বর্ষার বিদায়ের সাথে সাথে ভাদ্রের সূচনায় কোমল সৌন্দর্য ছড়িয়ে শরৎরানী আসে সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে। নির্মল আকাশে সাদা মেঘের সাথে মিতালী হয় কাশফুলের। বাতাসের মৃদুমন্দ দোলায় কাশবন যখন পরম আনন্দে দুলতে থাকে তখনই বাঙালির মন উদার হয়ে ওঠে। প্রকৃতির এমন স্নিগ্ধ কোমল রূপে কবিগুরুর হৃদয় উল্লসিত ও বিমোহিত হয়ে ওঠেন :
” অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া
দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া।’
কোন্ সাগরের ওপার হতে কোন সুদূরের ধন ভেসে যেতে চায় মন,
ফেলে যেতে চায় এই কিনারায় সব চাওয়া পাওয়া।”
(গীতাঞ্জলি ১২)
কবিগুরু বলেছেন “শরতের রঙটি প্রাণের রঙ। অর্থাৎ তাহা কাঁচা, বড় নরম। রৌদ্রটি কাঁচা সোনা, সবুজি কচি। নীলটি তাজা।” (শরৎ-বিচিত্র প্রবন্ধ)

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে সকল ঋতুকে নিয়েই তাঁর সৃষ্টি ভান্ডার পরিপূর্ণ করেছেন। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিতে শরতের বর্ণনাও বন্দনা এসেছে অন্যরকম রুপ মাধুর্য্য নিয়ে । এই শরতের মাঝে তিনি যেন বিশ্বমাতার পরিপূর্ণ রূপ দর্শন করেছেন।
শরতের সকালের মোহনীয় রূপ কবিগুরুকে করেছে বিমুগ্ধ। নীল আকাশ আর শুভ্রতায় জগজ্জননীর প্রতি মুগ্ধ হয়ে তিনি গেয়ে ওঠেন :
” আজি কি তোমার মধুর মুরতি হেরিনু শারদ। প্রভাতে!
হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ
বলিছে অমল প্রভাতে।” (শরৎ-কল্পনা)
বর্ষার মহা- আড়ম্বর, মেঘ গর্জন, গুরুগম্ভীরতা এবং বর্ষণমুখরতার পরেই শরৎ ঋতু যখন নির্মল আকাশ আর শুভ্রতার সাথে মিতালী করে রূপের ডালি নিয়ে আসে তখন বাংলার প্রকৃতি নতুন রূপে সাজতে থাকে। সমস্ত প্রকৃতি জুড়েই যেন অন্যরকম এক আনন্দ। কবিগুরু প্রকৃতির এই সাজে আকুলিত হয়ে গিয়ে ওঠেন-
” আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা।
নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে।
আজ কিসের তরে নদীর চরে চখা-চখির মেলা।” (প্রকৃতি ১৪৩; গীতাঞ্জলি –৮)
শরতের মোহন রূপে বিশ্বকবি প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলে সৃষ্টির উল্লাসে মেতে উঠেছেন। শরৎ বন্দনায় তিনি কাব্যিক উপমায় প্রকৃতির পূজা সেরে ফেলেছেন।
“তোমার মোহন রূপে কে রয় ভুলে জানিনা কি মরণ নাচে,
নাচে গো ওই চরণমূলে
শরৎ আলোর আঁচল টুটে
কিসের ঝলক নেচে ওঠে ” (প্রকৃতি ১৫২)
শরতের আগমনের সাথে শিউলির মন মাতানো ঘ্রাণ। শিউলির বোঁটা করে প্রকৃতি নিয়ে আসে অপরূপ বার্তা। বঙ্গজননী তাঁর সন্তানদের ডালি ভরে শিউলি ফুল উপহার দেয়। অজস্র ঝরা শিউলি আর সাথে শিশির সিক্ত ঘাস। যার রূপ মাধুর্যে আকুলিত হয়ে তিনি লিখেছেন-
