রিয়ার মোবাইলে রিং বেজেই যাচ্ছে। প্রতিদিন সকালে এলার্ম বেজে উঠলেই সে বিছানায় ওঠে বসে। তারপর চোখ ঘষে এলার্ম বন্ধ করার চেষ্টা করে। হঠাৎ করেই রিয়া অনুভব করে কিছু একটা ভুল হয়েছে।
আরে, আমি এখানে কেন? আমার পাশে এই লোকটি কে? রিয়া চিৎকার করতেই লোকটি পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমাতে থাকলো।
আপনি কে? আমি এখানে কিভাবে এলাম ! যান, এক্ষুনি রুম থেকে বেরিয়ে যান। রিয়া স্মৃতি হাতড়ে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা স্মরণ করার চেষ্টা করছে।
রকি আমাকে বলেছিল, সে আমাকে সারপ্রাইজ দিবে। ও আমাকে এই হোটেলে অপেক্ষা করতে বলেছিল। রকি আসবে তাই আমি অপেক্ষা করছিলাম। ফিউনা আমাকে এক গ্লাস জুস খেতে দিয়েছিল। গ্লাসের জুস পুরোটা আমি ঢকঢক করে খেয়ে নিয়েছিলাম। তারপর আমার সমস্ত শরীর ক্লান্তিতে অবশ হয়ে যাচ্ছিলো। ফিউনা ধরে ধরে আমাকে এই ঘরে নিয়ে এসেছিল।
ঘটনার আকস্মিকতায় এবার রিয়ার চোখগুলো বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে। অনেকদিন থেকে রিয়া মনে মনে সন্দেহ করছিল, তার ভালোবাসার মানুষ, তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু রকি কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। রকি এবং ফিউনার মধ্যে একটা কিছু হচ্ছে এটা রিয়ার সন্দেহ হচ্ছিল। তবু সে কখনো ভাবে নি যে রকি এবং ফিউনা তার বিরুদ্ধে এইভাবে চক্রান্ত করবে।
রিয়া বিছানা থেকে দ্রত উঠে পোশাক পরে নেয়। যখন সে রকি এবং ফিউনাকে খোঁজার উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছিল, তখন তার ঘুমন্ত লোকটির কথা মনে হল। সব ঘটনা মনে হতে, এই লোকটির কোন দোষ সে খুঁজে পেলোনা। রুমের বিছানায় বেশ সুদর্শন এক যুবক ঘুমিয়ে আছে । রিয়া অনুমান করে নিলো লোকটি তার কোন ক্ষতি করেনি। শারীরিকভাবে তাকে হেনস্তা করেনি। রিয়া নিজের হাতব্যাগটা হাতে নিয়ে রুম থেকে চুপচাপ বের হয়ে রাস্তায় নেমে এলো।
সময় নষ্ট না করে সে একটি ট্যাক্সিতে উঠে সোজা রকির বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো। গাড়ি যখন চলছে, রিয়া অনুমান করার চেষ্টা করলো রকির কাছে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে। সে অনেককিছু কল্পনা করছিলো। কিন্তু অবশেষে যখন রিয়া পৌঁছালো এবং নিজের চোখে যা দেখলো সেটা ছিলো তার জন্য বিশাল বড় ধাক্কা।
রিয়ার উপস্তিতিতে ফিউনা হতচকিত হলেও নিজেকে সামলে নিলো,
রিয়া তুমি যখন আমাকে এবং রকিকে এমন অবস্থায় একসাথে দেখেই ফেলেছ তখন আমি তোমার কাছে কিছুই লুকাবো না। তুমি আমাকে বলতে দাও। রকি এবং আমার মধ্যে সম্পর্কটা কোন পর্যায়ের সেটা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছো?
রিয়া ফিউনার দিকে চোখ কটমট করে তাকালো এবং বললো, তোমার কি নিজের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই ফিউনা?
ফিউনা আমতা আমতা করতে লাগলো কিন্তু রেগে গেলো। রেগে কিছুক্ষণ তার মুখ থেকে কথাই সরলো না। রিয়া মুখ ফিরিয়ে রকির দিকে তাকালো। তার চোখ ছোট হতে হতে কপালে গিয়ে ঠেকলো। সে বললো,
রকি তুমি কি চাও? ফিউনা কি তোমার টাইপ?
রিয়ার মুখের উপর হাসি দিয়ে ফিউনা বললো,
আমরা খুব ভালো বন্ধু। রকির সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম।
রিয়া ব্যাঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে বললো,
ফিউনা কিছু কথা কখনোই আমি তোমাকে বলতে চাইনি কিন্তু না বলেও পারছি না। যদিও জানি কথাগুলো তোমার অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, বলতে গেলে শিশু ছিলাম তখন থেকে তুমি যে পোশাকগুলো পরতে সেগুলো ছিলো আমার পুরানো কাপড়। তুমি যে জিনিসগুলো ব্যবহার করতে সেগুলো আমার পুরানো জিনিস ছিলো। এমনকি এখনো পর্যন্ত তুমি আমার ফেলে দেয়া অনেক কিছু ব্যবহার করো। এটা কি মজার ব্যাপার না!
