একটি ছড়ার ছবি আঁকতে গিয়ে পুরো সমাজ জীবনের বাস্তবতা ও শিশু-মননের ছবিটাই অত্যন্ত সুনিপূণভাবে এঁকে ফেললেন শিবু কান্তি দাশ। কল্পনায় একটা ছবি আঁকব। ছড়ার ছবি। পুতুল বিয়ের ছড়া। আর সেই ‘পুতুল বিয়ে’র ছবি আঁকার ছলে কোনো লেখক তার লেখনী স্বত্তা ও বাস্তব মননশীলতাকে যদি এইভাবে তুলে ধরেন-
পালকি চড়ে বর আসছে
ঢোলক বাজায় ঢোল,
দেন মোহরের পাওনা নিয়ে
লাগলো গণ্ডগোল।
(পুতুল বিয়ে/পৃষ্ঠা-৬)

এই হচ্ছে একজন লেখকের লেখনী শক্তির মাধ্যমে প্রকৃত সমাজ বাস্তবতার প্রতিফলন। সমাজ ভাবনা। সামাজিক দায়বদ্ধতা। সমাজের অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরার প্রত্যয়। তারাই তো সমাজ বিনির্মাণের কারিগর। এই হচ্ছে একজন লেখকের চিন্তার ভিন্নতা। অনগ্রসর সমাজের এই রূঢ় কঠিন বাস্তবতাকে তিনি তুলে ধরেছেন অত্যন্ত সহজ সরল সাবলীল ভাষায়, শিশুর মতো করে।

‘একটি ছড়া আঁকব বলে’ শিরোণামের শিশুতোষ ছড়া গ্রন্থটির লেখক শিবু কান্তি দাশ। তিনি আপাদমস্তক একজন শিশুসাহিত্যিক। শিবুকান্তি দাশকে বিশেষ ভাবে পরিচিত করতে গেলে শিশুসাহিত্যের কিংবদন্তি আমীরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়, ‘শিবু ভালো লেখে আরও ভালো লিখবে এসব লঘু কথা বলার প্রয়োজন নাই। শিবুর ছড়া কবিতায় আমাদের চিরকালের সাহিত্যের সংযোগ আছে’।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শিবুকান্তি দাশ সাংবাদিকতার মতো জঠিল পেশায় নিয়োজিত থেকেও ক্রমাগত লিখে চলেছেন শিশুসাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়। ছড়া, কিশোর কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও সম্পাদিত গ্রন্থ’।

‘লাল সবুজের পতাকা’র ছবি আঁকতে গিয়ে লেখক যত্ন সহকারে লাল সবুজের পতাকাটিকে বুকে ধরেছেন এইভাবে-
দীর্ঘ ন’মাস যুদ্ধ করে
জীবন দিলো লড়ে লড়ে
বুকের ভিতর যত্নে রাখা
লাল সবুজের ঐ পতাকা।
(লাল সবুজের পতাকা/পৃষ্ঠা-৮)

লেখকের অন্তরদৃষ্টি কতটা প্রখর হলে একজন দুখি টোকাই কিংবা শিশুমানসের মনোবেদনা ঠিক নিম্মোক্তভাবে উপলব্দি করতে পারে-
নতুন জামা জুতো কেনার
সখ ছিল তার খুব
কে দেবে তাই দুঃখ মনে
কান্নাতে দেয় ডুব।
(দুখি ছেলে/পৃষ্ঠা-১০)

শারদীয়া’তে তিনি বলছেন-
এমন দিনে বছর বছর
মা দুর্গা আসে যায়
দুর্গতি নাশ করে সবার
দুঃখ মুছে সুখ বিলায়।
(শারদীয়া/পৃষ্ঠা-১৩)

আবার প্রকৃতি পরিবেশ নিয়েও লেখকের ভাবনায় অসীম মমতা লক্ষ্য করি-
গাছের ছায়ায় প্রাণ জুড়িয়ে
ফল খেয়ে হয় বল
দেহ মনে শক্তি জোগায়
বাড়ায় মনোবল।
(গাছ আমাদের বন্ধু/পৃষ্ঠা-১৮)

আবার মাকে নিয়ে ভালোবাসার তিনি বলছেন-
মায়ের কথা মধুর বাণী
মায়ের আঁচল সুখ
মায়ের কাছে সন্তানেরা
সবচে প্রিয় মুখ।
(মাকে নিয়ে/পৃষ্ঠা-১৯)

