শীতের রাত। বাইরে ঘন কুয়াশা। কয়েকদিন ধরে শৈত্যপ্রবাহ চলতে থাকায় কনকনে শীতে জবুথবু দেশের মানুষজন। গভীর ঘুমে প্রতিটি মানুষ। শুধু ঘুম নেই শিউলির।আনন্দ বেদনার সুখস্মৃতি রোমন্থনে তার দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
আজ বড় বেশি মনে পড়ছে অমূল্যকে। মনে পড়ছে সেই রাতের কথা।
শীতে কাঁপছে পুরো দেশ। হাড় কাঁপানো তীব্র ঠান্ডা। বেড়ার ফাঁক দিয়ে হীম শীতল ঠাণ্ডা বাতাস। ছেঁড়া পাতলা কাথা দিয়ে শীত নিবারণ অসম্ভব। ঘড়ির কাটায় এখন রাত প্রায় বারোটা। প্রতিদিনের মত আজ ও অমূল্য এখনো বাড়ি ফেরেনি। বিয়ের মাত্র তিনমাস হতে চললো।এর মধ্যে শিউলির জীবনে এক বিশাল ছন্দপতন।
মা বাবার আদরের বড় সন্তান। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় সে।শরৎকালে জন্মেছে বলে মা বাবা আদর করে নাম রেখেছে শিউলিমালা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রী শিউলিমালা। ইংরেজি সাহিত্যে লেখাপড়া করে।আশা, ভবিষ্যতে ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করা।অমূল্য ওর ছোটবেলার বন্ধু। শিউলিরা সরকারি কোয়ার্টারে থাকা অবস্থায় ছোটবেলায় একসাথে মাঠে খেলাধুলা করত। এর মধ্যে অনেকদিন দেখা হয়নি।বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষে পড়ার সময় ট্রেনে একদিন হঠাৎ ওর সাথে দেখা। প্রথমে চিনতে না পারলেও ওর মায়াবী চোখ দেখে চিনতে বাকী রইল না যে, সে অমূল্য।
যাহোক, অনেকদিন পর বাল্যবন্ধুকে পেয়ে শিউলির কথা যেন শেষ হয় না। ট্রেন কখন যে বটতলী স্টেশনে পৌঁছে গেছে খেয়ালই করেনি ওরা।এরপর থেকে অমূল্য নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আসত শিউলির সাথে দেখা করতে। শিউলি ও কয়েকদিন ওকে না দেখলে অস্থির হয়ে পড়ত। দেখা হলে দুজনের কত কথা।বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন, খেলার মাঠ, লাইব্রেরি, অডিটোরিয়াম, আনাচে কানাচে সব জায়গায় তার সুখের স্মৃতি। অমূল্যর সাথে যেখানে যায় সে জায়গাটা স্বর্গ মনে হত। দেখতে দেখতে শিউলির দ্বিতীয় বর্ষের রেজাল্ট বের হল। বরাবরের মত সে ক্লাসে সবোর্চ্চ নাম্বার পেয়ে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে উত্তীর্ণ হল।অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ক্লাস চলছে,এর মধ্যে শিউলির মা বাবা জানতে পারে অমূল্যর কথা। জানতে পারে অমূল্যর বখাটেপনার কথা।তাই তারা তড়িঘড়ি করে অন্য একটা ছেলের সাথে শিউলির বিয়ের পাকা বন্দোবস্ত করে ফেলে। কিন্তু শিউলিতো অমূল্য ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। সে যে অমূল্যকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। কার সাধ্য প্রাণ থাকতে শিউলিকে অমূল্যর থেকে বিচ্ছিন্ন করে?
