‘আম্মু, এই আম্মু,… শোনো না একটু।’
ভেজা হাতটা শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে ছেলের রুমের দরজায় দাঁড়ালেন লতিফা বেগম। ঐটুকুই তাঁর সীমা। ছেলে এখন বড় হয়েছে, অনুমতি ছাড়া এখন ছেলের ঘরে ঢোকা বারণ।
‘ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো।’
ছেলের বলার পরেও একটু ইতস্তত করেই ঘরে ঢুকলেন লতিফা বেগম। সারা ঘরময় বইপত্র, জামা- প্যান্ট,এটা-সেটা সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সুমন নিজেও কিছু গুছিয়ে রাখেনা আবার মাকেও কিছু তে হাত দিতে দেয় না। এতে নাকি তার প্রাইভেসি নষ্ট হয়!
নীচে পড়ে থাকা শার্ট-প্যান্টের ফাঁকে ফাঁকে কোনোরকমে পা ফেলে শুয়ে থাকা ছেলের বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালেন লতিফা বেগম।
‘বল, কি বলবি? অনেক কাজ পরে আছে আমার ‘।
মোবাইল থেকে মুখ সরিয়ে মায়ের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে সুমন বলে, ‘ ইস্! কি ন্যাতা মার্কা একটা শাড়ি পরেছো তুমি! এভাবে হবেনা।তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে এসো আম্মু।’
‘শাড়ি চেঞ্জ এখন? কেন? কি হবে না? ‘ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন লতিফা বেগম।
‘একটা ছবি তুলবো তোমার’। ‘দৃষ্টিটা মোবাইলে রেখেই উত্তর দিল সুমন।
‘আমার ছবি? কেন রে? ‘ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন লতিফা বেগম।
‘আজ মাদারস ডে। আমার গ্যালারিতে তোমার একটা কোন ছবিই নেই যে পোস্ট দেবো! যাও তো, চট করে চেঞ্জ করে এসো। দেরি কোরোনা।’
‘তোর ফোনে আমার ছবি থাকবে কি করে? তুলেছিস কখনো আমার বা তোর বাবার কোন ছবি’? ক্ষুব্ধ কন্ঠ লতিফা বেগমের।
‘এই তো! শুরু হয়ে গেলো তো তোমার সেন্টিমেন্টাল সব কথাবার্তা! সময় আর পেলেনা তো? আম্মু প্লীজ, এখন এসব না করে যেমনটা বললাম সেটাই করো। ফ্রেন্ডরা সবাই তাদের মায়ের সাথে ছবি পোস্ট করে দিয়েছে। আমিই মনে হয় লাস্ট।’
ছেলের সাথে আর কোন কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে ফিরে গেলেন লতিফা বেগম।
আজ তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি।
সুমন তখন তিন বছরের। সকাল থেকেই সামান্য গা গরম ছিল লতিফার প্রাণভোমরা ছোট্ট সুমনের। ওর বাবাকে সাথে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধপত্র আনা হলো। রাত তখুন প্রায় দশটা। ছেলের শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! ওষুধে কাজ হচ্ছে না। এদিকে সুমনের বাবার সেদিন ছিল আবার নাইট ডিউটি। গেন্ডারিয়ায় যে বাড়িতে তারা ভাড়া থাকতো সেই বাড়ির বয়স্ক বাড়িওয়ালা সুমনের অবস্থা দেখে বললেন, ‘ আম্মাজি, রাত তো বাড়ছে, এদিকে তোমার ছেলের জ্বরওতো কমছে না। তাই আমি বলি কি, তুমি আর অপেক্ষা না করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাও। একাই তো যেতে হবে তোমায়। আমি নিজে অসুস্থ না হলে হয়তো তোমার সাথে যেতে পারতাম। কিন্তু তাওতো হবার নয়। তাই তুমি আর দেরি করোনা।’
বাড়ি থেকে প্রায় অনেকটাই দূরে হাসপাতাল। অতো রাতে রিকশা না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে লতিফা বেগম খানিক হেঁটে, খানিক দৌড়ে, পরবর্তীতে একটা রিকশা পেয়ে তাতে করে সুমনকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন। যদিও ততক্ষনে জ্বরের তীব্রতায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল ছোট্ট সুমন।
অসুস্থ সন্তানের জন্য মায়ের আহাজারি আর অসীম আকুতির জন্যই আল্লাহ লতিফার দোয়া কবুল করেছিলেন বলেই হয়তো সে যাত্রায় বেঁচে ফিরেছিল সুমন।
পড়াশুনা শুরু হবার পর থেকে লতিফা বেগমকে সর্বক্ষণ সুমনের পাশে থাকতে হতো। আম্মু পাশে বসে না থাকলে সুমনের পড়া হতো না। পরীক্ষার দিনগুলোতে সুমন যখন অনেক রাত জেগে পড়তো, তখনও পাশে বসে থাকতেন লতিফা বেগম। সারাদিনের খাটাখাটুনির পর রাতে দু’ চোখ বুজে আসতো তাঁর, কিন্তু ঘুমের কাছে হার মানতেন না তিনি। ঠায় বসে থাকতেন!
