সুখলাল শুয়ে আছে বারান্দায়।
আজ তিন দিন ধরে জ্বর। সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা। হাটে গিয়ে যে শম্ভু চরণের ফার্মেসী থেকে ওষুধ কিনে আনবে তারও জো নেয়। দু’দিন ধরে একটানা বৃষ্টি। মোটেও থামছে না। তারিখটা খেয়াল করল সুখলাল। শ্রাবণ মাসের দুই তারিখ। বৃষ্টি হওয়ারই কথা।
দু’কামড়ার একখানি ছোট্ট ঘর। টিনের ছালা। সারাক্ষন রিম ঝিম রিম ঝিম বৃষ্টির শব্দ। ঘরের পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে চলেছে ডোমখালী নদী। একটানা বৃষ্টি হলে কেমন ভয় ভয় করে। ডোমখালী নদীর পাড় ঘেষে বিশ পচিঁশ ঘর জেলের বাস। মূল পেশা নদীতে মাছ ধরা। একটা মাত্র বড় টানা জাল। সুখলালের বাবার একমাত্র সম্বল। ঐ জালের উপর এই জেলে পাড়ার মানুষগুলোর রুটি রুজি। মাঝে মধ্যে গ্রামের বিয়ে শাদীতে বাদ্য বাজনা নিয়ে যেতে হয়। তাতেও কিছু আয় রোজগার হয়। এখন গ্রামের বাড়ীতে বিয়ে শাদী কম। কমিউনিটি সেন্টার হওয়াতে ইদানীং গ্রামের ঢুলিদের কদরও কম। শহরের ব্যান্ড পার্টির কদর বেড়ে গেছে। ধীরে ধীরে জেলে সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পেশাগুলো কেমন হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুখলাল। বর্ষাকালে টানা জালের কদরও কম। সকালে হরি এসে বলল-ও খুড়া, আজ পশ্চিম পাড়ার মহাজনের পুকুরে বাউনি আছে। জালটা লাগবে। সুখলাল নিজে যেতে পারবে না। জালের ভাড়াটা পাবে। নিজে বাউনি করলে তারও একটা অংশ পাওয়া যায়। একেতো ঝড় বাদলের দিন। হাতে তেমন টাকা পয়সাও নেয়। জাল ভাড়াটা হলে মন্দ কি? সুখলাল খুশি হয়। ও হরি, জালটা সাবধানে টানিস বাপ। এখনতো পানি বেশি। গোঁজা গাঁজি লেগে যাতে ছিড়ে না যায়। আর আমার জন্য কয়ডা মইল্যা মাছ পাইলে নিয়া আসবি। জ্বরে মুখটা তিতা হয়ে আছে। কিছুই খাইতে ইচ্ছা হয় না। আইচ্ছা কাকা। আমি তোমার জন্য ঠিকই নিয়া আসব। বলল, হরি মাধব জলদাশ।
এখন জোয়ারের সময়। নদীর পানি আস্তে আস্তে বাড়ছে। হরি কাঁধের গামছাটা কোমড়ে জড়িয়ে উঠোনে পা দিতেই দেখল পানি এক হাঁটু হয়ে গেছে। সুখলালের ভিটিটা খুব বেশী উঁচু নয়। প্রায় জোয়ারে বারান্দা পর্যন্ত পানি ছুঁই ছুঁই করে। একটা বড় ডোরা সাপ লিক লিক করে মাটির তাক্ বেয়ে বারান্দায় উঠতে যাচ্ছিল। হরি ছোঁ মেরে সাপটাকে ধরে বলল-ও খুড়া দেখছো এইটা কী? পাথরের ঢেলাটা দাও। মাথাটা থেতলা কইরা ফেলে দিই। সুখলাল বলল-মারিস নারে বাপ। ছেড়ে দে। বর্ষার দিন। কোথায় যাবে। ওদেরও তো একটা নিরাপদ আশ্রয় দরকার। তাছাড়া এখন শ্রাবণ মাস। মা বিষহরির ঘট বসেছে। জাত সাপগুলো সব আশ্রয় নেবে মানুষের বাড়িতে। হরি সাপটার লেজ ধরে দু’চক্কর ঘুরিয়ে নদীর ওপারে ছুঁড়ে মারল।
