পৃথিবীতে ধর্ম একটি। ধর্মের কোন দ্বিতীয় নেই। প্রকৃত প্রস্তাবে গবেষকদের মতে “এই একমাত্র ধর্মে যা আছে তাই ধর্ম, আর যা নেই তাই হল অধর্ম। যেখানে আলো নেই সেখানে যেমন অন্ধকার ঠিক সেভাবে যেখানে ধর্ম নেই সেখানেই অধর্ম। বিশ্বপ্রকৃতির বিধি বিধানের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে সমগ্র বিশ্বজগত একই নিয়মে পরিচালিত হচ্ছে। একই সূর্য এবং একই চন্দ্র উভয়ই গোলার্ধে কিরণ দান করছে। একই বায়ু সকল জীবের আয়ূ রক্ষার্থে সাহায্য করছে। একই পানি সকল প্রাণীর জীবন রক্ষা ও তৃষ্ণা নিবারণ করছে। ধর্মের বেলায়ও ঠিক একই রীতিনীতি প্রযোজ্য। যুগে যুগে এই একমাত্র সত্য সনাতন ধর্মই বিশ্বের মানব জাতিকে পথ দেখিয়ে চলেছে অনন্ত জীবনের পানে।
এ অনন্ত জীবনে সমাগত সত্যকে যারা গ্রহণ করে নেয় তারাই সত্যযুগের স্রষ্টা। স্বাভাবিকভাবে জানা প্রয়োজন সত্য যুগ কি? প্রাচীন ঋষিগণ বলেছেন, কলিঃ শয়ানো ভবতি সংজিহানস্ত দ্বাপর ঃ উডিষ্টন ত্রেত : ভবতি স্কৃৃতং সম্পদ্যতে চরন। অর্থাৎ ঘুমিয়ে থাকাটাই হল কলিকাল। জেগে উঠা দ্বাপর, শয্যাত্যাগ ত্রেতা আর এগিয়ে চলাই হল সত্যযুগ। (ঋগবেদ-ঐতরো ব্রাহ্মণ) অর্থাৎ : অতীতকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা নয় বর্তমান বা সমাগত ঐশী নির্দেশকে মেনে নিয়ে এগিয়ে চলার নামই হল সত্যযুগ।
তাই বিবর্তনের ক্রমধারায় বলতে গেলে কৃষ্ণকে মানাই শেষ নয়, যীশুকে মানাই শেষ কথা নয়। সমাগত নবী অবতার বা ভাববাদীকে সময়ের ধারাবাহিকতাই মেনে নেওয়াই সনাতন ধর্ম। এ সনাতন প্রগতিশীল মানসিকতাই সত্যযুগের নিদর্শন। মনে রাখা প্রয়োজন হিন্দু, পার্শী, খ্রীষ্ট বা মোহামেডান এগুলি কোন ধর্মের নাম নয়। এসব নাম ধর্ম প্রবর্তকগণ কখনো রাখেননি। এর কোন কোনটি জাতির নাম আবার কোন কোনটি ধর্মের শত্রুদের দেয়া বিকৃত নাম। হিন্দু ধর্ম, খ্রীষ্ট ধর্ম বলে যে সব নাম বর্তমান সমাজে প্রচলিত রয়েছে এগুলো প্রকৃত পক্ষে কোন ধর্মের নাম নয়। সিন্ধুতীরে যারা বসবাস করে বিদেশী তথা শ্লেছরা তাদেরকে হিন্দু নামে অভিহিতো করত (ভবিষ্যৎ পুরান) হিন্দ বা ভারতের অধিবাসীরা (বিশেষ করে পশ্চিম ভারতীয়) হিন্দু নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে ধর্মের বেলায়ও এ নামটি ব্যবহৃত হতে শুরু করে। অনুরূপভাবে পারস্যের লোকেরা পারস্যে তাদের ধর্মকে পার্সী ধর্ম নামে আখ্যায়িত করে। এভাবে খ্রীষ্ট ধর্ম নামের কোন ধর্মের নাম মাহাত্মা যীশু কখনও শুনেছেন এরকম প্রমাণ পাওয়া যায়না। সিরিয়ার আন্তিয়খিয়া নামক স্থানে এ নামের প্রথম ব্যবহার আরম্ভ হয়। (প্রেরিত, ১১ : ২৬)
সৃষ্টিকর্তার কাছে সর্বযুগে সর্বকালে একমাত্র ধর্ম হল “আত্মসমর্পণ” আরবীতে যাকে বলে ইসলাম, সংস্কৃতে বলা হয় “প্রপত্তি” গবেষকরা এর ব্যাখ্যায় বলেন, ন্যাস বিদ্যা প্রপত্তিঃ, প্রপত্তি নাম আনুকুল্যস্য সংকল্পঃ প্রতিকুল্যস্য বর্জনং। অর্থাৎ প্রপত্তি হচ্ছে ন্যাস বিদ্যা (আত্মসমর্পণ বিদ্যা, ঈশ্বরের ইচ্ছায়) অনুকুল বিষয়ে সংকল্প করা, প্রতিকুল বিষয় বর্জন করা। (যতীন্দ্র মত দীপিকা, ৭ পরিচ্ছেদ, ২৮ অনুচ্ছেদ)। অন্যত্র বলা হয়েছে, আত্মনিক্ষেপ, আত্মনিবেদন, আত্মসমর্পণ কথাগুলির যে কোন একটি পাইলেই আমরা প্রপত্তিকে অনায়সে সনাক্ত করতে পারি (উদ্ভোধন, ৮৩ তম বর্ষ, বাংলা ১৩৮৮)।
