– একই জামা সপ্তাহে দু’বার পরে কোচিং এ যাবোনা মা।
বাপিকে বলো নতুন জামা কিনে দিতে।
– আচ্ছা মা! তোমরা এত কিপটুস পেরেন্টস কেন?
কোচিং এ নাবিলা কখনো এক জামা দু’বার পরেনা।
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে ইলা।
ইলা সেভেন এ পড়ে। বাওয়া স্কুলে।
বাবা আলী হোসেনের চশমার দোকান আছে জামালখানে। দুই ভাই বোন, মা বাবা আর দাদা মিলে পাঁচজনের সংসার। মেহেদীবাগে নিজেদের ফ্ল্যাট। বেশ চলে যায়।
ইলার মা রিতা আক্তার। পারত পক্ষে ছেলে মেয়েদের কোন চাহিদা অপূর্ণ রাখেন না।
একটা ওয়্যারড্রবের পুরোটা জুড়ে ইলার কাপড়। তবুও তার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এ বয়সেই ম্যাচিং ফ্যাচিং শিখে গেছে। ইউটিউব দেখে দেখে ফ্যাশন বের করে।
স্কুল ড্রেস থাকাতে রক্ষা। কিন্তু প্রতিদিন কোচিং এ তার আলাদা ড্রেস চাই ই চাই। এ নিয়েই মায়ের সাথে রোজ হইচই। শুধু যে ড্রেসের ক্ষেত্রে সমস্যা তা নয়, খেতে গেলেও তার নানান বাহানা। এটা খাবেনা ওটা খাবেনা। কোন সবজি তরকারি ছুঁবে না। প্রতিদিন দেশি চিকেন চাই।
মা অবশ্য মাঝে সাঝে এক আধটু বকাঝকা দেন কিন্তু বাবাটা কিছুই বলবেনা। উল্টো যা চায় তার’চে বেশি এনে দিবে।
মা বলেন লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছে বাচ্চা গুলোকে। দুটো ছেলে মেয়ের হাতেই ট্যাব দিয়ে দিয়েছে বাবা।
কি পড়ল না পড়ল অমনি ট্যাব নিয়ে বসে যাবে।
মেজাজটাও সারাদিন খিটখিটে করে রাখে। একটা কথা একবারের চে দু’বার বললেই বিরক্তি নিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে ওঠে।
ছোট ভাই অনি ও রোবট হয়ে গেছে বলা যায়। কথা বলেনা। সারাদিন আয়না ধরার মতো ট্যাব ধরে থাকে মুখের সামনে। গেমস খেলে। স্কুলের ম্যাম তার মাকে জানিয়েছে, অনি বোর্ডের অক্ষর ঝাপসা দেখে।
এ এক আজব ঘর। ইলার বাবা আলী হোসেন কখন ঘর থেকে বের হন আবার ফিরেনইবা কখন! কেউই খেয়াল করেনা।
বুড়ো দাদু ঘরের এক কোণে বসে তসবিহ জপেন। পত্রিকা পড়েন। বারান্দায় পায়চারী করে সময় কাটান।
বাসায় কথাবার্তা নেই বললেই চলে। আওয়াজ বলতে রান্নাঘর হতে ইলার মা’য়ের চেঁচামেচিই শুনা যায়।
আজ চিৎকারটা খুব কানে লাগে আফজাল সাহেবের।
ইলা কিছুতেই নীল জামাটা পরবেনা। মা চেঁচামেচি করে অস্থির।
আফজাল সাহেব আজ কেন জানি খুব করে খেয়াল করে পুরো ব্যাপারটা। দরোজার কাছে গিয়ে ইলার মাকে বলে,
– বৌ মা, আজ আমি ইলাকে কোচিং এ দিতে যাবো।
শুনে রিতা একটু স্বস্তি পায়। অন্তত একটা ডিউটি কমলো বলে। ইলা অন্য একটি জামা পরেছে। দাদু ভাই অনিকেও সাথে নিতে চাইলো।
ইলার দাদুভাই আফজাল সাহেব। রিটায়ার্ড সরকারী অফিসার। বাসায় শুয়ে বসেই সময় কাটে। আজ বাড়তি দায়িত্বটুকু নিতে পেরে ভালো লাগছে তাঁর।
ড্রাইভার গাড়ি বার করলে আফজাল সাহেব হাত ইশারায় না করেন। সাদা পা›জাবীর পকেট হাতড়িয়ে রুমাল বের করে চশমার মোটা ফ্রেমটা মুছেন।
চলো দাদু ভাই,
আজ আমরা হাঁটতে হাঁটতে গল্প করে করে যাবো।
ইলা আর অনির কাছে ব্যাপারটা ভালোই লাগে।
তারা হাঁটতে থাকে রাস্তার পাশ ঘেঁষে। আফজাল সাহেব অনেকটা ইচ্ছে করেই ফুটপাত ধরে হাঁটছেন।
মেহেদীবাগ হতে শিল্পকলার মোড় হাঁটার দূরত্ব। তবুও ইলা প্রতিদিন গাড়িতেই যায়। বাবা তাকে কোন অবস্থাতেই হাঁটতে দিবেনা। আদরের মেয়ে। রোদে পুঁড়বে কেন?
