আজ অনেক বছর পর দুর্গাপুজোর সময় গ্রামের বাড়িতে এলাম। এ দশটা বছর প্রাণপণে চেষ্টা করেছি এ বাড়িটাকে ভুলে থাকতে। কিন্তু বাস্তবে পেরেছিলাম কি! এবারও আসতে চাইনি। মা বাবা জোর করে নিয়ে এলেন। কারণ সামনের মাসে আমার বিয়ে। বিয়ের আগে সব আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করিয়ে নেওয়ার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। কারণ আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজোর সময় সব আত্মীয়ের মিলনমেলা ঘটে। কিন্তু আসার পর থেকেই আমার কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে চোখের সামনে দশবছরের আগের স্মৃতিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠছে। কাউকে বলতে পারছি না কিছু,কিন্তু নিজে নিজে কেমন দিশা হারিয়ে ছুটছি। ছুটছি তো ছুটছি,শুধু অতীতপানেই ছুটছি।কেমন একটা ভয় আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে অমল যেন আমার আশেপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।আর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
অমল, বেশ মিষ্টি একটা ছেলে। সম্পর্কে আমাদের আত্মীয় হয়। আমার বড় পিসীর ভাসুরের ছেলে। দশবছর আগে শেষবারের মতো যখন বাড়ি এসেছিলাম,তখন ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। ওরা খুলনা থাকতো,তাই এর আগে আমাদের সাথে ওর কখনো দেখা হয়নি। সেবারই প্রথম দেখা। সে এসেছিল তার কাকীর সাথে অর্থাৎ আমার পিসীর সাথে। ওর মা বাবা আসেননি। বাড়িতে পৌঁছে প্রথম ঘরে ঢুকতেই অমলের ওপর চোখ পড়েছিল আমার। ও অবাক হয়ে আমাকে দেখছিল। ওর ওই দৃষ্টিতেই আমার কিশোরীচোখ অপার মুগ্ধতা দেখেছিল। ১৮/২০ বছরের মিষ্টি এ ছেলেটাকে আমারও খুব ভালো লেগেছিল। লম্বা ছিপছিপে ফিগারের ঘন চুলের অধিকারী অমলের চোখ দুটো ছিল ওর সেরা সম্পদ। সত্যি কথা বলতে কি আমি মজে গিয়েছিলাম ওর দুটো চোখে।
পুজোর হৈচৈ পুরো বাড়ি জুড়ে। মেজপিসী,ছোটপিসীরাও এসেছিল।তাই লোকজনের ভিড়ে নিরিবিলি জায়গা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবুও আমরা এত লোকের ভিড়েও কীভাবে যেন চোখে চোখে নিজেদের কথা সেরে নিতাম। কী আর কথা তখন! অমল হয়তো ইশারা করতো আমাকে বাইরে বেরুবার জন্য। আমি সেটা বুঝে নিতাম। তারপর কোনো এক ফাঁকে বাইরে বেরিয়ে এলে অমল একফাঁকে আমার হাতে দুটো চকলেট কিংবা অল্প শিউলি ফুল গুঁজে দিয়ে চট করে সরে যেতো। আর আমি ওইটুকু উপহারে বিশ্বজয়ের আনন্দ নিয়ে সারাবাড়ি ছুটে বেড়াতাম। আমার বয়স ছিল তখন ১৬ বছর।সেবছর পুজোটা যেন আমার জীবনে একরাশ আনন্দ নিয়ে এসেছিল। এ প্রথমবার আমি কিছুক্ষণ পর পর আয়নায় নিজেকে দেখছিলাম। আসলে আমি নিজেকে নিজে দেখছিলাম না,অমলের চোখ দিয়েই নিজেকে পরখ করছিলাম। আমার অবস্থা হয়েছিল নার্সিসাসের মতো। নিজের রূপে নিজেই যেন বিহ্বল হচ্ছিলাম। নিজেকে এত ভালো লাগার নেপথ্যে ছিল অমল। অমল আমার চারপাশের পৃথিবীটাকেই রঙিন করে তুলেছিল।
আমরা পঞ্চমী তিথিতেই বাড়ি গিয়েছিলাম। পিসীরাও এসেছিল একই দিনে। আগেই বলেছি বাড়িতে পৌঁছে প্রথমেই চোখ পড়েছিল অমলের ওপর। কী মিষ্টি ছেলেটা। প্রথম দেখাতেই আমরা হয়তো পরস্পরের প্রেমে পড়েছিলাম। তাই দুদিন আমাদের অনবরত চোখে চোখেই কথা হচ্ছিলো। সবাই পুজো নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল আমাদের কা-কীর্তি কারো চোখেই পড়লো না। আমাদের বয়সটাই ছিল প্রেমে পড়ার বয়স। অমল আমাকে এতটা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে অন্য কোনোদিকে আমার খেয়ালই ছিল না।
সপ্তমীদিন দুপুরে খেয়েদেয়ে সবাই যখন একটু বিশ্রাম নিচ্ছে,তখন আমি চলে গেলাম পুকুরঘাটে। আমি কি মনে মনে চাচ্ছিলাম এই নিরিবিলিতে অমল আসুক। ওই বয়সে হয়তো তাই চাচ্ছিলাম। নাহলে ঘরের মধ্যে বেসিন ওয়াশরুম থাকার পরেও আমি মুখ ধোওয়ার অজুহাতে পুকুরপাড়ে গেলাম কেন! শান বাঁধানো ঘাটে বসে আমি শান্ত পুকুরটাকে দেখছিলাম। হঠাৎ কে এসে যেন পেছন থেকে আমার চোখ চেপে ধরলো। আমি চিৎকার করে উঠলাম,
-কে? কে?
আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো অমল,
-আমি। আমাকে চেনো তুমি?
তীব্র ভালোলাগায় আমি কেঁপে উঠলাম।লজ্জা এবং ভালো লাগা দুটো একসাথে ভর করলো আমার ওপর। আবেশ জড়ানো কণ্ঠে বললাম,
-হুম,চিনি তো। তুমি আমার স্বপ্ন।
অমল চোখ ছেড়ে দিয়ে আলতো করে আমার দুকান ছুঁয়ে বললো,
-উঁহু,স্বপ্ন না,বাস্তব।
কানে অমলের আলতো পরশ পেয়ে আমি আবারও কেঁপে উঠলাম। অমল আমার পাশঘেঁষে বসে আমার কোমরে আলতো করে হাত রাখলো।আমার সারা শরীর শিহরিত হলো। থরথর করে কাঁপছিলাম আমি।এত ভালো লাগছিল,মনে হচ্ছিলো আমিও অমলের কোমরটা জড়িয়ে ধরি। অমলের বুকে নিজেকে সঁপে দিতে ইচ্ছে করছিল। আমার কী দোষ! আমার বয়সটাই তো তখন ওরকম। আর বেশিক্ষণ থাকলে কী হয় না হয় আমি চট করে উঠে গেলাম এবং অমলের চুলগুলো টেনে দিয়ে ছুটে পালাতে চাইলাম। অমল চিৎকার করে বললো,
-আরে! আরে! পালাচ্ছো কই? আমি তো ভেবেছি তোমাকে নিয়ে এ পুকুরে আজ সাঁতার দেবো।
আমি ভেংচি কেটে ছুটে পালালাম।
এর আগে অমল কখনো আমাকে ছোঁয়নি। ফুল কিংবা চকলেট দেবার সময় হাতে যতটুকু স্পর্শ লাগতো ততটুকুই। আজ চোখে,কানে, কোমরে ওর স্পর্শ আমার শরীরে আগুন ধরিয়ে দিলো যেন। পুকুরঘাট থেকে ফেরার পর কিছুতেই তার সামনে যেতে পারছিলাম না। কী এক লজ্জা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। অষ্টমীদিন সকাল থেকে পালিয়ে পালিয়ে রইলাম। ও কিন্তু সারাক্ষণ আমাকে অনুসরণ করছিল। কিন্তু আমি কিছুতেই তাকে ধরা দিচ্ছিলাম না। দূর থেকে চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিলাম সে খুব কাতর হয়ে রয়েছে। কিন্তু কী এক লজ্জায় আমি কিছুতেই তার সামনে যেতে পারছিলাম না।
নবমীদিন সকাল থেকে অমল অস্থির হয়ে রইলো। খাওয়ার সময় বার বার করুণচোখে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। ভাবলাম ওকে আর কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। ছেলেটা খুব কাহিল হয়ে পড়েছে। আর বেশি কষ্ট দিলে হয়তো রাগ করে চলেই যাবে। তাই খাওয়ার পর ইচ্ছে করে ঘরে গেলাম না। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সোজা পুকুরঘাটে গিয়ে বসে রইলাম। খুব করে চাচ্ছিলাম অমল আসুক। কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও যখন অমল এলো না তখন মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। মনে হলো অমল বুঝি সত্যি আমার ওপর রাগ করেছে। যখন উঠে যাবো ভাবছি,তখনই পেছন থেকে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো অমল,তারপর দুকান ধরে মাফ চাওয়ার ভঙ্গি করে আমার পাশে এসে বসলো। মুখ টিপে টিপে হাসছিলো ও।
বুঝতে পারলাম ও আরও আগেই এসেছে। নিজেকে আড়ালে রেখে দেখছিল আমি কী করি!এত সুন্দর লাগছিলো ওকে, ইচ্ছে করছিলো ওকে জড়িয়ে ধরতে। ও কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে হেসে যাচ্ছিলো। ওকে হাসতে দেখে আমার তীব্র অভিমান হলো। মনে হলো এই বুঝি আমি কেঁদে দেবো।
অমলও বুঝতে পেরেছিল আমার অভিমান। তাই এতটুকুও সময় না নিয়ে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে আমার ঠোঁট দুটো নিজের ঠোঁটের ভেতর পুরে নিলো। ভয়ে আমি শক্ত হয়ে গেলাম। এরকম প্রকাশ্যে দিনে দুপুরে অমল যে এমন কা- ঘটাতে পারে,তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। পুজোবাড়ি,সারা বাড়িভর্তি লোকজন। কখন কে এসে পড়ে তার ঠিক নেই।আমি ওকে ধাক্কা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। হঠাৎ ধাক্কাতে টাল সামলাতে না পেরে ঘাটের পাশ দিয়ে অমল পুকুরে ছিটকে পড়লো। কেউ আসার আগে আমি ছুটে পালালাম। তারপর সোজা দোতলায় উঠে মায়ের পাশে শুয়ে পড়লাম।
বিকেলে ঘুম ভাঙলো হৈচৈ আর পিসীর বিলাপে।প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না,ছুটে গেলাম নিচে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারতে পারছিলাম না। আমাদের উঠোনে পাটির উপর শুইয়ে রাখা হয়েছে অমলকে। সবাই হাহুতোশ করছে। পিসী বিলাপ করছে এই বলে যে তাঁর সাঁতার না জানা ভাসুরপোটা কী কারণে পুকুরে গেলো তিনি তো জানলেন না,ঘরে তো বেসিন, বাথরুম সব আছে। ও কেন পুকুরে গেলো! আর পুকুরে গিয়ে জলেই বা কীভাবে পড়লো! এখন তিনি তার মা বাবাকে কী জবাব দেবেন!