আমি প্রথমেই বলেছি, ধর্মমাত্র একটিই, ধর্মের কোন দ্বিতীয় নেই, সত্য সব যুগেই এক। মহাভারতে আছে, সত্যং সংসু সদা ধর্মঃ সত্যং ধর্ম সনাতন, অর্থাৎ সত্যই ধর্ম আর সত্য ধর্মই সনাতন ধর্ম। স্রষ্টার কাছে আত্মসমপর্নই হল প্রকৃত ধর্ম। যাকে আরবীতে বলা হয়েছে, ইন্নাদ্দীনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম, অর্থাৎ আত্মসমúর্ণেই শান্তি লাভ হয়।
“চেতসা সর্ব কর্মানি ময়িসংন স্যমৎপরঃ। অথাৎ সমস্ত কিছুই স্রষ্টাতে সমর্পণ করা। সর্ব ধর্মান পরিত্যাজ্য সাসেকং শরণং ব্রজ, অথাৎ এক মাত্র স্রষ্টাতে আত্মসমর্পন ব্যতিত আর কোন ধর্ম নেই। আত্মসমর্পন ব্যতিত ধর্ম সমূহ সর্বদাই পরিত্যাজ্য। ভারতীয় দর্শণের পঞ্চ সাধনের অন্যতম হল, “প্রপত্তি”। যার অর্থ-ঈশ্বরে নিঃশেষে আত্মসমর্পন, যাকে আরবীতে ইসলাম বলা হয়েছে।
আরবী বাইবেলে বর্ণিত রয়েছে, যে জুররাইল মুমকিফানি আহফাজুহু ছালিমান, ছালিমান লি আল্লাহু আলাইকা মুতাত্তক্কীল অর্থাৎ যার মন স্রষ্টাতে সুস্থির সেই শান্তিতেই অবস্থান করবে। কেননা সে স্রষ্টাতে আত্মনির্ভরশীল। ইতিহাসের ক্রমধারায় আদিমযুগের পর মনুষ্যযুগ যাকে হিন্দু ধর্মে মনু এবং কোরআন ও বাইবেলে নুহ বলা হয়েছে। আদমের ১০৫৬ বছর পর নুহের আবির্ভাব। (মুস্তাদরাক, হাকেম ও তিবরানী)।
সুতরাং আদিদেব আদম হতে এই সত্য সনাতন ধর্মের যে যাত্রা শুরু হয়েছে তা নুহ বা মনুর মাধ্যমে নানা শাখায় প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে পৃথিবীর নানা অঞ্চলে নানা ভাবে ভিন্ন ভিন্ন নামে তার স্থান করে নিয়েছে।
অতএব পরধর্ম বলতে কিছুই নেই সেই একই ধর্ম নানা দেশে নানা ভাষায় আচরিত প্রচারিত হয়ে এক মহামিলন ক্ষেত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ধর্মের এই সনাতন ও চিরন্তন রূপ দর্শন করে অভিভূত ম্যাক্স মুলার বলেছিলেন, The true religion of the future will be the fulfilment of all the religions of the past এভাবে সমকালীন বিশ্ব সমস্যার সার্থক সমাধানের জন্য সমগ্র মানব জাতিকেই আজ মহাধর্মে একত্রিত হওয়ার সময় সমাগত। মানুষের দেহে প্রবাহিতো রক্তধারা কোন জাতি, গোষ্ঠীর চিহ্নিত রক্তধারা নয়। রোগাক্রান্ত হলে একই দ্রব্যগুণে (্ঔষধ) তা দুরিভূত হয়। অতএব এক অখন্ড মানব গোষ্ঠীর জন্য নানা ধর্ম কিভাবে মুক্তরূপে হতে পারে? ধর্মের এ স্ববিরোধী ব্যবস্থা কোন দিনই হতে পারেনা। তাই আজকের নব যুগের নতুন শ্লোগান হচ্ছে, “বিশ্বের সকল মানুষ এক হও, মানবতার জয় হোক, বিশ্বধর্মের জয় হোক”। সকল প্রশংসা নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা প্রতিপালকেরই প্রাপ্য।
