সকাল থেকেই শায়লার ব্যস্ততা তুঙ্গে। তিন বেডরুমের ফ্ল্যাটটার একটা রুমকে ঝাঁ চকচকে করে তুলছে সে। ঘর সাজানোর পাশাপাশি পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকা ছোট্ট ছেলেটাকে সে বারবার বলে যাচ্ছে, ‘ বুবুনসোনা, আব্বু আজ নানুকে হাসপাতাল থেকে আমাদের বাড়ীতে নিয়ে আসবে। নানুর শরীর ভালো নেই একদম! তুমি একদম দুষ্টুমি করবে না নানুর সাথে। কেমন সোনা? ‘
বেচারা বুবুন এত শরীর খারাপটারাপ বোঝে না। তার একটাই আনন্দ যে, আব্বু আজ নানুকে তাদের বাড়ীতে নিয়ে আসবে, সে সারাদিন একটা খেলার সঙ্গী পাবে।
আজিম তার শাশুড়িকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করানোর জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে আজ। শায়লার সাথে বিয়ের পর তার ভাই মায়ের সব দায়িত্ব বোনের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজে ঝাড়া হাত-পা হয়ে গেছে। বছরে তিনবার বৌ নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে গেলেও শালার নাকি কাজের ভীষন চাপ! তার বৌ, সেও চাকরি করে, দুজনের ব্যস্ততার জন্য এখন অবধি সন্তানটাও নেয়া হয়নি তাদের!
হাসপাতালের যাবতীয় ফর্মালিটি শেষ করে শাশুড়িকে নিয়ে গাড়িতে ওঠার আগে আজিম শায়লাকে মোবাইল করে মাকে নিয়ে আসার সুসংবাদটা জানিয়ে দিল।
ডোরবেল বাজতেই বুবুন হাততালি দিয়ে লাফাতে শুরু করেছে, ‘ নান এসেছে, নানু এসেছে’!
শায়লা দরজা খুলে তার মাকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে নিয়ে গেল মায়ের জন্য নির্ধারিত ঘরের দিকে।
শাহানারা বেগম ভাবতেই পারেননি যে, নিজের ছেলে থাকা সত্ত্বেও শেষ বয়সে এসে তাঁকে মেয়ে-জামাইয়ের আশ্রয়ে থাকতে হবে! প্রথমদিকে তিনি একদমই রাজী ছিলেন না কিন্তু মেয়ে শায়লা জোর করে তাঁকে তাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। নাহলে শাহানারা বেগম তো বলেই ছিলেন যে তাঁর জন্য একটা আয়ার ব্যবস্থা করে দিতে, একা থাকতে কোন অসুবিধাই হবে না তাঁর।
কিন্তু মাকে একা রাখতে শায়লা রাজী হয়নি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই তিনি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছেন। কিছুদিন ভালো সেবাযত্নের প্রয়োজন তাঁর। তাই শায়লা এবং আজিমের যৌথ সিদ্ধান্ত হলো, শাহানারা বেগম তাদের বাড়িতেই থাকবেন আপাতত।
আজিমের সমর্থন পেয়ে ইয়ার্কি মেরে শায়লা বলেছিলো, ‘ এই তো জামাই এর মত জামাই! ‘
আজ আর অফিস নেই। শাশুড়ি কে বাড়ি নিয়ে আসার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার পর আজিম ল্যাপটপটা খুলে মেইল চেক করতে বসলো। হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো! স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠলো, “বজলু ভাই চা”। এই বজলু ভাই হলো, তাদের পুরনো পাড়ার উল্টোদিকের চায়ের দোকানের মালিক।
তার থেকে বয়সে বেশ কয়েকবছরের বড় হলেও অনেকটা বন্ধুস্থানীয়। বজলু ভাইয়ের ফোন ধরবে কি ধরবে না ভাবতে ভাবতে ফোনটা ধরেই ফেললো আজিম।
ওদিক থেকে কিছু একটা শুনে তড়িঘড়ি করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লো সে। যাবার আগে শায়লাকে বলে গেল, একটা বিশেষ কারণে পুরনো পাড়ায় যাচ্ছে সে। অন্যসময় হলে
পুরনো পাড়ার নাম শুনে ভুরু কুঁচকে স্বামীর দিকে ঠিক তাকিয়ে থাকতো শায়লা, কিন্তু আজ মাকে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সে! খেয়ালই যেন করলো না স্বামীর কথা।
পুরনো পাড়া মানে পুরান ঢাকার একটা গলি। সেই গলির শেষ মাথাতে একটা দোতলা ভাঙা বাড়ি, যে বাড়িতে জন্মানো থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত প্রায় বত্রিশ বছর কাটিয়েছে আজিম।
বিয়ের পর গ্রীন রোডে নতুন একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে বৌকে নিয়ে শিফট করে গেছে সেখানে।