খুকুর ছড়ায় খুকুর স্বপ্নের ছবি এঁকেছেন অত্যন্ত চমৎকারভাবে-
‘তালগাছ একপায়ে’ আছে ওই দাঁড়িয়ে
স্বপ্নের রেলে চড়ে খুকু যায় হারিয়ে?
(খুকুর ছড়া/পৃষ্ঠা-২০)

শিরোনামের ছড়ায় লেখক একটি ভালো ছড়া আঁকার আকুতি ব্যক্ত করেছেন সুনিপূণভাবে নিচের পংতিগুলোতে-
একটি ভালো ছড়া আঁকতে
কতই করি ভাবনা
ভাবনারা সব পালিয়ে বেড়ায়
ঢাকা থেকে পাবনা।
(একটি ছড়া আঁকব বলে/পৃষ্ঠা-২৮)

টুনটুনি ও নীলমণি ছড়ার ছবির আকুতি-
ছোট্ট পাখি টুনটুনি
কি গানটি গাও গুনগুনি
কান পেতে দেয় নীলমণি
একটু জোরে গাও শুনি।
(টুনটুনি ও নীলমণি/পৃষ্ঠা-৩১)

২৮টি মজার মজার ছড়া দিয়ে সাজানো হয়েছে ‘একটি ছড়া আঁকব বলে’ শিরোনামের শিশুতোষ ছড়াগ্রস্থটি। বইয়ের অন্যান্য ছড়াগুলো হচ্ছে বাঘের ছানা, পুতুল বিয়ে, পকেটমার, লালসবুজের পতাকা, রক্তে কেনা বাংলাভাষা, দুখি ছেলে, বাঘের রাগ, ল্যাংড়া কানা ভূতের ছানা, শারদীয়া, দুখু মিয়া, বৈশাখ, চাঁদের দেশে বাড়ি, খোকাবাবু সম্্রাট, গাছ আমাদের বন্ধু, মাকে নিয়ে, খুকুর ছড়া, বীর পালোয়ান, জিতবে বাংলাদেশ, সুন্দর পরিবেশ, চড়–ই পাখি, চাঁদ উঠেছে, সা রে গা মা, নাচ করে, ও মেঘ, খুকুর জন্য ছড়া, টুনটুনি ও নীলমণি এবং মাংস রাঁধে শেয়ালে।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, লেখক শিবুকান্তি দাশ একটি ছড়ার ছবি আঁকতে গিয়ে এক বইয়ে একই মলাটে শিশুকিশোর উপযোগী ২৮টি ভিন্ন স্বাদের ছড়ার ছবি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে এঁকে ফেলেছেন। এছাড়াও ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘লাল নীল ঘুড়ি’ শিরোনামে আরো একটি পাঠক নন্দিত ছড়াগ্রন্থ’। কিশোর কবিতার অনন্য রুপকার হিসেবেও তার ‘রোদের কণা রুপোর সিকি’, ‘মাঠ পেরুলেই বাড়ি’, রোদ ঝুরঝুর মিষ্টি দুপুর’ শিরোনামের কিশোর কবিতার বইগুলো পাঠকমহলে বেশ সমাদৃত।

সাহিত্য সাধনা এবং সাংবাদিকতা উভয় ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। কর্ম, জীবন এবং সাহিত্য সব ক্ষেত্রেই তিনি সার্থক এবং সফল। সামাজিক দায়বদ্ধতা, শিশুদের প্রতি মমত্ববোধ, ভালোবাসা, শিশুদের মানসগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত থেকেও এক অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছেন।

আপাদমস্তক শিশু মন ও মানসের সারল্যে লালিত মানুষটি, চিন্তা-চেতনায়, মননে-মননশীলতায়, কথার-নান্দনিকতা ও সৃজনশীলতায় যে মানুষটি পাঠক নন্দিত হয়ে উঠেছেন সেই শিবু কান্তি দাশের প্রতি প্রাণঢালা অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা।

‘একটি ছড়া আঁকব বলে’ শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থটির চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী হাসেম খান। ভেতরের অলঙ্করণ করেছেন মিরাজুল আজম। মার্চ ২০১৭ সালে স্বাধীনতা বইমেলা উপলক্ষে বইটি প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রামের স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শৈলী প্রকাশন। লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন আরেক কিংবদন্তি ছড়াশিল্পী লুৎফর রহমান রিটন’কে। বত্রিশ পৃষ্ঠার ছড়াগন্থ’টির মূল্য একশত পঞ্চাশ টাকা। শিশু-কিশোর উপযোগী ছড়াগন্থ’টি সবশ্রেণির পাঠকের কাছে সমাদৃত হবে, এই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমি বইটির সর্বাঙ্গীন পাঠক প্রিয়তা কামনা করছি।