অরুণ দাশগুপ্ত। বর্ষীয়ান সাংবাদিক, নিষ্ঠাবান প্রাবন্ধিক, মেধাবী গবেষক, বিরলপ্রজ কবি ও গুণী সাহিত্য সম্পাদক। জ্ঞানে পাণ্ডিত্যে অভিজ্ঞতায় একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব। সৃজনশীল ও মননশীল জগতের একজন অনুকরণীয় পুরুষ। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগীত, রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাস, ঐতিহ্য– এমন কোনো দিক নেই যে তিনি জানতেন না। সব বিষয়ে ছিলো সমান অবগত ও আগ্রহ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ৮৫ বছর বয়সেও তিনি তাঁর কর্মে সক্রিয় ও লেখালেখিতে নিবেদিত ছিলেন। দৈনিক আজাদীতে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে মৃত্যুর আগের মাসেও তাঁর দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন অত্যন্ত সুচারুরূপে। এছাড়া সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন সুদীর্ঘকাল। কয়েক বছর আগে ২০১৫ সালে, কাগজে-পত্রে অবসরে গেলেও আজাদী সম্পাদক জনাব এম এ মালেক তাঁকে ধরে রেখেছিলেন নিজের কাজের সঙ্গে, সর্বোপরি আজাদীর সঙ্গে। অসুস্থ হয়ে পড়লে অরুণ দাশগুপ্ত অবস্থান নিয়েছেন তাঁর গ্রামের বাড়িতে, চট্টগ্রামের পটিয়ার ধলঘাটে। যেখানে ১৯৩৬ সালের ১লা জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সেই ধলঘাট থেকে তিনি তাঁর লেখা নিয়মিত লিখেছেন এবং অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন। অসুস্থ হওয়ার আগেও ধলঘাটে তিনি সচল ছিলেন। তখন নিজের হাতে সম্পাদকীয় লিখতে পারছিলেন না ঠিকই, কিন্তু তাঁর ডিরেকশনে অন্য একজন কপি করে দিয়েছেন, আর সেগুলো ওখান থেকে পাঠিয়ে দিতেন আজাদীতে। আজাদী কর্তৃপক্ষ সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্তের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করেছেন, তা এক কথায় প্রশংসনীয়। তাঁদের শ্রদ্ধাশীল মনোভাবের কারণে আমরাও নত হই শ্রদ্ধায়।
ব্যক্তিগতভাবে অনেকে অনেক কিছু প্রত্যাশা করে। কেউ অর্থ, কেউ প্রভাব-প্রতিপত্তি, কেউ ক্ষমতা, কেউ সম্মান। আমি মনে করি, সম্মানপ্রাপ্তি সৃষ্টিকর্তার অপার দান। এই সম্মানটুকু পেয়েছেন আমাদের দাদামণি অরুণ দাশগুপ্ত। তিনি যেমন সবার ভালোবাসা পেয়েছেন, তেমনি পেয়েছেন অনেক সম্মান।
লেখক হিসেবে তিনি যতটা খ্যাতিমান, এ জনপদে লেখক সৃষ্টিতেও তিনি ছিলেন ততটা উদার। লেখকদের প্রাণিত করতে এবং লেখায় নিবেদিত কর্মীদের উৎসাহিত করতে তিনি অতুলনীয়। চট্টগ্রামে একটি ‘সাহিত্যমানসম্পন্ন সমাজ’ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসামান্য।
জানা যায়, পটিয়ার ধলঘাটে পাঠশালার হাতেখড়ি অরুণ দাশগুপ্তের। তারপর চলে যান কলকাতায়। সেখানে কালাধন ইনস্টিটিউশন, সাউদার্ন থেকে মাধ্যমিক এবং স্কটিশচার্চ কলেজ কলকাতা থেকে উচ্চ মাধ্যমিক। তারপর বিশ্বভারতী লোক শিক্ষা সংসদ। কলকাতার দৈনিক লোকসেবক পত্রিকার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা- জীবন শুরু তাঁর। এর পর চলে আসেন দেশে। স্বাধীনতার পর কিছু দিন অন্যদিকে কাজ করেন। পরে ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা দৈনিক আজাদীতে যুক্ত হন সহ সম্পাদক