সেই সুমন এখন বাইশ বছরের। অনেক বড় হয়ে গেছে। এখন আর কথায় কথায় মাকে দরকার হয়না।
এই তো বছর দু’য়েক আগের একটা ঘটনা। তখন সুমন কলেজে পড়ে। কিছুদিন পরেই ছিল তার ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল। মাঝরাতে লতিফা বেগমের হঠাৎ ঘুম ভাঙলে ডাইনিংরমে গিয়ে দেখেন, সুমনের ঘরে লাইট জ্বলছে। ছেলে পড়ছে নাকি লাইট জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে সেটা দেখার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলেন ছেলের ঘরের দিকে। ভেজানো দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকতেই সিগারেটের তীব্র গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারে লতিফা বেগমের। এমন অসময়ে মাকে দেখে সুমন প্রথমে খানিক ঘাবড়ে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে রাগত সুরে মাকে বললো, ‘আম্মু, তুমি এত রাতে এখানে কি করছো?’
‘না, তোর ঘরে এত রাতে আলো জ্বলছিল দেখে আর কি… ‘ আমতা আমতা করতে লাগলেন লতিফা বেগম।
‘আলো জ্বলছে দেখেই রুমে ঢুকে গেলে? একবার নক করার প্রয়োজনও মনে করলে না ‘?
বাকরুদ্ধ অবস্থা তখন লতিফা বেগমের! ছেলের ঘরে ঢুকতেও নক করতে হবে মাকে?
মাকে চুপ করে থাকতে দেখে সুমন আবার বললো, ‘আম্মু, তোমার তো বোঝা উচিত যে, আমি এখন বড় হয়েছি। একটা প্রাইভেসি আছে আমার। না বলে এমন হুটহাট আমার ঘরে আর ঢুকবে না। এই বলে রাখলাম আজ’!
বেশ একটা রাগত সুর ছেলের কথায়!
না, তারপর থেকে গত দু’ বছর বিনা অনুমতিতে ছেলের ঘরে আর ঢোকেন নি লতিফা বেগম।
সারাবছর ধরে যে ছেলের কাছ থেকে অপরিচিতের মত ব্যবহার পেয়ে থাকে সেই ছেলে আজ
‘মাদারস ডে’ তে একটা পোস্ট দেয়ার জন্য মায়ের ছবি তুলতে চাইছে?
কই? কোন মা তো পারেনা ছেলেমেয়েদের ভালোবাসার জন্য কোন দিন নির্ধারণ করতে?
মায়েরা তো প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত ভালোবেসে যান সন্তানদের! তাহলে মায়েদের বেলাতেই কেন এই নিয়ম?
আচ্ছা, মাকে ভালোবাসার জন্য কেন নির্ধারিত কোন দিন থাকবে?
মা তো মা ই! জন্মদাত্রী মাতো স্রষ্টার সমতুল্য। স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য যদি কোন দিনক্ষণের প্রয়োজন না হয়, তবে মাকে ভালোবাসতে কেন বিশেষ কোন দিনের প্রয়োজন হবে? বছরের প্রতিটা দিন সন্তান যেমন মায়ের ভালোবাসা পায়, তেমন সন্তানেরও কি উচিত নয় তার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসাময় প্রতিটা দিন মায়ের নামে উৎসর্গ করে দেয়া?
শুধু ভাবছেন আর ভাবছেন লতিফা বেগম! ভেবেই চলেছেন!