” আমার নয়ন ভুলানো এলে,
আমি কী হেরিলাম হৃদয় মেলে,
শিউলি তলায় পাশে পাশে ঝরা ফুলের রাশে রাশে
শিশির ভেজা। ঘাসে ঘাসে অরুণ রাঙা চরণ ফেলে —
নয়ন-ভুলানো এলে।”(প্রকৃতি ১৪৬, গীতাঞ্জলি -১৩)

শরতের ভাব রূপ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম এই গানটি লেখেন-
” আজি শরত তপনে প্রভাতে
স্বপনে কী জানি পরান কী যে চায়। ‘(প্রকৃতি ১৪১)
এই গানটি ” বিভাগ ” রাগে বাঁধা, বাউল অঙ্গের। এতে শরতের বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ দুটো রুপেরই বাণীময় প্রকাশ ঘটে।
শরৎ ঋতুর উপহার কাশফুল। এই ঋতুতে ধবল পালকের মতো কোমল সাদা কাশফুল মনকে শুভ্রতায় ভরে তোলে। রুপালি কাশফুল সোনালী ধানের গুচ্ছ আর সাথে সুরভিত শিউলি ফুল বঙ্গভূমিকে করেছে সমৃদ্ধ। শারদ লক্ষী তাঁর উপহারের ডালা দিয়ে বঙ্গ সন্তানদের আশীর্বাদ করেছে। কবির আহ্বান-
” আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ,
আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা-
নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে
এনেছি ডালা
এসো গো শারদলক্ষ্ণী,
তোমার শুভ্র মেঘের রথে —“(প্রকৃতি ১৪)
শরৎ তারুণ্যকে আর যৌবনকে নবরূপে, নব রঙে রাঙিয়ে দিয়ে যায়। শেফালির বনে মনের আকুলতা বোঁটার রঙে রঙিন হয়ে ঝরে পড়ে।
“ওগো শেফালি-বনের মনের কামনা,
কেন সুদূর গগনে গগনে
আছ মিলায়ে পবনে পবনে।
কেন কিরণে কিরণে ঝলিয়া
যাও শিশিরে শিশিরে গলিয়া।”(প্রকৃতি ১৫০)
কবিগুরু জাগতিক প্রেমের পাশাপাশি প্রকৃতি প্রেমেরও উপাসনা করেছেন। শরৎ প্রকৃতির রূপ তাঁর সৃষ্টির ছোঁয়ায় পরিপূর্ণতা পেয়েছে। তাঁর আকুল আহ্বান—-
“‘এসো শরতের অমল মহিমা,
এসো হে ধীরে।
চিত্ত বিকাশিবে চরণ ঘিরে
বিহতরঙ্গে অকূলে সে দোলে
দিবাযামিনী আকুল সমীরে॥”(প্রকৃতি ১৬১)
শরতের নির্মল আকাশে কখনো মেঘের দর্শন মেলে। আবার এই সময়ে শিশিরে প্রকৃতি নতুন করে জেগে ওঠে
“হৃদয়ে ছিলে জেগে,
দেখি আজ শরতমেঘে॥
কেমনে আজকে ভোরে গেল
গো গেল সরে
তোমার ওই আঁচলখানি শিশিরের ছোঁওয়া লেগে॥
কী-যে গান গাহিতে চাই,
বাণী মোর খুঁজে না পাই।”(প্রকৃতি ১৫৭)
আশ্বিনে শরৎ পায় পূর্ণতা। তাইতো শরৎ পূর্ণতার আর প্রাচুর্যের ঋতু। এই সময় ঘরে মন থাকতে চায় না।
“আজি শরত তপনে প্রভাতস্বপনে
কী জানি পরান কী যে চায়,
ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া
ডাকে বিহগ বিহগী কী যে গায় গো ॥
আজি মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসে,
