টোকি-ও অলিম্পিক।পতাকা বাহক দিয়া সিদ্দিকী-আরিফুল ইসলাম।
উড়লো ‘ সবুজ জমিনে লাল- সূর্য ‘ বাংলাদেশ। বিশ্ব-অঙ্গনে সুরে বাজলো পৃথিবীর দ্বিতীয় শ্রেষ্ট কাব্যিক জাতীয় সংগীত-‘ আমার সোনার বাংলা’। ২০৬ দেশ। ৩৯ রকমের খেলা। গেলবারের রি-ও অলিম্পিকের ছাড়িয়ে এতে সংযুক্ত আরও ০৫ টা নতুন ইভেন্ট।
বৈশ্বিক করোনা অতিমারিতে ২৪ জুলাই – ৯ আগষ্ট,২০২০-এ অনুষ্টিতব্য
অলিম্পিকের শেষতক রং-আলোক তারাবাজি ঝলকানিতে, গীতিকার গায়িকা মিসিয়া’র সংগীত মূর্চ্ছনায় উদ্বোধন হলো ২৩ জুলাই ২০২১-এ। চলেছে ৮ আগস্ট পর্যন্ত। ১১,০৯০ জন প্রতিযোগী খেলোয়াড়। নানা জাতির নানা সংস্কৃতির পরিচায়ক নানা রঙের বাহারি পোশাক পরিচ্ছদ পরা- কতো মুখাবয়ব।
পুরো পৃথিবীর একক খেলাধূলার মঞ্চ। সেরাদের জন্য পুরস্কার-সোনা, রূপা, ব্রোঞ্জ। ব্রোঞ্জ মানে তামা। তামা, শুনতেও কেমন যেন! রুপার মেডেল, তা-ও তেমন মনে ধরে না। মনকে যতই শত বোঝানো- সোফায় বসে খেলা আর মাঠে খেলা এক কথা না। তবুয়ো যখন সোনার পদক, সেখানে আর কী-সে প্রাণ গলবে। হোক সে সোনার হরিণের মতো চপলা- প্রিয়া, মায়াবী। চাই-ই।
দিন যে ভালো যাবে না, বোঝা যাচ্ছিল। সকালে ‘ বাংলা কলা ‘ খেতে গিয়ে ‘আইট্যা কলার ‘ মতো অজস্র বিচি যন্ত্রণা। সোজা সরল জীবন-যাপন পৃথিবীতে বেশি হাইব্রিড গবেষণা চলতে থাকলে যা হয় আর কী। আগের রাতে আবার দাঁতের ফাঁকে মাছের ছোট কাঁটা । অস্বস্তি সারাতে টুথ ব্রাশ নিয়ে বৃথা যুদ্ধ। অগত্যা পাকা মাথা খাটিয়ে মাছের চিকন লম্বা কাঁটা দিয়ে কাঁটা অবমুক্ত। বাঙালির সকল বুদ্ধি-এনসাইক্লোপেডিয়া প্রবাদ প্রবচনে। এই যেমন লেখা-‘ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা ‘।
স্বীকার করতে হয়- শেষতক সব-ই ভাগ্যের খেলা। তবে বাঙালির এই রাশিফল কখনো ভালো ছিল না। তার সাথে আছে মীরজাফরী যোগ। পলাশী প্রান্তরে, ৩২ নম্বর ধানমন্ডী-তে। বাঙালির যত অর্জন, সব রক্তের অক্ষরে লেখা। দুর্ভাগ্য লিখন তো আছেই। নইলে মার্কনি কীভাবে হাতিয়ে নেন জগদীশের বেতার আবিষ্কার কৃতিত্ব!