আজ তার খুব ভালোলাগছে দাদুভাইয়ের সাথে হাঁটতে।
অনির আনন্দটা চোখে পরার মতো। একটু পর পর দাদুভাইকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে অস্থির করে তুলছে।
আফজাল সাহেব ও তার নাতিদের চটপটে আচরণে যারপরনাই মুগ্ধ।
নিজের ফেলে আসা শৈশবের কথা মনে পরে তাঁর।
আহা! কি ছিল সেইসব দিন!
এ পাড়া ও পাড়া দাবড়িয়ে বেড়াত তারা । একসাথে দলবেঁধে পুকুরে ঝাঁপিয়ে জলকেলি করতো দস্যি ছেলের দল।
আজকাল ওসব ভাবা যায়না। ডিজিটাল যুগ। ডিজিটাল মা বাবা আর তাদের ছা পোনারা সারাদিন স্কুল, কোচিং আর মোবাইল ট্যাব নিয়ে থাকে।
চারকোণা যন্ত্রে আটকে আছে তাদের শৈশব।
এদের কোন ছেলেবেলা নেই। এরা কখনো বুঝবেনা পুকুরে সাঁতার কাটার আনন্দ। এমনকি একটা সময় পর এরা জানবেইনা যে, পুকুরে মাছ বলে কিছু থাকে।
আফজাল সাহেব একদিন পাশের ফ্ল্যাটের সবুর সাহেবকে বলতে শুনেছে ।
সবুর সাহেবের নাতিকে তার টিচার নাকি প্রশ্ন করেছিল,
– “ মাছ কোথায় পাওয়া যায়?’’
ছেলেটি নাকি উত্তর দিয়েছিল,
– “ ফ্রিজে’’।
আফজাল সাহেব ভাবে,
ছেলেটিতো মিথ্যে বলেনি!
সেতো তার মাকে বরাবরই ফ্রিজ থেকে মাছ বের করতে দেখে দেখে বড় হচ্ছে।
চার দেয়াল ছাড়া তারতো কোন জগত নাই!
হাঁটতে হাঁটতে গোল পাহাড়ের মোড়ে এসে গেছে তারা। ফুটপাতে একটা মেয়ে আধছেঁড়া জামা গায়ে তার মায়ের সাথে বসে আছে।
মেয়েটির বয়স ইলার মতোই হবে। মায়ের মাথায় উকুন খুঁটছে মেয়েটি। পাশে তার ছোটভাই একটা প্লাষ্টিকের থালায় আলুথালু করে ভাত খাচ্ছে। গায়ে কাপড় নেই।
ইলা ব্যাপারটা খেয়াল করে।
দাদুভাইকে বলে,
– দাদুভাই! ওরা খুব গরিব তাই না?
দাদুভাই মুখ ঘুরিয়ে ইলার দিকে তাকায়, বলে –
– কি করে বুঝলে দাদুমণি?
– ওদের জামা কাপড় ছেঁড়া, নোংরা খাবার খায়,
এসব দেখেইতো বুঝা যায়।
আফজাল সাহেব এবার থমকে দাঁড়ান। পাশের দোকান থেকে দুটো চকবার আইসক্রীম কিনে এগিয়ে দেন ইলা আর অনিকে।
একটু সামনে এগিয়ে যাত্রীছাউনিতে গিয়ে বসে তারা।
অনি আর ইলা মজা করে আইসক্রীম খাচ্ছে।
আফজাল সাহেব বেশ ভালোকরেই জানেন, এ বিষয়টা জানতে পারলে তার বৌ’মা খুব রাগ করবে।
আকারে ঈংগিতে দু একটা কথাও শুনিয়ে দিতে পারে।
রাগ করলে করবে, এই যে, তার নাতি নাতনি দুজন তার সাথে ফুটপাত ধরে হেঁটে হেঁটে আইসক্রীম খাচ্ছে।
এ স্মৃতি তারা বয়ে বেড়াবে। তাদেরতো শৈশব নেই। এটাই তাদের শৈশব।
আইসক্রীম খাওয়া শেষ হলে তিনি তার নাতনিকে বলেন,
– দাদুমণি দেখেছো!
