রাতভর অঝোর বৃষ্টিতে ভিজে পাতাগুলো পুরোপুরি সজীব আর প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। সূর্যের প্রথম কিরনে চিকচিক করে জ্বলছে সব একসাথে। এদের সাথে পাল্লা দিয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানায় উঠে বসল বাপ্পা। এত ভোরে কখনো ওঠে না সে। কিন্তু আজ তার হৃদয়ে আশার দ্যুতি, বিদ্যুতের ঝলক। পায়ে চপ্পল গলিয়ে সে চিৎকার দেয়,
মা, মা, আমার চা।
ছেলের ডাক শুনে চমকে উঠেন নীলিমা মেহজাবিন। খানিক পরই চা হাতে এসে বলেন,
কি রে, জেগে গেলি যে! ঘুম হয়নি নাকি?
স্মিত হেসে বাপ্পা বলে,
হয়েছে মা। আজ তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙ্গে গেল।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে বাপ্পা মোবাইলে দেখে নেয় পত্রিকার শিরোনাম-
হানা দিয়েছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস।
লকডাউনের মেয়াদ বাড়ল।
বদ্ধ ঘরে অভিনেত্রীর মৃতদেহ।
সিআরবি’তে আধুনিক হাসপাতাল।
সংবাদগুলো বাপ্পার চোখ ছুঁয়ে গেল, কিন্তু মনকে ছুঁতে পারল না। জগতের সমস্ত বিষাদকে ছাপিয়ে প্রত্যাশার আলো আজ তাকে ভর করেছে। বাপ্পা খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুটা পিছনে ফিরে যায়। আনমনে টবের গাছগুলোতে হাত রাখে।
একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে ভালোই চলছিল বাপ্পার দিন। বসের সুনজর, সুন্দরী কলিগ আর নিজস্ব স্মার্টনেস মিলিয়ে অন্যদের ঈর্ষার পাত্র হয়ে উঠেছিল সে। আটপৌরে জীবনের চেয়ে আলাদা কিছু করার গোপন স্বপ্ন উঁকি দিয়েছিল বাপ্পার মনের কোনে। চেম্বার অব কমার্সের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক রাখছিল সে। কিন্তু বিধি বাম হলে মানুষের হাতে থাকেই বা কি? বৈশ্বিক মহামারী করোনা যখন নিউ ইয়র্কে হানা দিলো, কোম্পানীর ভিত যেন নড়ে উঠল। তিন মাসের মধ্যে দারুণ একটি এন্টারপ্রাইজ পাত্তারি গুটিয়ে বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল। আর সেই সাথে বাপ্পাও হারালো তার স্বপ্নের ফানুস।
ঘরে শুয়ে, বসে আর ফেসবুক ঘেঁটে অসুস্থ আর মৃত মানুষের সংখ্যা গোনা ছাড়া আর যেন কিছুই করার ছিল না বাপ্পার। দু’চার জন প্রভাবশালী আত্মীয় স্বজনের দুয়ারে হানা দিতেও তার ব্যক্তিত্বে বাঁধছিল। উপরন্ত মায়ের নজরদারী তাকে মনে মনে অতিষ্ঠ করে তুলছিল। একমাত্র ছেলে পথে বেরুলেই যেন ছোবল মারবে করোনা, এই আশংকায় নামাজ আর তাসবিহ পড়ে মা কেবল রাত দিন তার গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াতে লাগলেন। মনে মনে গুমড়ে মরছিল বাপ্পা। বন্ধুদের সাথে অকারণ ফোনালাপ আর কত করা যায়? কিছুতো করা চাই, যাকে কাজ বলা যায়।
দেখতে দেখতে সাত মাস পেরিয়ে গেল। আচমকা ফোন এলো আবীরের। সেই ছটফটে, দুরন্ত আবীর! একরোখা আর মেজাজী বলে অনেকে তার পাশ কাটিয়ে যায়। বাপ্পার সাথে তত মাখামাখি না থাকলেও স্বাভাবিক একটি সম্পর্ক বজায় রয়েছে। একদিন বারিক বিল্ডিংয়ের মোড়ে মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট হয় আবীরের। যখন তার রক্তের প্রয়োজন পড়ে, এগিয়ে যায় বাপ্পা। সেদিন জ্ঞান ফেরার পর স্মিত হেসে আবীর বলে,
থ্যাঙ্ক ইউ বলবো না, দোস্ত, তবে এই ঋণ শোধ করে দেব।
উচ্চ কণ্ঠে হেসে বাপ্পা বলে,
তুই শালা বদলাবি না।
সেই আবীর ফোন করে যখন বললো, ‘দোস্ত, তোর সিভিটা ঝটপট আমার হোয়াটস অ্যাপে পাঠা,’ এক সেকেন্ড সময় নষ্ট করেনি বাপ্পা। মূলত: এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর সাত জন কর্মী করোনার ছোবলে মারা যায়। সেখানে নতুন লোক নেয়ার খবর পাওয়া মাত্রই আবীর বাপ্পাকে জানায়। অনলাইনে বাপ্পার ইন্টারভিউ নেয়া হয়। যথারীতি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে যায় সে।
আজ বাপ্পার জয়েনিং ডে। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঝিমিয়ে পড়া স্বপ্নগুলোর অস্তিত্ব টের পায় সে। আর পরম মমতায় হাত রাখে টবের কোমল চারাগুলোর গায়ে। ততক্ষণে সূর্য তার সবটুকু তাপ ঢেলে দেয় রাতভর বৃষ্টিতে ভেজা, কর্দমাক্ত পৃথিবীর গায়ে।