রহে না আবাসে মন হায়–
কোন্ কুসুমের আশে কোন্
ফুলবাসে সুনীল আকাশে
মন ধায় গো ॥”(প্রকৃতি ১৪১)
শরৎ এলেই শিউলি ফুলের মালার সাথে কাশফুলের আঁচল উড়িয়ে দুর্গা পূজার আগমনী ধ্বনি বেজে ওঠে। প্রকৃতির অপরূপ রূপে দেবীর আহ্বান ধ্বনিত হয়। বিশ্বপ্রকৃতি মাতৃ বন্দনায় মেতে ওঠে । আনন্দে গেয়ে ওঠে-
“শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।
শরৎ তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে,
বনের-পথে লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।”(প্রকৃতি ১৫৩)
এই গানটিতে কবি আগমনীর কথা বলেছেন। আগমনীর আহ্বানে প্রকৃতিতে সুরের দোলা লেগেছে।
“দেখো দেখো, দেখো, শুকতারা আঁখি মেলে চায়
প্রভাতের কিনারায়।
ডাক দিয়েছে রে শিউলি ফুলেরে–
আ য় আ য় আ য়॥”(প্রকৃতি ১৫৯)
এটি শরতের অন্যতম গান ১৩৩২ সালের কার্তিক মাসে লেখা গানটি রবীন্দ্রনাথের ৬৪ বছর বয়সের রচনা। গানটির বাণীতে দেখো দেখো দেখো শব্দটি কবি একবার ব্যবহার করতে পারতেন কিন্তু শব্দটিন তিনবার ব্যবহার করলেন, আমাদের ডাকার আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য। কেবল বাণীতে নয়, দেখো বলা হলো তিনবার সুরে দুলিয়ে দিয়ে। শরৎ প্রভাতে এক আনন্দময় অনুভূতি ব্যক্ত করার জন্য প্রভাতী রাত কালাংড়ার মধুর সুর সমষ্টি। আবার স্থায়ী অন্তরা ও আভোগ “আয় আয় আয়” তিনবার আহ্বান যখন ধোঁয়ার মতো ধরিয়ে দিচ্ছে আকুলতা। (রবীন্দ্রনাথের ছয় ঋতুর গান ও অন্যান্য -অরুণ দাশগুপ্ত)
“মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি। আহা, হাহা, হা।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি। আহা, হাহা, হা ॥ (প্রকৃতি ১৪২)
এই গানটিকে আমরা শরতের অন্তরঙ্গ রূপের বর্ণনা পাই।
শরতে বর্ষার বৃষ্টি ধারা এবং তার সাথে মেঘমুক্ত নির্মল প্রকৃতির শোভা এক অপরূপ সৌন্দর্যের অবতরণ করে। তাই শরৎ রাণীর এই ঐশ্বর্যময় সৌন্দর্যে কবি প্রবল আবেগে উদার কণ্ঠে বন্দনা করেন-
“নির্মল কান্ত, নমো হে নমো, নমো হে, নমো হে।
স্নিগ্ধ সুশান্ত, নমো হে নমো, নমো হে, নমো হে।”(প্রকৃতি ১৬৬)
শরতেও যে বর্ষার প্রবল আধিপত্য থাকে সেটাও উঠে এসেছে আশ্বিনের ক্ষ্যাপা শ্রাবণে-প্রবল বৃষ্টি ধারা ঝরে তাই বর্ষার মতই মানুষের মন উদাস হয়ে দিশেহারা হয়।কখনো নির্মল আকাশে পাগলা হাওয়ার দাপটে হঠাৎ করে শ্রাবণ যেনো নতুনরূপে আবির্ভূত হয়। কবিগুরু এমন রূপের বর্ণনা দিয়েছেন-
“কোন্ খেপা শ্রাবণ ছুটে এল আশ্বিনেরই আঙিনায়।
দুলিয়ে জটা ঘনঘটা পাগল
হাওয়ার গান সে গায়॥
মাঠে মাঠে পুলক লাগে
ছায়ানটের নৃত্যরাগে,
শরৎ-রবির সোনার আলো উদাস