সুখলালের ঘরের সাথে নদীর কূল ঘেষে বেড়ে উঠেছে একটা জারুল গাছ। বড় গাছটার পাশাপাশি আরও কয়েকটা আম, জাম। জারুল গাছের সাথে বাঁধা আছে নৌকাটা। সুখলাল পলকহীন তাকিয়ে আছে নৌকাটার দিকে। ভাবতে থাকে অসহায় সুখলাল কিভাবে নৌকার মালিক হলো।
এ সমাজে একটা জাল আর একটা নৌকা থাকলে সবাই সমীহ করে। গ্রাম পঞ্চায়েতে সুখলালের মতামতকে প্রাধান্য দেয়। তাল তলার সুধামনি জলদাশের সাথে সুখলালের বিয়ে দিয়েছিল সুখলালের বাবা। একটা বড় টানা জাল ছিল বলে সুধামনির বাবাও আপত্তি করেনি। তাছাড়া সুখলাল দেখতেও মন্দ না। মাথাভর্তি ঝাকড়া কোকড়ানো চুল। বলিষ্ঠ সুঠাম দেহ। গায়ে গতরে খাটা খাটুনি করতে পারে। এরই মধ্যে জালের মালিক হিসাবে মাঝি বলে সবাই মান্যি করে।
সুধামনি মেট্রিক পাশ করেনি। নতুন সংসারে সুখলালের সাথে হাল ধরল। সুধামনির গতরটা ছিল অস্বাভাবিক রকমের কর্মঠ। গায়ের রং শ্যামলা। মাথাভর্তি লম্বা কালো চুল। আঁটসাঁট করে এক কোঁচা শাড়ীতে অবাধ্য যৌবনকে বেঁধে রাখা মুশকিল। যৌবনের শত শহস্র পুঞ্জিভূত শক্তি যেন শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে লুকোচুরি খেলছে। সুধামনির সাহসও আছে। বাসর রাতে অনেক কথার ফাঁকে সুখলালকে স্পষ্টই বলে ফেলল, জাল তো আছে, এবার একটা নৌকা গড়তে হবে। নৌকাটা হলে সংসারের অনেক কাজে লাগবে। দিনমানও ভালো যাবে। সুখলাল মাথা নেড়ে সায় দিল। বলল, তুমি সাথে থাকলে একটা নৌকা অবশ্যই হবে। নৌকার ছইয়ে বসে তুমি হাল ধরবে, আর আমি লগি বৈঠা মারব। দু’জনেই হাসল।
তারপর থেকে সুখলালকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। হাত খরচ থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে সুখলালকে বলত দু’টো হাঁসের বাচ্চা আনতে, দু’টো মুরগীর বাচ্চা আনতে। একসময় দু’টো ছাগলও হলো। একটা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে নৌকা বানানোই হাত দিল সুখলাল। সাহস দিল সুধামনি। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য সুধামনি দায়িত্ব নিল। তাদের প্রাথমিক ধারাপাত শিক্ষা দেয় সুধা। তাতেও কিছু বাড়তি আয় হয় সংসারে।
গায়ে ঘাম দিয়ে জ্বরটা কমেছে। কিছুটা আরাম বোধ হচ্ছে। জোয়ার এসে গেল বলে সুধা হাঁস মুরগীগুলো বেঁধে এসেছে। বারান্দার একপাশে রান্নাঘর। কয়েকদিন টানা জালটা পুকুরে পড়েনি। মাছের কেমন একটা আঁশটে গন্ধ বের হচ্ছে। নৌকাটার দিকে তাকিয়ে বলল-ও বউ, একবার হুকাটা নিয়ে আমার কাছে আসো। মুখটা যে তেতো হয়ে গেলো।