রিয়া একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলে,
এখন দেখে মনে হচ্ছে তুমি আমার ব্যবহৃত পুরুষ রকিকেও পেয়ে যাচ্ছো। আমার যে জিনিসগুলো আর প্রয়োজন নেই তা নিজের জন্য বাছাই করে নিতে তুমি সত্যি বিশেষভাবে পারদর্শী।
রিয়ার কথাগুলো শুনে ফিউনা বিমর্ষ হলো। স্পষ্টতই কথাগুলো তাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। ফিউনার বাবা রিয়াদের পরিবারের গাড়ির ড্রাইভার ছিলো। তবে ফিউনার বাবা আত্ম- সচেতন মানুষ ছিলো। সবসময় সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতো।
রিয়ার মা ফিউনাকে আদর করতেন। মাঝে মাঝে ফিউনা রিয়ার সাথে খেলার অনুমতি পেতো। রিয়ার ব্যবহার করা জিনিসগুলো ভালো মা ফিউনাকে দিয়ে দিতেন। খাবার দিতেন, ঈদে নতুন জামাও কিনে দিতেন। ফিউনার পড়ার খরচটাও তিনিই দিতেন। খুব ভালো মানুষ ছিলেন ভালো মা। রিয়ার মা’কে ফিউনা ভালো মা বলেই সম্বোধন করতো।
রকি রিয়ার কথাগুলো শুনছিলো। এবার সে প্রচন্ডরকম বিরক্ত হয়ে রিয়ার দিকে অভিযোগ ছুঁড়ে দিলো,
রিয়া আমি তোমাকেই সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি। তুমি কি নিজেকে পরিপূর্ণ ভালো মানুষ মনে করো? নিজেকে কি এখনো অভিজাত পরিবারের মেয়ে মনে করো? ভুলে যেয়ো না, তোমার বাবা মারা যাওয়ার পর তোমাদের পরিবার দেউলিয়া হয়ে গেছে। তুমি এখন একজন গরিব ও অসহায় মহিলা। তুমি অনেক বিড়ম্বনার জন্ম দিচ্ছো। ফিউনাকে এত নিঁচু কথাগুলো কিভাবে বললে?গতরাতে তুমি নিজে কি অপকর্ম করেছ তা তো বললে না !
রিয়া বুঝতে পারলো পুরো বিষয়টি রকি এবং ফিউনা খুব পরিকল্পিতভাবে করেছে। রকি বলেছিল চীনের সাথে ব্যবসার ব্যাপারে সে প্রচুর টাকা লস দিয়েছে। রকি চাইতো না ব্যাপারটা তার পরিবারের লোকজন জানুক। তাহলে কি রকি তার ঋণ পরিশোধ করতে আমাকে বিক্রি করে দিয়েছিল ? তবে রাখে আল্লাহ মারে কে! ফিউনা নিজের অজান্তে একটা ভুল করেছে। সে রিয়াকে ভুল রুমে রেখে এসেছিল।
চিন্তা করতেই রিয়ার মেরুদ-ের শিড়দাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। সে তার সামনে থাকা দু’জনের দিকে তাকিয়ে হা হা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
রকি আমি এই ব্যাপারে তোমাকে সব বলবো। জানো, গতরাতে হোটেলের লোকটি খুব সুদর্শন ছিলো। সত্যি তিনি তোমার চেয়ে অনেক বেশি সুইট ছিলো। আমার জন্য এটা অনেক বড় একটা ভালো লাগার অভিজ্ঞতা।
রিয়া জানে রকি খুব অভিমানী ছেলে। সে ভেবেছিল তার মুখ থেকে এ-ধরনের কথা শুনে রকি খুব আহত হবে। যেমনটা প্রত্যাশা করা হয়েছিল, রকির মুখ লাল হয়ে উঠলো। সে রাগে দাঁতের সাথে দাঁত ঘষতে লাগলো এবং আহত বাঘের মতো গোঙাতে লাগলো।
রিয়া বললো, আমি নিশ্চিত তোমরা আরাম করছিলে। আর বিরক্ত করবো না।
তামাশার সুরে কথাটা বলেই সে ঘুরে দাঁড়ালো এবং অহংকারী রাণীর মতন গ্রীবা উঁচু করে হাইহিলে শব্দের ঝংকার তুলে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো।
রিয়া তার রকিকে জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু মনে করতো। দীর্ঘ কয়েক বছরের সম্পর্ক ছিলো রিয়া এবং রকির। অথচ রকি কিনা তার সাথে ছলচাতুরী করলো! মানুষের প্রতি রিয়ার বিশ্বাস হারিয়ে গেছে। মানুষের প্রতি বিদ্বেষ জন্মানোর মূল কারণ রকি আর ফিউনার বিশ্বাসঘাতকতা। রিয়ার চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। ঝাঁপসা চোখে রিয়া পথের কিছুই দেখতে পারছে না।সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে।