সাত বছর ধরে নুর কাজ করে যাচ্ছে তালুকদার সাহেবের বাসায় ।নুর স্বভাবে শান্তশিষ্ট হওয়াতে তালুকদার সাহেবের স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে নুরকে খুব পছন্দ করে।নুর সকাল নয়টার মধ্যে কাজে চলে আসে, কাজ শেষ করে নুরের নিজের বাসায় ফিরতে বিকেল হয়ে যায় ।বাসায় গিয়ে আবার বাসার কাজ সামাল দেয় নুর ।নুরের দুই মেয়ে এক ছেলে। নুরের স্বামী প্রায় সময় অসুস্খ থাকে।কাজ কর্ম তেমন করতে পারে না, একদিন কাজ করলে তিন দিন শুয়ে বসে কাটায় । নুর কাজ করে সংসার চালায় ।নুরের বড় মেয়ে পাশের বাসার পাশার এক ছেলেকে ভালোবাসে।
নুরের মেয়ের এসব কথা আশেপাশের মানুষজন জেনে যায় , তাতে নুর খুব লজ্জাবোধ করে ।দুই পরিবারের আলাপ আলোচনায় ছোট অনুষ্ঠান করে নুরের মেয়ের বিয়ে হয় ।নুরের ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী , ছোট মেয়েটি স্কুলে পড়ে । নুরের খুব ইচ্ছে কষ্ট করে মেয়েকে এসএসসি পর্যন্ত হলেও পড়াবে।
বাসায় প্রতিবন্ধী ছেলে, স্বামী অসুস্থতার জন্য কাজ করতে পারে না তেমন এ সব নিয়ে নুর চিন্তিত থাকে প্রায় সময়।তবুও নুর কাউকে বুঝতে দেয় না। মুচকি হাসি যেন ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকে নুরের।
মাসের অনেকটা সময় নুরের স্বামী বাসায় শুয়ে বসে কাটায় ।সংসার খরচের সমস্ত দায়িত্বই ধরতে গেলে নুরের।তালুকদার সাহেবের বাসায় কাজ করে নুর সাত হাজার টাকা বেতন পায়।তালুকদার সাহেবের বাসায় মেহমান আসলে নুরের কাজ বেশি পরে যায় , তখন তালুকদার সাহেবের স্ত্রী নুরকে আলাদাভাবে বকশিষ দেয়। নুর তাতে ভীষণ খুশি প্রকাশ করে এবং আন্তরিকতার সাথে নুর সবসময় কাজ করে ।রোজার ঈদে নুর এবং নুরের পরিবারের সকলের জন্য কাপড়-চোপড় ও ঈদের বকশিস দেয় তালুকদার সাহেবের স্ত্রী ।কোরবানীর ঈদেও প্রতিবছর নুরকে তালুকদার সাহেবের স্ত্রী বেশি করে মাংস দেয় কারণ নুর অন্য কোন বাসায় কাজ করে না এবং কারো কাছে মাংস চাইতেও যায় না। কেউ খুশি মনে দিলে তা নেয়।এবারের কোরবানীর ঈদে নুরের বাড়তি চিন্তা কারণ মেয়ের বাসায় মাংস রুটি দিতে হবে ।প্রতিবছর কোরবানীতে নুরের প্রতিবন্ধী ছেলে ও মেয়েরা মাকে বলে, মা আন্টিকে বলিও আমাদের জন্য বেশি করে মাংস দিতে তাহলে আমরা অনেকদিন মাংস খেতে পারবো ।ছেলেমেয়ের কথা শুনে নুর হেসে বলে, আমি বাসা থেকে আসার সময় তো তোমাদের আন্টি (ম্যামসাহেব) মাংস রান্না করলে তোমাদের জন্য তো অল্প হলেও দেয় আল্লাহর কাছে শোকরিয়া করো ।বেশি মাংস তো দেয় তোমাদের জন্য তবুও তোমাদের কথা গিয়ে তোমাদের আন্টিকে বলবো। নুর ছেলেমেয়ের কথা এসে তালুকদার সাহেবের স্ত্রীকে বললে তালুকদার সাহেবের স্ত্রী হেসে বলে ঠিক আছে দিবো বেশি করে ।নুরের ছেলেমেয়ে প্রতিবছর বলতে বললেও নুরের আর প্রতিবছর সে কথা এসে তালুকদার সাহেবের স্ত্রীকে বলতে হয় না । প্রথম এক দুই বছর বলার পর তালুকদার সাহেবের স্ত্রী নুরকে মাংস বেশি করে দেয় যেন ছেলেমেয়ে নিয়ে কয়েকদিন খেতে পারে।
