বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তন্ময়। সেই পুরনো টালির চালের ঘর দুটো ভেঙে সেখানে এখন এক ইটের গাঁথুনির ছোট্ট পাকাবাড়ির মত হয়েছে। সামনে একচিলতে বারান্দার কোণে মাধবীলতা। লাল- নীল ফুলছাপ পর্দা ঝুলছে জানালায়।
হঠাৎ বাড়িটার সামনে একটা দামী গাড়ি এসে দাঁড়ায়। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর অর্পাকে দেখে তন্ময়। ছিপছিপে চেহারাটায় হাল্কা মেদ জমলেও তাতে অর্পার সৌন্দর্য এতটুকু ম্লান হয়নি বটে কিন্তু সেই কাজলকালো দুটো চোখ, যার মোহে পাগলপারা ছিল তন্ময় সে’দুটোতে যেন অসীম এক ক্লান্তি ভর করে আছে!
উসকোখুসকো চুলগুলো বাতাসে উড়ছে, চেহারায় স্পষ্ট রাত জাগার ক্লান্তি। কিছুটা আড়ালে দাঁড়িয়ে অর্পার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তন্ময়।
মায়ের বলা কথাগুলো অনুরণন তোলে তার বুকের ভেতর।
তবে কি মায়ের কথাই ঠিক? সারাটা রাত কোথায় কাটিয়ে আসে অর্পা? কি এমন চাকরি সে করে যেখানে শুধুমাত রাতেই যেতে হয়? হাজারটা প্রশ্ন কিলবিল করে ওঠে তন্ময়ের মাথায়।
” দাঁড়াও অর্পা”।
এগিয়ে গিয়ে অর্পার পথ আটকে দাঁড়ায় তন্ময় । শ্লথ গতিতে বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে হঠাৎ করে তন্ময়কে দেখে থমকে দাঁড়ালো অর্পা।
“তুমি? কবে ফিরলে? ” ক্লান্ত বিষন্ন চোখ দুটো তুলে নিষ্পৃহ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো অর্পা। সামান্য হাসির আভাসও ফুটে ওঠে অর্পার ঠোঁটে।
“আমি কবে এসেছি সেকথা থাক, আগে বলো, এসব কি? কোথা থেকে ফিরলে এত সকালে”? না চাইতেও কঠিন হয়ে ওঠে তন্ময়ের স্বর।
একটু যেন চমকে উঠলো অর্পা!
” অনেকদিন আগে থেকেই মা বলছিল, কিন্তু নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করিনি। গত সপ্তাহে দেশে ফেরার পর থেকেই নজর রেখেছি তোমার উপর আমি। আমার আসা বা না আসা নিয়ে তোমার যে আর কোন আগ্রহ নেই সেটা আমি অনেক আগে থেকেই বুঝে নিয়েছি। কিন্তু আমি তো আর তোমার মত অত সহজে রূপ বদলাতে পারিনা,তাই সব সম্পর্ক ভেঙে দেয়ার আগে সরেজমিনে একবার তদন্ত করতে চেয়েছিলাম। অবশ্য সফলও হয়েছি বলা যায়।
আজ তিনদিন ধরে খেয়াল করছি তোমায়। এখন বলো দেখি, কার গাড়ি প্রতিদিন সকালে তোমায় নামিয়ে দিয়ে যায়”? একনাগাড়ে কথাগুলো বলে হাঁফাতে লাগলো তন্ময়।
নিজের সম্বন্ধে এতসব অপমানজনক কথা শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে অর্পার! দু’ চোখের দৃষ্টিতে যেন আগুন ঝরছিল তার!
” সরেজমিনে তদন্ত করে অনেক কিছুই তো জেনে নিয়েছো দেখছি আমার বিষয়ে! সবই যখন জেনে নিয়েছো তখন আসলে কেন? আমি কি ডেকেছিলাম তোমায়”?
