা এসে ওকে জিজ্ঞেস করে কিন্তু ও কিছুই বলে না।ওর এককথা আমি কোন অন্যায় বা পাপ করি নি, যদিও এটা তার পুরানো অভ্যাস, যেটা বলবে সেটা থেকে নড়বে না। ঘন্টা দুই পরে আমার শ্বশুর আমাকে একটা আলাদা রুমে ডেকে বলে তুমি চাইলে আমি ওকে কয়েকদিনের জন্য আমার বাসায় নিয়ে যেতে পারি। আমি বলি, আপনি যা ভাল বুঝেন তা করেন। যদিও গত বিশ বছরে ঝগড়ার পর অনেক বার আমার শ্বশুর এসে ওকে নিয়ে যেত, আমাকে কিছু না বলে।বিষয়টাতে আমি একটু কষ্ট পেতাম।তবু মেনে নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছি।যাক ওনি এসে ওকে বাসায় নিতে চাইলে সে বলে যাবে না।এই প্রথম তার এইরকম আচরণে ওনারাও হতবাক।বিফল মনরথে ওনারা চলে গেলেন।সকালে রেডি হয়ে অফিসে এসে দেখি মানিব্যাগে এক হাজার টাকা কম।বুঝলাম কথা না বললেও টাকা ঠিকই নিয়ে নিয়েছে।যাক এভাবে আরো প্রায় দুইমাস চলালো।খবর নিয়ে দেখলাম বের হয় কিনা। শুনলাম বের হয় তবে গলির দোকানে গিয়ে প্রতি সপ্তাহে কার নাম্বারে যেন টাকা পাঠায় ও মোবাইলে ফিসফিস করে কথা বলে। প্রায় ছয় মাস যাওয়ার পর একদিন ও আমাকে বলে, আমাকে এক জায়গায় নিয়ে যেতে পারবা।চুপ করে রইলাম।কয়েক বার একই কথা বলার পর বললাম, কখন কোথায়? বললো কাল দুপুর ২ টার দিকে।কোন উত্তর করলাম না।পরদিন দুপুরে খেয়ে ওকে নিয়ে বের হলাম।বললাম কোথায় যাবে।বললো চৌধুরী হাট।বললাম ওখানে কেন।বললো যেতে বলছি যাও।কাজ আছে।চৌধুরী হাট পৌঁছার পর বললো, বামে মোড় নাও।বুঝলাম এই রোড়ের শেষ মাথায় ওর নামে আজ থেকে ১৫ বছর আগে চার গন্ডা জায়গা কিনে দিয়েছিলাম, বোধহয় সেখানে যাবে।যদিও আমি মাঝেমধ্যে ওখানে একা যাই।তবে গত ১ বছরের মধ্যে যাওয়া হয় নি।যাক গাড়ী করে সেই জায়গার সামনেই গেলাম।গিয়ে দেখি, ওখানে ইটের গাথুনী দেয়া একটা টিন শেড।সামনে একটা সাইন বোর্ডে আমার মায়ের নামে একটা মহিলা এতিমখানা। জিজ্ঞেস করলাম, এই ঘর কখন উঠলো বা আমার মায়ের নামেই বা মহিলা এতিমখানা কেন? সে বললো, এখানে কোন প্রশ্ন নয়। শুধু দেখ কেমন হলো। দেখলাম বড় বড় তিনটা থাকার রুম।এক পাশে রান্নাঘর, আরেক পাশে লম্বা করিডোরের মত যেখানে ৫ টা বাথরুম।ছোট একটা অফিস কক্ষ।সামনে বেশ খালি জায়গা উঠানের মত।চারিদিকে প্রায় ছয় ফিট উচু বাউন্ডারি ওয়াল,সামনে গেইট।সব কিছু দেখে বাসায় রওয়ানা হলাম।গাড়ীতেও এ বিষয়ে কোন কথা বললাম না।কিন্তু মাথায় হাজার প্রশ্ন।বাসায় এসে রাতে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, বিষয় কি?ওখানে ঘর করার মত এতো টাকা কোথা থেকে এলো? বললো মনে আছে অনেক দিন আগে আমাকে একটা মিলিনিয়াম একাউন্ট করে দিয়েছিলে,ওখান থেকে এই বছর ১০ লাখ টাকা পেয়েছি।তার উপর গত ৮ মাসে আরো প্রায় ২.৫ লাখ টাকা তোমার থেকে নিয়েছি।বললাম ওখানে ঘর করবা আমাকে বল নি কেন? বললো তুমি সারাদিন ব্যবসা ও বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাক, তাই তোমাকে বলি নি।বললাম হঠাৎ মেয়েদের এতিমখানা কেন? বললো শহরের রাস্তায় চলাফেরার সময় অনেক মেয়েকে দেখি যারা রাস্তা, ফুটপাতে অনিরাপদ অবস্থায় থাকে, তাদের আশ্রয়ের একটা ব্যবস্হা করা।বললাম আচ্ছা এটা আমার মায়ের নামে কেন? বললো তোমার আম্মা আমাকে খুব ভালবাসতো।যতবার তোমার সাথে ঝগড়া করতাম, ততবার ওনি আমার পক্ষে থাকতেন।আমি অসুস্থ হওয়ার পর ওনি নফল নামাজ ও রোজা রেখেছিলেন আমার সুস্থতার জন্য।জীবিত থাকতে ওনাকে ওভাবে ফিল করতাম না।কিন্তু ওনার মৃত্যুর পর ওনি কয়েকবার স্বপ্নে এসে আমাকে বলেন “বউমা কেমন আছ, সুস্থ আছতো? তোমার জন্য আমি সবসময় দোয়া করছি, আল্লাহ যেন তোমাকে সবসময় সুখ ও শান্তিতে রাখে”। এবার আমার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরা শুরু হলো।ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।আমি তোমাকে ভুল বুঝেছি।খেয়াল করলাম সেও কাঁদছে।আরো বললাম, আমি সবসময় ভাবতাম আমার মাকে আমিই সবচেয়ে বেশী ভালবাসি কিন্তু আজ আমি তোমার ভালবাসার কাছে হেরে গেলাম!