অমল পুকুরে ডুবে মরেছে? ও সাঁতার জানতো না? তাহলে যে আমাকে বলেছিলো আমাকে নিয়ে সে পুকুরে সাঁতার কাটতে চায়! তবে কি সে মিথ্যে বলেছিল? আমার মাথা কাজ করছিলো না। অমলকে তো পুকুরে ধাক্কা আমি মেরেছিলাম। শানবাঁধানো ঘাটের পাশ দিয়ে ও ছিটকে পড়েছিলো পুকুরে। ওই জায়গাটাতে পানির গভীরতা থাকে বেশি। সাঁতার জানতো না বলে ও থই পায়নি জলে।আমি কি নিজহাতে অমলকে খুন করলাম! মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠেছিল আমার। তারপর আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরেছিল তখন দেখলাম আমি মায়ের খাটে শুয়ে আছি। আমাকে ঘিরে মা বাবা মেজ পিসী ছোট পিসী বসে আছে। সব মনে পড়লো আমার। বললাম,অমলদা কোথায়? সবাই ডুকরে কেঁদে উঠলো। ছোট পিসী বললো,-
-অমলকে নিয়ে তোর বড় পিসী এবং কাকারা রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে। ওদের বাড়িতেই ওর দাহ হবে।
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম সবার দিকে। অমল সত্যি সত্যি মরে গেছে? আমি তাকে মেরেই ফেললাম? নিজের অন্তর্দহনে নিজে পুড়ে মরলেও কাউকে কিন্তু বলতে পারলাম না অমলের মৃত্যুরহস্য।
এরপর আমাকে নিয়ে মা বাবা শহরে চলে এসেছিল। আমি অনেকদিন স্বাভাবিক হতে পারিনি। তবে সত্যটাও কাউকে জানাতে পারিনি। এরপর থেকে পুজো এসেছে বার বার। বাড়ি আসার কথা বললে আমি প্রতিবারই বেঁকে বসেছি।যার ফলে মা বাবারও আর বাড়ি আসা হয়নি।আজ দশ বছর পর আবার বাড়িতে এসেছি আমি। তাও আসতাম না যদি সামনের মাসে আমার বিয়ে না হতো।কিন্তু আসার পর থেকে অমল আমার পিছু ছাড়ছে না। এতবছর পর কী চায় ও আমার কাছে? ও কি আমার কাছে কৈফিয়ত চাইতে এসেছে? ওকে এখানে মেরে রেখে আমি যে নিজের সংসার সাজাতে যাচ্ছি এখানেই কি ওর ক্ষোভ! এখনো পর্যন্ত কেউ জানে না অমলের মৃত্যুরহস্য। শুধু আমি জানি। অমল কি চায় সবাই ওর মৃত্যুরহস্যটা জানুক। আমি কি তবে সবাইকে বলে দেবো আসল কাহিনি? তাহলে কি অমল আমার পিছু ছাড়বে? জানি না,আমি কিচ্ছু জানি না। শুধু জানি আমি অমলের ওই দৃষ্টি সহ্য করতে পারছি না। ও সারাক্ষণ আমার পাশে পাশে ঘুরছে,আর আমার দিকে তাকিয়েই আছে। এমন ঘটতে থাকলে আমি তো পাগলই হয়ে যাবো। আমাকে বলতে হবে, সব বলতে হবে। ধীরে ধীরে আমি পা বাড়াই বৈঠকখানার দিকে,যেখানে মা,বাবা,পিসী, পিসেমশাই সবাই রয়েছে।