সুখলাল এতক্ষণ শুয়ে ছিল। সংসারের নানা কাজে কাছে আসা হয়নি। দু’টো টিক্কা কুপির আগুনে জ্বালিয়ে হুকাটা হাতে দিয়ে বলল-মাথাটা ধুইয়ে দিই। কপালে হাত দিয়ে দেখল জ্বর নেই। বারান্দার গাছের খুটিতে হেলান দিয়ে উঠে বসেছে সুখলাল। বউ এর হাতটা টেনে ধরে বলল-সুধা আমার পাশে একটু বসো। সুধা হাতটা ছাড়িয়ে নেয়নি। এদিক ওদিক উঁকি দিয়ে দেখল। তারপর বলল-ছেলে মেয়েদের ছুটি হয়ে গেছে। এখনি হয়তো এসে পরবে। এখনো ভাত রান্না হয়নি।
বৃষ্টি কিছুতেই থামছেনা। টিনের ছিদ্র দিয়ে কয়েক জায়গায় ফোঁটা ফোঁটা জল পরছে। তাতে কোথাও গামলা কোথাও হাড়ি বসিয়ে দিয়েছে সুধা। একটা নিদ্দিষ্ট তাল, লয়, ছন্দে টক্ টক্ শব্দ হচ্ছে। হাড়ির তলায় জল জমে যাওয়াতে আর টনটনে শব্দটা হচ্ছে না। সুখলাল সুধার ডান হাতটা শক্ত করে বুকের কাছে ছেপে ধরে। বাম হাতে হুকোটাতে কয়েকটা আলগা টান মেরে কলকের আগুনটা ধরিয়ে নেয়। তারপর আয়েশ করে জোরসে টান দিতেই কাঁশি উঠল। কাঁশতে কাঁশতে মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছিল। সুধা মনি মাথাটা বুকের উপর সোজা করে ধরে বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। একটু কমছে কাশিঁটা। সুধা উঠে রান্না ঘরে গিয়ে একটু আদা জল গরম করে এনে বলল-এটা খেয়ে নাও। আজ বিকালে বাজারে গিয়ে ওষুধ নিয়ে আসবে। সুখলাল আবার বউয়ের হাতটা চেপে ধরে। কেমন যেন ভয় ভয় করছে। সুধাকে খুলে বলতে পারছে না।
-ও বউ, প্রথম যেদিন এই নৌকাটি নদীতে নামিয়েছিলাম তোমার মনে আছে। আমার যে কী আনন্দ হয়েছিল সেদিন! ঐ দিনটার কথা মনে হলে আজও আমার চোখে জল আসে। তুমি আসার পর আমার নৌকা হলো, সংসারে আয় উন্নতিও কম হল না। আস্তে আস্তে ঋণও শোধ হলো। আমার কানু আর রাধা স্কুলে যাচ্ছে। সেটা যে কতবড় আনন্দের কথা, আমি বলে বুঝাতে পারব না। অন্তত: আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারব, সুখলাল জলদাশ মুর্খ হতে পারে, তার ছেলে মুর্খ নয়। আমার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হবে। এ সবই তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য বউ। একটু থেমে বলল-ও বউ, আসল কথা হইল তুমি আমার ঘরের লক্ষী। হুকোটা বেড়ার সাথে ঠেস দিয়ে রেখে দু’হাতে সুধামনির মুখটা বুকের মধ্যে চেপে ধরল সুখলাল।