একদিন রাতে কাউকে কিছু না বলে শিউলি অমূল্যের হাত ধরে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। পরিবারের সবার বাঁধা উপেক্ষা করে নানা নাটকীয়তার মাঝে তারা মন্দিরে বিয়ে করে । বিয়ের প্রথম সপ্তাহে শহরে একটা হোটেলে থাকলেও পরে অমূল্য শিউলিকে ওর বাবা -মার কাছে গ্রামে নিয়ে আসে। শিউলি জানে অমূল্য শহরে একটা কলেজে ডিগ্রি পড়ে। কথা ছিল ওরা শহরে থেকে টিউশনি করে লেখাপড়া চালিয়ে যাবে।
শহরে আরাম আয়েশে বড় হওয়া, শান্ত মৌন প্রকৃতির শিউলি প্রথম প্রথম গ্রামে থাকতে অসুবিধা হলে ও অমূল্যর ভালোবাসার টানে আস্তে আস্তে সে নিজেকে মানিয়ে নেয়। অমূল্যর সাথে থাকতে পারাটাই তার পরম আনন্দের। অমূল্যের মা বাবাকে ও সে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নেয়। কিন্তু এখন আর ভালো লাগছে না। অনেকদিন থেকে ভার্সিটি যাওয়া হচ্ছে না,অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা ও কাছে এসে যাচ্ছে। ইদানীং অমূল্যর কাছে সে অবাঞ্চিত, অপাংক্তেয় হয়ে গেছে। বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।
মানুষের ভালোবাসা যেমন টের পাওয়া যায়, তেমনি টের পাওয়া যায় অবহেলা, চরম অবহেলা।
প্রতিদিন রাত করে বাড়ি ফেরা অমুল্যর নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এ নিয়ে শিউলির সাথে অশান্তি লেগেই আছে। এর মধ্যে আবার নুতন উপদ্রব শুরু হয়েছে, অমূল্য নেশা করে ঘরে আসে।কিছু বলতে গেলে শিউলির গায়ে হাত ও তোলে। শিউলি জানতে পারে অমূল্য গ্রামে টেম্পো চালায়।
বাইরের মানুষের দুর্ব্যবহার সহ্য করা যায়, কিন্তু নিজের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া কষ্ট, সে যে কি ভীষণ ভয়ানক, তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানে।একদিকে অমূল্যর বেপরোয়া চলাফেরা অন্যদিকে তার উপর শারীরিক নির্যাতন। কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কি করবে, কোথায় যাবে সে? মা-বাবার কাছে যাওয়ার পথ সে নিজেই বন্ধ করে দিয়েছে।
সেদিন রাতে কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে অমূল্য ওকে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলে। সারারাত কান্নায় শরীর বারবার কেঁপে উঠছিল। বাধ্য হয়ে সকালে ঘর থেকে বের হয়ে যায় শিউলি। অসীম সংসারে দাঁড়াবার একবিন্দু স্থান নেই। মা বাবার মনে সে দুঃখ দিয়েছে। কিভাবে তাদেরকে মুখ দেখাবে? মনে হচ্ছে আপনার বলতে কেউ নেই।সারাদিন এখানে সেখানে ঘুরাঘুরি করে, সন্ধ্যায় সে তার পরম আশ্রয়স্থল মা বাবার শরণাপন্ন হয়।তাকে দেখে প্রথমদিকে চলে যেতে বললে ও মেয়ের কান্নাকাটি দেখে আবার বুকে টেনে নেয়।সন্তানের কষ্ট কোন মা বাবা সহ্য করতে পারে না।শুরু হল শিউলির নুতন জীবন। নতুন করে পথ চলার স্বপ্ন দেখে সে। সাহস করে অমূল্যের সাথে ডিভোর্স নিয়ে নেয়। ক্যারিয়ারে কিছু একটা করতে হবে।এই ছিল তার প্রবল জেদ।আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে।মধ্যবিত্ত পরিবারে ডিভোর্সি মেয়ের জন্য আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন খুব সহজ নয়। তবু শিউলি নিজেকে গড়ে তোলে তার প্রচণ্ড মনোবল আর ইচ্ছাশক্তির জোরেই।
শিউলি আজ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। জীবনে তার আর সংসার করা হয়ে ওঠেনি। মা বাবা নতুন করে সংসার করার কথা বললে ও সে আর কাউকে ভালোবাসতে পারেনি। সংসার জীবনে সে হয়ত ব্যর্থ, কিন্তু তার ভালোবাসাতো মিথ্যা ছিল না। তার প্রতিটি নি:শ্বাসে মিশে আছে অমূল্যের অস্তিত্ব। বুকটা ভারী হয়ে আসে। শিউলির চোখ গড়িয়ে দুফোটা অশ্র স্মরণ করিয়ে দেয় তার নিজের অস্তিত্ব।