চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ ছিলেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। এদেশের সামাজিক শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এ যাবত যে সব ব্যক্তি সোচ্চার হয়েছেন অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ তাদের একজন।
অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদের জন্ম ১৯১৪ সালের মার্চ চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে। শৈশবে গ্রামের বাড়িতে মক্তবে ও মাইনর স্কুলে তাঁর পাঠ্যজীবন শুরু হয়। ছোটবেলা থেকে তিনি ছিলেন সাংগঠনিক ও সামাজিক। তার প্রমাণ মেলে তিনি কৈশোর জীবনেই গড়ে তোলেন সাধনপুর পল্লী মঙ্গল সমিতি। ছাত্র হিসেবে তিনি মেধাবী ও তুখোড় ছিলেন। ১৯৩২ সালে বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। এরপর ১৯৩৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর থেকে চট্টগ্রাম কলেজে, চট্টগ্রাম ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজে, পশ্চিমগাঁও নওয়াব ফয়জুন্নেসা কলেজে চট্টগ্রাম এতিমখানায় ও পরে আবার ফেনী কলেজে ও কুমিল্লা কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দিলেন কুমিল্লায়।
১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনই অধ্যাপক আসহাব উদ্দিনকে রাজনীতিপ্রবণ করে তোলে এবং ১৯৫৪ সনের নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষে দাঁড়িয়ে সংসদে নির্বাচিত হয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং অল্পকালের মধ্যেই মাটি ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা বশে বামপন্থী হয়ে শোষিত বঞ্চিত পীড়িত গণমানুষের মুক্তির সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন। তাদের জীবনকেই নিজের জীবনরূপে মেনে নিলেন। সাধারণ মানুষের সুখ দু:খ, হাসিকান্না, দাবি প্রত্যাশা এসবকে উপকরণ করে কলমহাতে তুলে নিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি হয়ে উঠেন একজন প্রতিভাধর লেখক।
কথাসাহিত্যিক আসহাবউদ্দিনের লেখায় ফুটে উঠেছে সাধারণ মানুষের জীবন ও কথা। লেখনীতে তিনি সমাজের কলুষতাকে সরল সরস বর্ণনা ভঙ্গীর মাধ্যমে খোঁচা দিয়ে বেখেয়াল সমাজের বিবেককে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। তিনি সচেতনতা সৃষ্টির ব্রতী ছিলেন। রম্য-ব্যঙ্গ রচনাকার হিসেবে তিনি ছিলেন সুপরিচিত লেখক। তাঁর প্রথম বই ‘বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর’ এছাড়াও ‘ধার’, ‘সের এক আনা মাত্র’, ‘ঘুষ’ ‘উজান স্রোতের জীবনের ভেলা’, ‘দাম শাসন দেশ শাসন’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য বইগুলো সুধী পাঠক সমাজে খুবই সমাদৃত। আসহাবউদ্দিন আহমদ মোট ৩৬টি গ্রন্থের রচয়িতা, তারা মধ্যে ২০টি বই প্রকাশিত, ১৬টি অপ্রকাশিত রয়ে গেছে।
‘মানুষ মানুষের জন্য’ এটাই ছিল অধ্যাপক আসহাব উদ্দিনের জীবনের মূল দর্শন। মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেবার মধ্যেই তিনি খুঁজে পেতেন জীবনের প্রতিচ্ছবি। আসহাব উদ্দিন আহমদের প্রতিটি বইয়ের ছত্রেই সাধারণ মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা, তাদের দু:খ দুর্দশার জন্য আন্তরিক বেদনাবোধ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। তাঁর প্রতিটি ব্যঙ্গ বিদ্রুপই শোষকদেরকে চিহ্নিত বা আঘাত করার হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। শৃঙ্খলিত মানুষের মুক্তির আকাঙ্খা যে হৃদয় ঝড় তোলে, নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের দীর্ঘশ্বাস যে অন্তরে হাহাকার সৃষ্টি করে আর শোষিত লাঞ্ছিত মানুষের দু:খ যন্ত্রণা মর্মে আগুনের রেখায় যে বেদনার ছবি আঁকে তেমনি হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন আসহাব উদ্দিন আহমদ।
শিক্ষক আসহাবউদ্দিন, রাজনীতিক আসহাবউদ্দিন, লেখক আসহাবউদ্দিন, মানবপ্রেমিক, মানবসেবক মানবদরদী ১৯৯৪ সালে ২৮ মে ঢাকা আসহাব উদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। ২৯ মে তাঁকে বাঁশখালী কলেজ ময়দানে নামাজে জানাজা শেষে প্রিয় বৃক্ষ কৃষ্ণচুড়ার নীচে সমাহিত করা হয়। আমাদের জাতীয় জীবনে একজন সচেতক আসহাব উদ্দিন আহমদের মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। ২৮ মে ২০২১ ইং ২৭ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে চট্টলার এই রাজনীতিক, সাহিত্যিকের স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।