হয়ে মিলিয়ে যায়॥”(প্রকৃতি ১৫৫)
শরতের নির্মল প্রকৃতিতে যোগ হয় আশ্বিনের নব আনন্দ উৎসব। সেই আনন্দে চতুর্দিকে উদ্ভাসিত হয় শতধারায।।দুর্গোৎসব নিয়ে কবি বলেছেন–
” আমাদের শরতের আগমনী ধুয়া। সেই ধুয়াতেই বিজয়ার গানের মধ্যেও উৎসবের তান লাগিল।—- বার বার নূতন করিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে বলিয়াই চলিয়া যায়।– তাই সকল উৎসবের বড়ো উৎসব এই হারাইয়া ফিরিয়া পাওয়া উৎসব।”( শরৎ- বিচিত্র প্রবন্ধ)
” আশ্বিনে নব আনন্দ, উৎসব নব।
অতি নির্মল, অতি নির্মল, অতি নির্মল উজ্জ্বল সাজে
ভুবনে নব শারদলক্ষ্ণী বিরাজে।”
শরৎ প্রভাতের অপরূপ বর্ণনা পাই কবিগুরুর লেখায়। শরতের অরুণ-আলো প্রকৃতিতে পূর্ণ রূপ দান করেছে। সেই আলোয় উদ্ভাসিত হয় মনের অন্ধকার গলি। অবসাদ গ্রস্থ মনেও নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়।
“শরত-আলোর কমলবনে
বাহির হয়ে বিহার করে যে ছিল মোর মনে মনে॥
তারি সোনার কাঁকন বাজে
আজি প্রভাত কিরণ-মাঝে
হাওয়ায় কাঁপে আঁচলখানি–
ছড়ায় ছায়া ক্ষণে ক্ষণে॥”(প্রকৃতি ১৫১)
শরতে মন আকুল ও চঞ্চল হয়ে ওঠে ।পাগলা হাওয়ায় মন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। শরতের প্রকৃতির কারণে মন যখন উদাস হয়ে যায় তখন কবির কিছুই ভালো লাগেনা। পাগলা হাওয়া গান গেয়ে যায় আর সেই গান আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। কবির মন তখন সেই সুরে আবিষ্ট হয়ে যায়। কবির আকুলতা-
“তোমরা যা বলো তাই বলো, আমার লাগে না মনে।
আমার যায় বেলা, বয়ে যায় বেলা কেমন বিনা কারণে॥
এই পাগল হাওয়া কী গান-গাওয়া
ছড়িয়ে দিয়ে গেল আজি সুনীল গগনে॥”
প্রকৃতির মাঝে কবিগুরু জীবনের বেদনার সুর খুঁজে পেয়েছেন-
“আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে।
বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে।”
শরতের আগমনের সাথে প্রকৃতিতে আসি নতুনের আহ্বান। এই আহবান সুন্দরের আহ্বান-
“কার বাঁশি নিশিভোরে বাজিল মোর প্রাণে
ফুটে দিগন্তে অরুণকিরণকলিকা ॥
শরতের আলোতে সুন্দর আসে,
ধরণীর আঁখি যে শিশিরে ভাসে,
হৃদয়কুঞ্জবনে মুঞ্জরিল মধুর শেফালিকা ॥”(প্রকৃতি ১৬৪)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের দুঃখ কষ্ট আর বেদনা কে জয় করার কথা বলেছেন। দুঃখ কষ্ট আর বেদনাকে ভুলে আর আনন্দকে সাথী করে জীবনের জয়গান করতে বলেছেন
” আনন্দেরই সাগর হতে এসেছে আজ বান।
দাঁড় ধ’রে আজ বোস্ রে সবাই, টান রে সবাই টান॥”(বিচিত্র ৪৯)
শরৎ প্রভাতের অপার সৌন্দর্য বিশ্বপ্রকৃতিকে করেছে অপরূপ ।সৌন্দর্য পুষ্প পল্লবী সুশোভিত। মন আনন্দে উঠে-