তার মা এখানে একা থাকেন। সে পারেনি মাকে তার সাথে তাদের নতুন ফ্ল্যাটে নিয়ে রাখতে। কারণ, শায়লার কড়া আপত্তি আছে।
গাড়িটা গলির মুখে পার্ক করে হেঁটে বজলু ভাইয়ের দোকানের কাছে আসতেই বজলু ভাই বলে উঠলো,
‘ ভালো করেছিস এসে। খালাম্মা তোকে খবর দিতে বারণ করেছিল, কিন্তু মাথা ফাটিয়ে এত অসুস্থ হয়ে পড়েছেন খালাম্মা,তাই আমি উনার কথা শুনিনি। ডাক্তার এসেছিল,ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে, ওষুধ লিখে দিয়েছে। আমি কিনে এনেছি। যা, ঘরে যা। খালাম্মার পাশে তোর ভাবীকে বসিয়ে রেখেছি”।
আজিমের বাবা অনেক আগেই গত হয়েছেন। মাকে একা রেখে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার আগে আজিম বজলুভাই আর তার বৌকে বলে গিয়েছিল, সময়ে-অসময়ে তারা যেন মায়ের একটু খেয়াল রাখে।
সপ্তাহে একদিন অফিস ফেরতা আজিম দেখা করে যায় মায়ের সাথে।
ঘরে ঢুকেই আজিম দেখে, মায়ের মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। সকাল বেলায় বাথরুমে পড়ে গিয়ে অনেকটা ফেটেছে মাথা ! গায়ে বেশ জ্বরও আছে। বজলু ভাইয়ের বৌ আজিমকে দেখেই বলে উঠলো, ‘ মাথায় সেলাই পড়েছে দুইটা। ডাক্তার আগামী দশ দিন খালাম্মাকে কোন কাজ না করে শুধু বিশ্রাম নিতে বলেছে। সবসময় নজরে রাখতে বলেছে। সবচেয়ে ভাল হয়, আপনি কিছুদিন খালাম্মাকে আপনার কাছে নিয়ে যান ভাইজান’।
ভাবীর কথা শুনে উনি চোখ বন্ধ অবস্থাতেই হাত নেড়ে ইশারায় জানিয়ে দিলেন যে, এসবকিছুর দরকার নেই। তারপর খুব ধীরেধীরে আজিমকে বললেন, ‘ বাবা আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না। দু’দিন বিশ্রাম নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে’।
অবশ্য মায়ের জন্যচিন্তা করে যে কোন লাভ নেই সেটা আজিমের চেয়ে ভালো আর কেই বা জানে! মাকে কাছে নিয়ে রাখার ব্যাপারে তার যে অক্ষমতা, সেই বিষয়ে ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল সে! কথাটা শায়লাকে জানালেই তার কাছ থেকে কি উত্তর আসতে পারে সেটা তার জানা আছে।
” দিনরাতের জন্য ভালো একটা আয়া রেখে দাও। খরচ তো তুমিই দেবে! তাহলে আর অসুবিধা কি? বরঞ্চ মা ওখানে থাকলে অনেক রেস্ট পাবেন। এখানে আসলে তো বুবুন সারাদিন জ্বালাবে উনাকে! ” এই তো হবে শায়লার ছকেবাঁধা উত্তর! এতবছর ধরে তো এরকমটাই হয়ে আসছে। ভাবলো আজিম।
বজলুভাইয়ের হাতে কিছু টাকা দিয়ে তার সহায়তায় একজন দিনেরাতের আয়া ঠিক করে নিল আজিম। আর একবার ডাক্তারের সাথে ফোনে কথা বলে রাতে বাড়ি ফিরে গেল আজিম।
বাসায় ঢুকে আজিম ড্রইংরুম থেকেই দেখতে পেল, তার শাশুড়ি বালিশে হেলান দিয়ে আরামে চোখ বুঁজে আছেন। বুবুন পাশে বসে কাগজে কলম দিয়ে কি যেন কাটাকুটি করছে আর সামনে শায়লা চুপ করে বসে আছে। চারপাশ জুড়ে বেশ শান্তি আর স্বস্তির একটা আবহ!
আজিম শাশুড়ির ঘরে ঢুকে তিনি কেমন আছেন জানতে চাইলে শাহানারা বেগম প্রশান্তির সাথে উত্তর দিলেন, ‘ খুব ভালো আছি বাবা। শায়লার যত্নে তো এখনই অতিষ্ঠ আমি! আজিম, তুমি তো আমার জামাতা নও, তুমি আমার ছেলে। তুমি যা করলে, আজকাল নিজের ছেলেও সেটা করে না। আল্লাহর কাছে আমি দোয়া করি, সব মায়েরা যেন তোমার মত জামাতা পায়!
শাশুড়ির মুখে এত প্রশংসা শুনে একটু হেসে আজিম উনার রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
আজিমের ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে সামনের রাস্তাটা দেখা যায়। এখন রাতে রাস্তার পাশের সোডিয়াম বাতিগুলো সব জ্বলছে। একটু আগে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তার দু’দিক দিয়েই গাড়িগুলো বেশ দ্রুতগতিতে নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে। সবারই কেমন যেন ঘরে ফেরার তাড়া!
সিগারেটে একটা টান দিয়ে শাশুড়ির প্রার্থনার রেশ ধরে ধিক্কারের স্বরে আজিম নিজের মনেই বলে উঠলো,
” ইসস্! আমার মা যদি আমার মত একটা জামাই পেতো….”!