দিনের বেলা। লজ্জায় সুধামনি কোন রকমে পালিয়ে চুলার আগুনটা বাড়িয়ে দিল। ভাবছে এইতো সেদিনের কথা। নৌকাটা যেদিন নদীতে নামবে সেদিন সারাটাদিন উপোষ করেছিল সুধামনি। মনা ফকিরের মাজারে বাতি জ্বালিয়ে এসেছিল সুখলাল। যাওয়ার সময় সুধামনিকে বলে গিয়েছিল, ও বউ আমি কিন্তু মানত করে আসব। আমাদের প্রথম ছেলে হলে ফকির বাবার ওরশের দিন একটা ছাগল দেব। তুমি কি বল বউ? সুধামনির সে কী লজ্জা! তারপর খালের পাড়ে মা শীতলার পুজো করেছে। জেলে পাড়ার সবাইকে একা রান্না করে খাইয়েছে সুধামনি। পাড়ার অন্য বৌ ঝি’দের কান ভারী হয়ে যাচ্ছে। বয়ষ্করা যখন বলে বেড়াচ্ছে সুখলালের বউটা সাক্ষাত লক্ষী। কেমন করে সংসারটাকে তুলে আনছে।
তিথিটা ছিল শ্রাবণ পূর্ণিমা। বৃষ্টি আর জো¯œা। সে কী এক অপরূপ দৃশ্য! সারা আকাশ জুড়ে হালকা মেঘ। শিমুল তুলোর মতো ভাসছে। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘের গর্জনও কম নয়। সন্ধ্যা হতে না হতেই সারা গ্রাম নীরব। সবাই যে যার মত ঘুমিয়ে পরেছে। সুখলাল আর সুধার ঘুম আসছে না। নৌকাটা বাঁধা আছে। ভয় হচ্ছে কেউ যদি নিয়ে যায়। সুধামনির অন্তরে একটা গোপন ইচ্ছা বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনভাবে সুখলালকে বলতে পারছে না। আকাশে এখন বৃষ্টি নেই। রিম ঝিম শব্দ থেমে গেছে। সুধামনি দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে সুখলালকে। উষ্ণতার নিশ্বাসটা ক্রমশঃ ঘন হচ্ছে। সুখলালের বুকে মাথা গুজে বলল-চলো বাইরে বারান্দায় গিয়ে বসি। নৌকাটাও দেখা হবে। সুখলাল খুশি হয়। আজ সুধামনির জন্য এই নৌকা। বলল-বারান্দায় কেন, চল এই চাঁদনি রাতে নৌকা করে একটু ঘুরে আসি।
– ওমা, আমি কি তাই বলছি নাকি?
– আমি বলছি। আমার খুব ইচ্ছা করছে।
– ঘরে যে বাবা একা শুয়ে আছে।
– বাবা ঘুমিয়েছে। সকালের আগে ঘুম ভাঙ্গবে না। আমরা ততক্ষণে ফিরে আসবো।
এতক্ষণ মনে মনে এটাই চেয়েছিল সুধামনি। সুধাকে আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সুখলালের মত স্বামী পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেয়। ঘরের বাইরে এসে দেখে নৌকাটা চাঁদের আলোয় চিক চিক করছে। দুই পাশে দুই গলুইয়ে গাঢ় লাল রং। মাঝখানের পাটাতনগুলোতে দিয়েছে গাঢ় সবুজ। জারুল গাছটার ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে খ- খ- মেঘ। সুধামনিকে হাত ধরে নৌকায় উঠিয়ে দেয় সুখলাল। নৌকার লগি খুলে দিয়ে বৈঠাটা নিয়ে গলুইয়ে বসল সুখলাল। দু’পা ছড়িয়ে দিয়ে কোলের কাছে বসল সুধা। যাত্রা পালায় শোনা দু’একটা গানের কলি মনে করার খুব চেষ্টা করছে সুখলাল। এই মূহুর্তে কিছুই মনে পরছে না। বিয়ের বাজনা বাজানোর সময় কত নিত্য নতুন গান তুলেছে সানাইয়ে। সুখলালের গানের গলাটাও খারাপ না। ভরাট গলা। কিন্তু এখন এমন হচ্ছে কেন?
