বাঙালীর কাছে উৎসব মানেই আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সকলেই একজায়গায় একত্রিত হওয়া। আমাদের দেশের সংস্কৃতির অনন্য বৈশিষ্ট্য হল,প্রত্যেকটি ধর্মীয় উৎসবে অন্য ধর্মের মানুষের আন্তরিক অংশগ্রহণ। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। রামচন্দ্র রাবন বধের জন্য অকালে শরৎকালে দেবীর পূজা করেছিলেন।তখন থেকে এর নাম হয় অকালবোধন বা শারদীয় দুর্গাপূজা।
ছোটকালে পূজাকে ঘিরে বিশেষ পরিকল্পনা করে রাখতাম। কোনদিন কোন জামা পরা হবে সেটাই সবচেয়ে বেশি চিন্তার বিষয়। বাঁশ, খড়,কাঠ দিয়ে প্রতীমার প্রাথমিক কাঠামো, এরপর কাদামাটির প্রলেপ।প্রতীমা তৈরির ক্ষুদ্র পরিবর্তন ও মিস করা যাবে না।তাই স্কুলে যাওয়া আসার পথে দিনে দুইবার করে চুটিয়ে প্রতীমা দেখতে যেতাম।প্রতীমা রং করা মানে পূজা অতি সন্নিকটে।এখন সাংসারিক জীবনে শত ব্যস্ততার মাঝে পূজা নিয়ে আগের মত সেই পরিকল্পনা আর নেই।এখন বাড়ির ছোট বড় সবার আনন্দে আমি আনন্দিত।
মহালয়ার দিন থেকে মূলত দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।মহালয়ার ছয়দিন পরই দেবীর বোধন হয়।সেভাবেই সবাই প্রস্তুতি নেয়।কিন্তু এবার মহালয়ার ৩৫ দিন পর দেবীর বোধন। মহালয়ার ৩৫ দিন পর দুর্গাপূজার কারণ হল,দুটি অমাবস্যা একই মাসে পড়েছে। শাস্ত্রমতে দুটি অমাবস্যা একই মাসে পড়লে তাকে মল মাস বলা হয়।সেই হিসেবে এবার আশ্বিন মাস মল মাস।মল মাসে কোন পূজা এবং শুভ অনুষ্ঠান করা যায় না।তাই এবার দেবীর পূজা হবে কার্তিক মাসে।অর্থাৎ শরতে নয় হেমন্তে।শারদীয় উৎসব হলেও তা হবে হৈমন্তিক। ১৭ সেপ্টেম্বর মহালয়া ছিল এর ৩৫ দিন পর অর্থাৎ ২২ শে অক্টোবর হবে দেবীর বোধন । তবে এই প্রথম নয় ১৯৮২ ও ২০০১ সালে ও একই কারণে মহালয়া ও দুর্গাপূজার ব্যবধান একমাস হয়েছিল।
সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়।এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে মহাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী এবং বিজয়া দশমী নামে পরিচিত।
“মহাপঞ্চমীতে” প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে প্রতিমা আনার ধুম পড়ে যায়।”মহাষষ্ঠীতে”মায়ের আবাহন, আমন্ত্রণ, অধিবাস এবং বোধন। বোধন শব্দের অর্থ জাগরণ। কারণ শ্রাবণ থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত সূর্যের দক্ষিণায়ন কাল।দেবতাদের রাত্রিকাল। এই কালে দেবতাদের পূজা করতে হলে জাগরণ প্রয়োজন। তাই শরৎকালে দুর্গাপূজায় দেবীর বোধন করতে হয়।নুতন জামা আর শিউলির গন্ধে প্রকৃতি অন্যরুপে সজ্জিত হয়। “মহাসপ্তমীতে”
নবপত্রিকা (নয়টি পাতাসহ গাছ বা গাছের ডাল, এগুলো ঔষধি এবং দেবীর একেকটি রুপের প্রতীক) স্নান করা হয়। আত্মীয় -স্বজন, বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে আড্ডা, খাওয়া দাওয়া সবকিছু মিলিয়ে পূজার আনন্দে অন্য মাত্রা যোগ হয়। “মহাষ্টমীতে”সন্ধিপূজা করা হয়।সন্ধি শব্দের অর্থ মিলন।অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট, এই ৪৮ মনিট সন্ধি পূজার জন্য নির্দিষ্ট। এই দিনে তন্ত্রশাস্ত্রমতে অনধিক ষোলো বছরের অরজ:স্বলা কুমারী মেয়ের পূজা করা হয়। কুমারী পূজার মাধ্যমে নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়।১৯০১ সালে ১৮ ই অক্টোবর স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতার বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপূজায় অষ্টমী তিথিতে কুমারী পূজার প্রবর্তন করেন। “মহানবমী “এই দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় মনখারাপের পালা।হোমযজ্ঞের মাধ্যমে পূজার পূর্ণাহুতি দেওয়ার রীতি আছে।ঘরের মেয়ে ফিরে যাওয়ার পালা।আনন্দ মলিন হয়ে যায় বিদায়ের সুরে।অবশেষে “বিজয়া দশমীতে” সিঁদুর খেলা বিসর্জন সবকিছু মিলিয়ে চোখের জলে পূজার পরিসমাপ্তি ঘটে।আশা থাকে আগামী বছর আবার ফিরে আসবে ঘরের মেয়ে।
কোভিড ১৯ মহামারীর কারণে এবারের দুর্গোৎসবে কোন আড়ম্বর থাকছে না।বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের বিভিন্ন নির্দেশনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মন্দিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা,বাধ্যতামূলক মাস্ক পরিধান করা,দর্শনার্থীদের জন্য তিনফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, সবধরনের আলোকসজ্জা এবং প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রা পরিহার করা।মঙ্গলময়ী মায়ের কাছে একটাই প্রার্থনা, করোনামুক্ত পৃথিবী।