তালুকদার সাহেবের স্ত্রী নুরকে বলে , আমি তো জানি নুর তুই আর কোথাও কাজ করিস না।আর খুঁজতে যাওয়াও তোর ছেলেমেয়েকে শিক্ষা দিসনি, তাই তোর কথা মনে থাকে আলাদাভাবে ।তালুকদার সাহেবের স্ত্রীর কাছে পুরানো কাজের মানুষ , কাছের দূরের গরীব আত্মীয়-স্বজন আসে মাংস নিতে ।কাউকে তালুকদার সাহেবের স্ত্রী নারাজ করে না । যারা আসে তাদের সবাইকে সাধ্য মত সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে ।তালুকদার সাহেব স্ত্রীকে বলে , আল্লাহ আমাদের তৌফিক দেওয়াতে আমরা বড় গরু কোরবানি দিতে পারছি ।আল্লাহ চাইলে সব পারেন ।আজকে যে গরীব আল্লাহ চাইলে ,সে চেষ্টা করলে একদিন না একদিন সেও নিজে কোরবানি দিতে পারবে ।তালুকদার সাহেব স্ত্রীকে আরো বলে , আমরা সারাবছর বাজার থেকে মাংস কিনে খাচ্ছি কিন্তু গরীবরা তো তা পারে না ।তাই আমরা ফ্রীজ ভরায় না রেখে যারা কোরবানি করে না তাদের মাঝে সাধ্যমত বণ্টন করে দিবো ।বিশেষ করে বাসায় যারা কাজ করে আর গরীব আত্মীয়ের দিকে বেশি নজর দিতে হবে ।এ নীতি তালুকদার সাহেব এবং তালুকদার সাহেবের স্ত্রী প্রতিবছর পালন করে আসছে এবং সবসময় এমনই করার ইচ্ছে তাদের ।নুর এমন বাসায় কাজ করতে পেরে নিজকে ধন্য মনে করে ।নুর জানে এ বছর মেয়ের বাসায় রুটি মাংস দিতে হবে তাই ম্যামসাহেব নিশ্চয়ই মাংস বাড়ায় দিবে ।তবুও নুর লজ্জা লজ্জা ভাবে বললো, ম্যামসাহেব এবার কোরবানিতে একটু মাংস বাড়ায় দিয়েন মেয়ের বাসায় রুটি মাংস দিতে হবে তো তাই।তালুকদার সাহেবের স্ত্রী বললো, আমি জানি নুর মেয়ের বাসায় দিতে পারিস মতই দিবো চিন্তা করিস না ।মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পর মেয়ের শ্বশুড়বাড়ী গরু দেওয়া, ছাগল দেওয়া বড়লোকদের কাছে এটা নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরাও এ নিয়মের শিকার আর যারা দিনে এনে দিনে খায় তাদেরও এ নিয়মের কারণে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সেক্ষেত্রে নুরের ভাগ্য ভালো ।নুরের মেয়ের জামাই এবং তাদের পরিবার কোন কিছু দেয়া নিয়ে নুরের মেয়েকে কথা শোনায় না ,তবুও নুরের ইচ্ছে মেয়ের শ্বশুর বাসায় নিজের সাধ্যমত যে সময় যা দেয়ার সব দিবে, তাতে মেয়ের মনটা যেন খুশি থাকে ।সবার ভাগ্য সবসময় নুরের মত হন না।শ্বশুর বাড়ি থেকে কোরবানীর গরু ছাগল না পেয়ে অনেক স্বামী স্ত্রীর উপর নির্যাতন চালায়, অপমান করে ।শিক্ষিত ও অশিক্ষিত উভয় ক্ষেত্রে এসব হয়ে থাকে এ যেন মানবিকতার অভাব।একজন নুর পড়ালেখা না জেনেও নিজে শারীরিক পরিশ্রম করে সংসারের দায়িত্ব পালন করে হাসি মুখে। ছেলেমেয়েকে শিক্ষা দেয় অন্যের কাছে হাত পেতে কিছু না চেয়ে যেন পরিশ্রম করে নেয়।একজন নুর সারাদিন তালুকদার সাহেবের বাসায় পরিশ্রম করেও হাসিমুখে থেকে নিজ সংসারের দায়িত্ব পালন করে ।একজন নুর অতি অভাবের মাঝেও সন্তানদের পড়ালেখার কথা ভাবে , সন্তানদের সুশিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করে। একটি প্রতিবন্ধী ছেলে নুরের, তাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তা নুরের। তবুও নুর ভেঙে পরে না, ছেলে যেন দু’মুঠো খেয়ে বাঁচতে পারে সেজন্য ছেলে করতে পারবে আস্তে আস্তে এমন কাজ শেখানো ইচ্ছা নুরের।একজন সংগ্রামী ও পরিশ্রমী নুর হাজারো নুরের প্রেরণা।