” তুমি ডাকোনি, কিন্তু আমি দেখতে এসেছিলাম, কোন প্রলোভনের এত তাড়া ছিল তোমার।
কেন করলে এসব? আরেকটু কি অপেক্ষা করা যেতো না আমার জন্য “? শ্লেষাত্মক কন্ঠ তন্ময়ের।
” অপেক্ষা? তোমার জন্য? যে গত দু’ বছর কোন খোঁজই নেয়নি আমার! ফোন করলেই কলবক্সে তোমার ব্যস্ততার সংবাদ পেতাম। মেসেজ ছাড়তাম কিন্তু কোন ফিরতি কল পেতাম না। তোমার একটা সংবাদের জন্য তোমার মায়ের কাছে গিয়ে কতবার অপমানিত হয়েছি, সে খবর কি তুমি রাখো মিস্টার তন্ময় ? এখন এসেছো আমার কাজের জবাবদিহি চাইতে।
নির্লজ্জতারও কি কোন সীমা- পরিসীমা থাকতে নেই “? তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল অর্পার কন্ঠ।
” ঘরে যার চার- চারটা ক্ষুধার্ত মানুষ থাকে, অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা, ছোট ভাইবোন দুটোর পড়াশোনাসহ হাজারো দায়িত্ব যার কাঁধে, সে কি করে কাজের ক্ষেত্রে দিন- রাতের হিসাব করবে জানতে পারি? তুমি কি একবারও…. ”
” আরে রাখো তো তোমার ঐ ফিরিস্তি দেয়া “! মা ঠিকই বলেছিল, গরীবদের চরিত্র খারাপ হতে সময় লাগেনা। কত মেয়ে টিউশনি করে কিংবা ছোট চাকরি করেও তো সংসার চালাচ্ছে। তুমি তো পড়াশোনায় ভালোই ছিলে, চাইলে কি ভদ্রপথে কোন কাজ করা যেতো না? আরে, বেকার বেকার আমায় এতবার ফোনের চেষ্টা না করে তোমাদের এই অভাবের কথাগুলোই তো মেসেজ করে আমায় জানাতে পারতে এটলিস্ট “!
অর্পার প্রতি অভিযোগ আর আক্রোশের যেন সীমা নেই তন্ময়ের!
” বেশ বলেছো! তোমায় জানাতে পারতাম! ” এবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো অর্পা।
” শোন মিস্টার তন্ময়, আমার এতকথা শোনার পরেও যখন তুমি তোমার পয়েন্টে স্থির রয়েছো, তখন আসল কারণটাই এবার বলি তোমায়। আমি এ পথে গেছি নিজের চাহিদা মেটাতে। তুমি তো সবকিছু ভুলে তখন কানাডায়….”
হঠাৎ ঠাস্ করে একটা শব্দ মাঝপথেই থামিয়ে দিলো অর্পার কন্ঠস্বরকে !
আর পেছন ফিরে তাকায়নি তন্ময়। মায়ের কথাই ঠিক। অর্পা একটা নোংরা মেয়ে। ভাগ্যিস! সময় থাকতে বুঝতে পেরেছে ও!
শহরের নামকরা বনেদি পরিবার আর ধনী পিতার একমাত্র সন্তান রুবার সাথে তন্ময়ের বিয়ে ঠিক করেছে তার মা। অবশ্য স্মার্ট সুন্দরী রুবাকে দেখে তন্ময়ও খুশিতে ডগোমগো একেবারে! তাই আংটিবদলটা তন্ময়ের ইচ্ছেতেই খুব তাড়াতাড়ি সেরে ফেলেছে তার বাবা-মা।
রুবার বাবার আন্তরিক দাওয়াতে আজ সপরিবারে রুবাদের বাড়িতে ডিনারে এসেছে তন্ময়ের পরিবার। বিয়ের দিন- ক্ষণ আজই ঠিক করবে রুবার দাদী।
রুবার দাদী যদিও পঙ্গু, তবু্ও তাঁর কথাই এই পরিবারের শেষকথা বলেই জানালেন তার বাবা।
রুবার মায়ের অনুরোধে একটুকরো মিষ্টি মুখে তুলতেই জোর বিষম খায় তন্ময়! রুবার দাদীকে হুইল চেয়ারে ঠেলে নিয়ে আসছে তাঁর আয়া।
” এসো মা, এই আমার মা”। সবার সাথে তাঁর মায়ের পরিচয় করিয়ে দিলেন রুবার বাবা।
” আরও একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই আপনাদের। এর নাম অর্পা। আমার আরেক মেয়ে বলতে পারেন। ওর সেবাতেই আমার মা ধীরেধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। গত আড়াই বছর ধরে ও আমাদের বাড়ির মেয়ে হয়ে গেছে। রাতটা ও মায়ের সাথে থাকে বলেই আমরা সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমাই “। অর্পার দিকে স্নেহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন রুবার বাবা।
এবার ঠাস্ করে কোন আওয়াজ না হলেও তন্ময়ের গালটা যেন কেমন তীব্রভাবে জ্বালা করে উঠলো!