নৌকা বয়ে চলছে উজান চরের দিকে। এই মূহুর্তে দরাজ গলায় একটা গান করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কোন গানের কলিই মনে করতে পারছে না। সুধামনিও অনুরোধ করল একটা গান করার জন্য। নিজের উপর রাগ হচ্ছে। এমন হচ্ছে কেন? বৈঠাটা ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে সুধার গলা জড়িয়ে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল-
– বউ, দুনিয়াটা যে কত সুন্দর তা আজ বাইর না হলে বুঝতাম না। আমরা উজান চরে যাবো। এতক্ষন হয়তো ভাটির টানে পানি নেমে গেছে। ঐ চরে গিয়ে আমরা বসবো।
– কত সময় লাগবে? আমার ভয় ভয় করছে।
– আমি থাকতে তোমার ভয় কিসের? তুমি তো এর আগে এদিকে আসোনি।
সামনে ভাসানির টেক ফেলে কিছুদূর দক্ষিণে গেলে উজান চর। ওখানে পাাহাড়ী ঢলে ভাটির স্রোতটা খুব বেশি। এ পাড়টায় নতুন চর জেগেছে। চারপাশে উলুবন। প্রতি বর্ষায় যখন পূর্নিমার ঢালা পরে তখন প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। আশে পাশে গ্রামের মানুষের মধ্যে আনন্দের সাড়া পরে যায়। সবাই জাল নিয়ে মাছ ধরার উৎসবে মেতে ওঠে। কত রকমের মাছ।
ভাতের মারটা চুলায় পরার ফড় ফড় শব্দে চমকে উঠে চোখ মুছল সুধামনি। সুধামনি সেদিন কখন যে নৌকার মধ্যে ঘুমিয়েছিল সেটা মনে পরলে আজও হাসি পায়। চুলায় কয়েকটা শুকনো পাতা গুজে দিয়ে বলল-ও কানুর বাপ, আর একটু। ভাতটা হয়ে এল। মারটা ছাড়িয়ে তোমার জন্য জল নিয়ে আসছি। আমি মাথা ধুইয়ে দেবো।
এর মধ্যে আবারও একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেলো। দমকা হাওয়া নেই। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। উঠোন থেকে জলটাও ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। কানু ও রাধা দুটো বড় কচু পাতা মাথায় দিয়ে ভিজে জবু তবু হয়ে ঘরে ফিরেছে। বইগুলো পলিথিনে মুড়িয়ে জামার ভিতর গুজে রেখেছে। সুধামনি তাড়াতাড়ি শাড়ির আঁচল দিয়ে ছেলে মেয়েদের গা মাথা মুছে দিয়ে বলল-ভেজা কাপড়গুলো তাড়াতাড়ি পাল্টিয়ে নে বাবা, ঠান্ডা লেগে যাবে।
কানু চতুর্থ শ্রেণিতে পরে। পুরো নাম কানাই লাল জলদাশ। রাধিকা দ্বীতিয় শ্রেণিতে। ভালোই সাঁতার কাটতে পারে কানু। নৌকাও বাইতে পারে ভালো। ভাই বোন মিলে নদীতে সাঁতার কেটে, লাফালাফি করে সময় কাটে। সুখলালের সাথে মাছ ধরতে যেতে দিত না সুধামনি। বলত-বাপরে দিন দিন পুকুর নদীতে মাছের আকাল বেড়ে যাচ্ছে। আগের মত মাছ নাই। আগে কত রকমের মাছ পাওয়া যেত। একটা ঝাঁকি জাল নিয়ে বের হলে যে মাছ পাওয়া যেত তা নিজেরা খেয়ে আরও বাজারে বিক্রি করতে পারতো। এখন সারাদিন জাল মেরে দু’বেলা খাওয়ার মাছ জোগার করা মুশকিল। তোদেরকে লেখাপড়া শিখে মানুষ হতে হবে। ভালো চাকরী করতে হবে। এই পেশা আঁকড়ে ধরে থাকলে ভবিষ্যতে কিছুই করতে পারবি না বাপ।