ওদের কোন জামা নেই, খাবার নেই
অথচ দেখো চেহারায় কোন দুশ্চিন্তা ও নেই।
ওরা যখন যা পায়, তাতেই খুশি।
আফজাল সাহেব ইলার মাথায় হাত রাখেন,
– দেখো দাদুমণি,
তোমার অনেকগুলো জামা জুতো,
মজাদার খাবার।
চিকেন ছাড়া খেতে চাওনা,
মা কে কষ্ট দাও,
এটা কি ঠিক?
ইলা কোন কথা বলেনা, কি যেন ভাবে।
দাদুভাই তার মাথায় হাত বুলান।
তার চোখ দুরের ফুটপাতে ছেঁড়া জামার মেয়েটার দিকে।
মেয়েটা হাসতে হাসতে গড়িয়ে গড়িয়ে পরছে মায়ের পিঠে।
ইলার খুব ইচ্ছে হয়, তার মা ও এমন করে তার মাথায় বিলি কাটুক।
আফজাল সাহেব নাতনীর অন্যমনস্কতা খেয়াল করেন।
– দেখ দাদুমণি, আল্লাহ তোমাকে, আমাকে,
আমাদের অনেক ভালো রেখেছেন।
আমাদের খুশি থাকা উচিত।
ইলা তার দাদাভাইয়ের হাত চেপে ধরে।
– আমার খুব ভুল হয়ে গেছে দাদুভাই।
আমি আর মাকে জামা নিয়ে, খাবার নিয়ে
জ্বালাবো না।
আমার যে জামাগুলো পরা হয়না,
ওগুলো আমি ঐ মেয়েটাকে দিয়ে দেবো।
চল দাদুভাই!
আমি আজ আর কোচিং এ যাবোনা,
বাসায় চল।
এক্ষুনি জামাগুলো নিয়ে আসতে হবে।
আফজাল সাহেবের মনটা দারুন ফুরফুরে লাগে।
বিকেলের নরোম হাওয়া তাকে ছুঁয়ে যেতে থাকে।
অনি মনযোগ দিয়ে তার আপুনির কথা শুনছিল। সেও তার দাদাভাইকে বলে,
– দাদাভাই, আমারও কিছু খেলনা আছে।
স্টোর রুমে পরে আছে।
আমিও ওগুলো ঐ ছেলেটাকে দিতে চাই।
আফজাল সাহেব অনিকে বুকে টেনে নেন।
ভাবতে থাকেন, এরা কত কোমল, কাদা মাটির দলা।
আমরাই বরং জটিল। তাদের মনোজগৎ বুঝতে চাইনা।
তাদের সময় দিইনা ।
এই প্রজন্মের মা বাবারা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় শুধু শুধু তাদের বাচ্চাদের বলী দেন।
একেকজন মা বাবা তাদের সন্তানকে জজ, ব্যারিষ্টার, আমলা বানানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে আছেন।
সবার আগে যে, এদের মানুষ বানাতে হবে এ কথা কারোরই মাথায় নেই। নিজেদের না পারাটা সন্তানদের দিয়ে পোষাতে চান।
রাবিশ! একেকজন।
আফজাল সাহেবের দুহাতে হেঁচকা টান পরে।
ইলা, অনি দুজনই টানছে তাদের দাদুভাইকে।
এক্ষুনি বাসায় যেতে হবে।
পা›জাবীর পকেট হাতড়ে সাদা রুমালখানা বের করেন তিনি। ভারী ফ্রেমের চশমাটা বার কয়েক মুছে সোজা হাঁটতে থাকেন।
এবার তিনি শুধুই ফলো করেন। সামনে পথ দেখিয়ে হাঁটে ইলা আর অনি।
আফজাল সাহেবের মুখে তৃপ্তির হাসি। তিনি চান এভাবেই পথ দেখাক তারা।