পদে। তখন থেকেই সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের লেখকরা তাঁর কাছে ঋণী। তবে যেভাবে তিনি লেখালেখি করেছেন, লেখক-বয়স দীর্ঘ হলেও তাঁর বইয়ের সংখ্যা খুবই কম, যা তাঁর অনুরাগীদের পীড়ার কারণ। তিনি সৃষ্টিতে যেমন উদারহস্ত, কিন্তু বই প্রকাশে ছিলেন ততটা অনাগ্রহী। মাত্র দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। সেগুলো হলো, ‘রবীন্দ্রনাথের ঋতুর গান ও অন্যান্য’ এবং ‘যুগপথিক কবি নবীন চন্দ্র সেন’।
অরুণ দাশগুপ্তের লেখা ‘রবীন্দ্রনাথের ঋতুর গান ও অন্যান্য’ গ্রন্থটির ভূমিকায় শিক্ষাবিদ ড. অনুপম সেন লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের ঋতুর গান ও কবিতা সীমাহীন সুন্দর। সুর বাণীতে এবং বাণী সুরে মিলেমিশে আমাদের দু’চোখে দেখা বিভিন্ন ঋতুর দিনগুলো অন্তরের চোখে ও কানে অপরূপ রূপে ও মাধুর্যে মূর্ত হয়েছে তাঁর গানে; কীভাবে, তা’ই বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করেছেন কবি অরুণ দাশগুপ্ত তাঁর এই ঋদ্ধ গ্রন্থে।’
অরুণ দাশগুপ্ত নিজে লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালির মূল্যাতীত সম্পদ। অনন্য সংগীত¯্রষ্টা তিনি। রবীন্দ্রনাথের তুল্য কম্পোজার পৃথিবীর সংগীতের ইতিহাসে বিরল। সঙ্গীতস্রষ্টা হিসেবে তিনি বিটোফেন ভাগনার, মোজার্ট, সেবাস্টিয়ান বাখ, হান্ডেল, চাইকফস্কির সঙ্গে তুলনীয় হলেও সংগীতের নৈর্ব্যক্তিক চরিত্রকে ব্যক্তিক করেছেন তিনি। সংগীতের বিমূর্ততাকে মূর্ত করা ও সুরের মানবায়ন ঘটানোতে তাঁর তুল্য কোনো সংগীতস্রষ্টা খুঁজে পাওয়া দুস্কর। রবীন্দ্রনাথ অত্যুৎকৃষ্ট সুর ও অত্যুৎকৃষ্ট কবিতাকে মিলিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতো সংগীতের মানবায়ন আর কেউ ঘটাতে পেরেছেন কিনা সন্দেহ। রবীন্দ্রনাথের ঋতুর গানগুলোর দিকে নজর দিলে আমরা সেটা অনেকটা বুঝতে পারি। গানের বাণী ও সুরের এমন যুগল সম্মিলন রীতিমত বিস্ময়কর।’
যুগপথিক কবি নবীনচন্দ্র সেন অরুণ দাশগুপ্তের দ্বিতীয় গ্রন্থ। গ্রন্থ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘বাংলা কবিতায় উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি রেনেসাঁসের নান্দীপাঠ করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রংগলাল বন্দোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় ও নবীন চন্দ্র সেন। মধুসূদনের সাহিত্যে উনিশ শতকীয় রেনেসাঁসের যে ঢেউয়ের দোলা এসে লেগেছিল এবং তার ফলে তাঁর সাহিত্যে যে নতুন জীবনবোধ ও চেতনার রূপায়ন ঘটে চট্টগ্রামের কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁরই উত্তর সাধক। …. শুধু কবি হিসেবেই নয়, বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি সাহিত্যক্ষেত্রেও নবীন চন্দ্র প্রভূত বিস্তারে সমর্থ হয়েছিলেন। পরিতাপের বিষয় নবীন চন্দ্রের কোনো গ্রন্থ বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। বাংলা একাডেমি বা কোন প্রকাশনা সংস্থা আজ পর্যন্ত নবীন চন্দ্রের কোনো গ্রন্থ প্রকাশ করে নি। অমর একুশের উপলক্ষে বাংলা একাডেমি জীবনী গ্রন্থমালা প্রকল্পের অধীনে ১৯৯৫ সালে একটি ক্ষুদ্র কলেবরের গ্রন্থ প্রকাশ করেছে মাত্র। তারই কারণে যুগ পথিক কবি নবীনচন্দ্রের ওপর একটি গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হলো।’