স্কুল ছুটির পর রাধা আবদার করেছিল-দাদা আজ আমাকে নৌকায় চড়াবি। অনেকদিন তোর সাথে নৌকায় চড়ি না। এই বর্ষায় খুব মজা হবে। কানু আশ্বাস দিল। বিকালে বাবাকে বলে তোকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসব। সুখলাল না করেনি। তবে সাবধান করে দিল-দেখিস বাবা। এখন দক্ষিণের পাহাড়ী ঢলে ভাটির স্রোতের টান খুব বেশি। ও দিকে যাবি না। রাধা বাবার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, দাদার সাথে নৌকায় গেলে বাজারের ফার্মেসী থেকে ঔষধ নিয়ে আসব।
সুখলাল না করল। তার দরকার হবে না রে মা। এইতো ভালো হয়ে গেছি। আর দু’এক দিন। তারপর গায়ের ব্যাথাটা কমে গেলে আবার কাজ শুরু করতে পারব। হরির দেওয়া মলা মাছটা একটু ঝাল করে রান্না করেছে সুধামনি। সাথে একটু দেশি আমড়া দিয়েছে, মুখে রুচি আনার জন্য। সুখলাল খেতে পারে নি। ভিতরে ভিতরে জ্বরটা রয়ে গেছে। মুখটাও ভীষণ তেতো।
রাধার তর সইছে না। বেলা পরতে আর বেশি দেরী নাই। টিনের চালের সাথে গুজে রাখা বৈঠাটা নিয়ে কানু নৌকায় উঠে গেছে। রাধিকা মায়ের কাছ থেকে ওষুধের টাকাটা নেওয়ার সময় বাড়তি দু’টাকা চেয়ে বলল-ও মা, সাধুর দোকানে ভালো পেঁয়াজু বানায়। দু’টাকার কিনে খাবো। সুখলাল কথাটা শুনে বলল-আমার রাধা মা কী বলে শোন, দশটা টাকা নিয়ে যা। আমার আর তোর মার জন্যও নিয়ে আসিস। অনন্ত সাধু পেঁয়াজুটা খুব ভালো বানায়।
টাকাটা নিয়ে নামতে গিয়ে মাটির পিচ্ছিল সিঁড়িতে আঁচাড় খেল রাধা। সুধামনি দৌড়ে এসে কোলে নিতেই রাধা বলল-আমার একদম লাগেনি মা। মায়ের মন কেমন বিপদের আশংকায় অস্থির হয়ে উঠল। বলল-বের হতে যখন হোচঁট খেয়েছিস একটু জিরিয়ে নে। সুধামনি নিজে গিয়ে রাধাকে নৌকায় তুলে দিয়ে বলল-সাবধানে যাবি কিন্তু, আর তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি।
ভাটির টান পরেছে। উল্টো স্রোতে দাড় বেয়ে দক্ষিণে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা। সামনে বাজার। নদীর দু’পারে ঘন উলুবন। বিভিন্ন আগাছা লতা গুল্ম জড়িয়ে আছে। পানি যে রাস্তা ছুঁই ছুঁই করছে তা দাগ দেখে বোঝা যাচ্ছে। পাহাড়ী ঢলে একটা বড় গাছের গুড়ি নেমে এসে মাঝপথে আটকে আছে। কোনোভাবে নৌকাটা পার করতে পারছে না। কানু বলল-তুই নেমে গলুইটা একটু টেনে ধর। কানু যতটা সম্ভব নৌকার গলুইটা পাড়ে ভিড়াতে চেষ্টা করছে। পাড়ের কাছাকাছি গলুইটা লাগতেই রাধা লাফ দিয়ে নামল। খালের খাড়া পাড়ে হাটু পরিমান পানি। ফ্রক ভিজে গেছে। উলু বন, মদন কাটা ও নানা রকম ঝোপ ঝাড়ে ভর্তি জায়গাটা। সুই ফোটার মত কীসের যেন একটু ব্যথা পেল রাধা। কানু নেমে নৌকাটা বেঁধে বলল-তুই নৌকায় বস। আমি বাজার থেকে ঔষধ আর পেয়াঁজু নিয়ে আসি। রাধা বলল-আমিও যাবো। দু’জনে বাজার থেকে ফিরে নৌকায় বসল।
রাধার শরীরটা কেমন যেন নেতিয়ে আসছে। বুঝতে পারছে না কী হয়েছে। সুধামনি কান্নাকাটি করছে। আর গরম স্যাঁক দিচ্ছে কাঁধের উপর ঘাড়ের বাঁ দিকটায়। ওখানে একটা কালচে দাগ। মনে হচ্ছে বিষাক্ত সাপে কাটা দাগ।
সন্ধ্যার অন্ধকারে ধীরে ধীরে রাধার শরীরটা নীল হয়ে গেলো। রাতের আকাশটা থমথমে। এখনি হয়তো অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টির রিম ঝিম শব্দে রাধা আর কখনও নাচবে না। নৌকায় উঠে আর পা ভিজাবে না নদীর জলে।