“আজ প্রথম ফুলের পাব প্রসাদখানি, তাই ভোরে উঠেছি।
আজ শুনতে পাব প্রথম আলোর বাণী, তাই বাইরে ছুটেছি॥”(প্রকৃতি ১৪৯)

আশ্বিনের প্রভাতে শিউলি বনে যখন মৌমাছিরা ডাকে তখন ফুলের সৌরভে আর ঘরে থাকা যায় না। মনোজগৎ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করে-
“আমারে ডাক দিল কে ভিতর পানে–
ওরা যে ডাকতে জানে॥
আশ্বিনে ওই শিউলিশাখে
মৌমাছিরে যেমন ডাকে
প্রভাতে সৌরভের গানে॥”(বিচিত্র ১৯)
শরৎ কে আহবান জানানোর জন্য ‘এসো শরতের অমল মহিমা’ ভাব সঙ্গতির দিক থেকে একটি অনুপম গান।১৩২৯ সালে লেখা এ গানটি রবীন্দ্রনাথ ‘শেষ বর্ষণ’ রূপক নাটক থেকে নেয়া হয়। মাত্র পাঁচটি চরণের সুমিত বাণীতে শরতের বর্ণনা অপূর্ণ গভীরতায় বর্ণিত হয়েছে। রাবীন্দ্রিক টপ্পা অঙ্গের একটি গান গাইতে আমরা পাই রাগ সঙ্গীতের সুর বিস্তারিত পরিবেশ। আশাবরী রাগের এই গানটি তাল মুক্তভাবে। সুরের এমনই স্বচ্ছন্দ বিরাজ যাতে ঘটে শরতের অমল মহিমার বিকাশ।
“এসো শরতের অমল মহিমা, এসো হে ধীরে।
চিত্ত বিকাশিবে চরণ ঘিরে॥
বিরহতরঙ্গে অকূলে সে দোলে
দিবাযামিনী আকুল সমীরে॥(প্রকৃতি ১৬১)
‘শারোদৎসব’ রবীন্দ্রনাথের ঋতু নাটকের মধ্যে একটি অনন্য ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নাটক।এই নাটকটিতে কোন নায়ক নায়িকা নেই ,কোন জয়-পরাজয় নেই ,আছে কিছু কথা কিছু গান। গানের মধ্য দিয়ে নাটকটির মূল ভাব ফুটে উঠেছে-
“আজ বুকের বসন ছিঁড়ে ফেলে দাঁড়িয়েছে এই প্রভাতখানি।
আকাশেতে সোনার আলোয় ছড়িয়ে গেল তাহার বাণী।”(প্রেম ও প্রকৃতি ৬২)
১৩১৫ সালে লেখা ‘শারদোৎসব’ নাটকটির নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করা হয় ‘ঋণশোধ’।বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎ ঋতুর বর্ণনা করেছেন। সৌন্দর্য ও মহিমা দিয়ে যাতে যোগ হয় তার সৃষ্টির অমীয় সুধা।শরতের অন্তর্নিহিত তথ্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন “শরত জগত আনন্দের ঋণ শোধ করে”।তিনি শরতের রূপ মহিমা বর্ণনা করতে গিয়ে একদিকে প্রকৃতি প্রেম, ঈশ্বর প্রেম ও অন্যদিকে জাগতিক প্রেমের সমন্বয় করেছেন। প্রকৃতি ও মানব জীবনের অপার রহস্য তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। তাইতো শরৎ আমাদের কাছে রুপের রানী বিজয়ালক্ষী আর উৎসবের ঋতু। অপরূপ সুর,ছন্দ আর লয়ে তিনি শরৎ ঋতুর বর্ণনা করেছেন। কখনো হাসি, কখনো কান্না, আর কখনো মনের বেদনা এবং আকুতি ফুটে উঠেছে-
“তোমার নাম জানি নে, সুর জানি।
তুমি শরৎ-প্রাতের আলোর বাণী॥
কিসের ভুল রেখে গেলে আমার বুকে ব্যথার বাঁশিখানি॥”(প্রকৃতি ১৬৩)