এই প্রবন্ধগ্রন্থ দুটি আমাদের প্রকাশনা ও প্রবন্ধসাহিত্য অঙ্গনে অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে নিঃসন্দেহে। এর বাইরে তাঁর অনেকগুলো পরিচয়ের মধ্যে মূল পরিচয় হলো তিনি কবি। অজস্র কবিতা লেখা হলেও কবিতার কোনো বই বের হয় নি তাঁর। যদিও তাঁর কবিতা অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা। আত্মগত ভাবনা আর অন্তর্গত বেদনার ছায়াচিত্র তাঁর কবিতার অবয়বে ধরা দিয়েছে। সাধু ভাষায় রচিত হয়েছে তাঁর অনেকগুলো কবিতা। বলা যায়, প্রচলিত নিয়মরীতিকে উপেক্ষা করে তিনি আলাদা এবং নিজস্ব প্রকরণ রীতির উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করেছেন কবিতার ভুবন। বিষয় বৈচিত্র্য আর বিচিত্র ভাবনার সৃজনশক্তিতে তিনি ছিলেন সপ্রাণ।
অধ্যাপক অভীক ওসমান দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে তাঁর কবিতার মূল্যায়ন করেছেন এভাবে : ‘অরুণ দাশগুপ্ত কবি। কবিদের কারিগর। ‘তিনি মূলত কবি। অন্তর্লোক অবলোকন করেন কবিতায়। তার ভাষীরীতি ও আঙ্গিক ধ্রুপদ মার্গেও কথা স্মরণ করিয়ে দেয় প্রতিমুহূর্তে। শব্দ ও বোধ যোজনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্নস্বরের কাব্যকলা নির্মাণে সচেষ্ট রয়েছেন তিনি। তৃতীয় বোধনের স্ফুরিত কবিতায় তিনি মানবিক আকুলতা আর যাপিত জীবনের স্বপ্নকথা বলেন রূপকথার আঙ্গিকে। ঋদ্ধ জীবনবোধ কবিতাকে আপাত দুর্বোধ্যতায় আকীর্ণ করছে বলে মনে হলেও স্বীকার্য সত্য এই যে, তাঁর কবিতা নিবেশ অভিনিবেশ দাবী করে এবং বোধের অন্য জগতে দূরগামী অভিযাত্রী করে অনুরাগীকে। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় তার কোনো কবিতার বই নেই।’(একজন অরুণ দাশগুপ্ত, দৈনিক আজাদী, ২২ মার্চ ২০২১)।
খুব কাছাকাছি থাকার কারণে দাদামণিকে আমি নানা সময়ে বিরক্ত করেছি। নিজের লেখালেখি, পেশাগত দায়িত্ব পালন এবং সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে তিনি আমাকে সহযোগিতা করেছেন আন্তরিকভাবে। আমার ‘শ্রেষ্ঠ কিশোরকবিতা’ গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রেও তিনি পালন করেছেন ভূমিকা। কেননা, আমার সব কবিতাই আমার কাছে প্রিয়। তারপরও ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ অভিধা নিয়ে প্রকাশক অক্ষরবৃত্ত প্রকাশন যে গ্রন্থ প্রকাশ করতে চাইছে-তাতে কোন্ কোন্ কবিতা স্থান পেতে পারে, তা নিয়ে আমি দ্বন্দ্বে পড়ি! অবশেষে আমি এ বিষয়ে আত্মসমর্পণ করলাম এবং দ্বারস্থ হলাম আমার শ্রদ্ধেয় সাহিত্যব্যক্তিত্ব কবি অরুণ দাশগুপ্তের। আমার সমস্ত কবিতা দাদার হাতে তুলে দিয়ে বললাম -এখান থেকে শ’ খানেক কবিতা বাছাই করে দিতে। ছোটো করে একটা ভূমিকা লিখে দিতেও অনুরোধ করলাম। দাদা আমার জন্য অনেক কষ্ট করলেন। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করছি তাঁর অবদান। ২০১৯ সালে দাদার ভূমিকাসমেত প্রকাশিত হলো এই বইটি।
অরুণ দাশগুপ্তের মৃত্যুতে আমাদের সংবাদপত্র ও সাহিত্যাঙ্গনে যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে, তা অপূরণীয়।