এও প্রচলিত গল্প- মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের প্রথম আবিষ্কারক জনৈক বাঙালি। কিন্তু নারকেল গাছের তলায় চিন্তামগ্ন থাকার কারণে মাথায় নারকেল পড়ে তিনি বাঁচলেন না। আর এই সুযোগে আপেল কেন নিচে পড়ে- সূত্রের প্রচার প্রচলন। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে জানা গেলো-তাঁরা ইংরেজদের এসব ‘ নিউটনীয় বুদ্ধি ‘ বোঝেন। তাই তাঁদের দেশে কখনো নারকেল গাছ জন্মাতে দেন না। এবার টোকিও অলিম্পিকে দিয়ার ইভেন্টটা নিয়ে ভাবলে রাশি-গণনা, ভাগ্যের ভেলকি মিলে যায়, তীরে এসে স্রেফ বরাত লিপির ফেরে কীভাবে ডুবলো সে আশা-তরী।
অলিম্পিকে অসি চালনা, অশ্বারোহণ, আ্যথলিটের কতো রকমের খেল্। মিলিত সাদা,কালো, লাল বর্ণের মানবজাতির ধারা। কোথায় যেন লেখা-সবুজ, নীল, হলুদ, আরও তিন বরণের মানুষ ছিলো ধরিত্রিতে। কালসাগরে অবলুপ্ত। হয়তো মিলবে অন্য কোথাও, অন্য গ্রহান্তরে। তবে, কবির কথা সত্য মানি- ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল/ ভেতরে সবারি সমান রাঙা’।
ভাবা যায় – এসবই যেন আমাদের ছোটবেলাকার গেইমস্। স্কুলে তখন নিয়ম করে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো। অধ্যাপক পুলিন দে স্যার-প্রধান শিক্ষক। বিশাল ঘাস-কার্পেট পাতা মাঠ জুড়ে চকের দাগে, রং-বেরং ঘুড়ি-কাগজ টাঙিয়ে বিভিন্ন ইভেন্টের নিশানা। স্কুল দীঘিতে চলছে ‘ওয়াটার পোলো’ র হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। তারও আগে সারা ফুটবল টুর্নামেন্ট। সেরা ‘স্কুল ফুটবল টিম’ নিয়ে খেলতে যাওয়া সারোয়াতলি, গাছবাড়িয়া সহ বিভিন্ন স্কুলে।
অলিম্পিকে- কালো, চিকন, বেঁটেরা দৌড়োচ্ছে ট্র্যাকে, ব্যাডমিন্টনে। কই কোনো সমস্যা তো হচ্ছে না তাঁদের! স্বর্ণপদক দিব্যি গলায় ঝুলিয়ে নিচ্ছে। তাহলে সোফা থেকে একবার হাত পা ঝেড়ে আয়নার সামনে বিক্রম নিয়ে দাঁড়াই না কেন বাঙালি! চাইলে এখুনি লিকলিকে শরীরে’ ১০০ মিটার দৌড়ে’, বাতাসে উড়ে ধরনীর দ্রুততম মানব হওয়া যায়। শুধু ‘দৌড়’ প্রতিযোগিতায় ‘উড়ে’ যাওয়াটা ডিসকোয়ালিফাইড দোষ গণ্য না করলেই হয়। আর তা যদি হয়, তার সিংহভাগ কৃতিত্ব দিতে হবে হাবলু-ডাবলু -দের। কিছু করতে চাইলে দু’জনের চারচোখ পেছন পেছন ছুটে আসতো।
যে জিতে জিতুক, অন্তত এ বান্দা যেন কোথাও না জেতে। সুতরাং এরকম পরশ্রীকাতর বাঙালি-ধাক্কায় কতো অলস বাঙালি যে কতো উঁচুতে পৌঁছেছে, তার ইয়ত্বা নেই।
এ কথাও ঠিক, ছোটবয়সে বট-দীঘির ধারে এতো যে ব্যাঙ-হাই জাম্প, মোরগ-লংজাম্প, কাইম-বাটন হার্ডলস, কাদার দলা শর্ট ফুট থ্রো,অলিম্পীয় খেলা, তা এতো সহজে তো মরচে পড়া জং ধরা হয়ে যায়নি ! তাই সহসা প্র্যাকটিসে ঝালিয়ে, দেশের জন্য সগৌরব হলুদ চাকতি উচ্ছ্বাস এখনই নিয়ে আসার আকাঙ্খা বড্ড জাগে। ব্যাপারটা আরও সহজ, যদি আমাদের ডাংগুলি, চাঁড়া খেলা, কানামাছি, হাডুডু অলিম্পিক কমিটি নতুন ইভেন্টে নিয়ে নেয়। তাতে বর্ষার জলে ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে আসা কই, পুঁটি র মতো মেডেল ধরতে থাকতাম আমরা।
অলিম্পিক খেলতে এসেও অনেকের বিশ্বাস দুর্বলতা টেলিভিশন পর্দায় দৃশ্যমান। দৌড়ের আগে কেউ বুকে হাত রেখে, কেউ ক্রস মাথায় ছুঁয়ে, কেউ আকাশে চোখ তুলে যাচ্ঞা চাইছেন। হকির ‘পেনাল্টি কর্নার ‘ঠেকাতে দলের এক মহিলা খেলোয়াড় হাতের আঙুলে যেন লক্ষণ-রেখা টেনে দিলেন গোলপোস্টের সামনে। বিফলে গেলো গুরুজীর মন্ত্র। হজম করতে হলো টাটকা গোল।
অবশ্য চিনাদের এসবের বালাই নেই। তাঁদের শক্তি বাহুবল-বুদ্ধিদল। জানতে ইচ্ছে-দৌড়ে জ্যামাইকানরা কেন এতো বিদ্যুৎ গতির, প্রায় সব ইভেন্টে কেন আমেরিকা, স্বাগতিক জাপানের দৃপ্ত পদচারণা? বিমোহিত চেয়ে থাকা জিমনাস্টিকের অপূর্ব নৈপুণ্য, সুনীল জলকেলিতে সাঁতারুর ক্রীড়া শৈলী। সাথে ‘বিচ ভলিবল’ খেলতে আসা নীল নয়নাদের রূপমুগ্ধতায় ‘ আর কতদূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী ‘ আবৃত্তির ছন্দে একটু পক্ষপাত হেলে থাকা। ক্ষতি কী! রেফারি না টললে হয়।
লক্ষ্য করবার বিষয়-কোটি জনসংখ্যার দেশ,পদক শূন্য। বিপরীতে কয়েকলাখ মানুষের দেশে পদকে ভারি ঝুড়ি । কতো সহস্র প্রতিযোগি একটা পদক নিতে হিমসিম। আর ফেলপসের মতো কেউ একজন হেসেখেলে ডজন মেডেল কুড়িয়ে চলে যাচ্ছেন। স্কুলেও ছিলো একই প্রতিচ্ছবি। বারবার পরীক্ষার খাতায় ‘বদা’ মানে ‘ডিম’ পাওয়া, তাই তাচ্ছিল্য উপাধি ভূষিত ‘বোদাইয়া। সে কিনা হাই জাম্প, লং জাম্প, দৌড়, একসাথে পাঁচ ছয়টা পদক জয় করে চলে যাচ্ছে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি, দন্ত বিকশিত হাসিতে ।
নিন্দুকেরা বলেন- এই ‘ ফেল করার দল ‘ দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করে, সোনা আনে। আর ‘পড়ো পড়ো পড়ো ঠেলাগাড়িতে’ তোলা, চোখে ভারি চশমা আঁটা তারকা সন্তান, ইংরেজি মিডিয়াম ব্রিলিয়ান্টরা দেশের টাকা ‘বেগম পাড়ায় ‘ পাচার করেন, মা- বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠান। তাঁদের অকাট্য যুক্তি – বিদ্যাসাগর, নজরুল, শেরেবাংলা,সত্যেনবোস, বেগম রোকেয়া, ইউনুস কী ইংরেজি বিদ্যালয়ের ছাত্র- ছাত্রী !
এই নিয়ে দশমবার বাংলাদেশের অলিম্পিক যোগদান। দক্ষিণ এশিয়া, এশিয়া ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তবু দেশ কতক স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র পদক নিয়ে সম্মান স্থানে থাকে। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতি ১৮ কোটির দেশে অলিম্পিক মেডেল এখনো অধরা। ১৯৮৪- তে প্রতিযোগী ছিল একজন, গত রিওতে সাতজন, আর এবার ছয়জন। ২০১৬- তে সিদ্দিকুর রহমান প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে অলিম্পিক খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন।
এবারে দিয়া- রোমান সানা ছিল আমাদের তীরন্দাজ তুরুপ। বাংলাদেশ অলিম্পিক সংস্থা, কী-ভাবে সামনের প্যারিস অলিম্পিকের জন্য দেশের ক্রীড়া-যোদ্ধা তৈরি করবে, তাঁরাই ভালো বোঝেন। কিন্তু ক্রীড়া সাংবাদিক ও কোচ ডলি আক্তারের অভিমত- ‘ অলিম্পিক পদক পেতে হলে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে, যোগ্যদের বাছাই করে ইভেন্ট ধরে ধরে দেশে বিদেশে বিশ্বমান প্রশিক্ষণের সুবন্দোবস্ত করে এগুতে হবে’।
বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলাদেশে’ কবে আসবে ‘অলিম্পিক সোনা’!

লেখক : প্রফেসর ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশু স্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।