এতক্ষণ ধরে যে সনাতন ধর্মের বিষয়ে আলোকপাত করে আসছি তাতে কিছুটা হলেও ধর্মের সার্বজনীনতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ধর্মের অবস্থানকে কিছুটা হলেও সুসংহতো করতে পেরেছি বলে আমি মনে করি। যেহেতো আমরা নিজেকে মুসলমান, খ্রীষ্টান বা হিন্দু যে যাই মনে করি না কেন প্রকৃত প্রস্তাবে সকলেই আমরা সিন্ধু নদীর তীরের বাসিন্দা হওয়ার কারণেই সিন্দু বা হিন্দু বলে অভিহিতো । একই ভৌগলিক সীমারেখায় আমাদের বসবাসের কারণে নিত্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিষয়ে নিজেদের রক্তের বন্ধন ও আত্মীয়তার ঐক্যবদ্ধতা অবিচ্ছেদ্য। সে আলোকে এ পর্যায়ে আমি চট্টগ্রাম অঞ্চলের হিন্দু ধর্মের বিবাহশাদী বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করছি। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিবাহ শাদী বিষয়ে গবেষকদের গবেষণালব্ধ যে তথ্যাদি পাওয়া যায় তাত্থেকে সুপ্রাচীনকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আট প্রকার বিবাহ প্রচলনের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন – (১) ব্রাহ্ম বিয়ে, (২) দৈব বিয়ে, (৩) আর্য বিয়ে, (৪) গন্ধর্ব বিয়ে, (৫) পিশাচ বিয়ে, (৬)অসুর বিয়ে, (৭) রাক্ষস বিয়ে ও (৮) প্রঁজাপতয়ে বিয়ে ইত্যাদি। হিন্দু সম্প্রদায়ের এসব বিয়ে নিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করছি। যাতে প্রজন্ম আমাদের হারিয়ে যাওয়া সাংস্কৃতিকে ধারণ করতে পারে।
১। ব্রাহ্ম বিয়ে : শাস্ত্রজ্ঞান সম্পন্ন বরকে আহ্বান করে পূজা সহকারে যথাবিধি কন্যাদানের নাম ব্রাহ্ম বিয়ে।
২। দৈব বিয়ে : যজ্ঞকৃত ঋত্বিকে অলংকারাদির দ্বারা ভূষিত করে কন্যাদানের নাম দৈব বিয়ে।
৩। আর্য বিয়ে : বরের নিকট হতে এক বা দুটা মিথুন গ্রহণ করে বিধান অনুসারে কন্যাদানের নাম আর্য বিয়ে।
৪। গন্ধর্ব বিয়ে : বর কন্যার মনের মিলনের দ্বারা পরস্পর মিলিত হওয়াকে গন্ধব বিয়ে বলে।
৫। পিশাচ বিয়ে : সুপ্ত বা মত্ত অবস্থায় প্রথমে জোর করে কন্যার অসম্মতিতে বলাৎকার করে সতীত্ব নাশ করতঃ পরে বিয়ে করাকে পৈশাচ বিয়ে বলে।
৬। অসুর বিয়ে : বরের কাছ হতে অর্থ গ্রহণ করে কন্যাদান করাকে অসুর বিয়ে বলা হয়।
৭। রাক্ষস বিয়ে : কন্যার আত্মীয় স্বজনকে বিনাশ করে বা যুদ্ধে জয় লাভ করে বল পূর্বক কন্যাকে হরণ করে বিয়ে করাকে রাক্ষস বিয়ে বলে।
৮। প্রঁজাপতয়ে বিয়ে : বর ও কনের উভয় পক্ষের গুরু জনেরা পরস্পর আলাপ আলোচনার মাধ্যমে অর্চনা সহকারে কন্যাদান করাকে প্রঁজাপতয়ে বিয়ে বা প্রঁজাপতি বিয়ে বলে। [সূত্র : সুবল মিত্রের সরল বাংলা অভিধান, পৃঃ ৯৫৯]
সামন্তবাদের অবসান ও বহু শতাব্দীর বিবর্তন ও সামাজিক পরিবর্তনের কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর্যুক্ত আট প্রকার বিয়ের মধ্যে ছয় প্রকার বিয়ে কালক্রমে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে দুই প্রকার বিয়েই প্রচলিত রয়েছে যেমন ঃ ব্রাহ্ম ও প্রঁজাপাত্য বিয়ে।
প্রঁজাপতয়ে বিয়ে আবার দু’প্রকার যথা (১) অনুলোম বিয়ে ঃ উচ্চ বর্ণের পাত্র উচ্চ বর্ণের কন্যাকে বিয়ে করাকে অনুলোম বিয়ে বলা হয়, (২) প্রতিলোম বিয়ে : নি¤œ বর্ণের পাত্র উচ্চ বর্ণের কন্যাকে বিয়ে করাকে প্রতিলোম বিয়ে বলা হয়।
প্রাচীনকালে চট্টগ্রামের হিন্দু সমাজের মধ্যে নাবালিকা বিয়ের বহুল প্রচলন ছিল। এ নাবালিকা বিয়ে নি¤œ বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে এখনও প্রচলিত রয়েছে। এ নাবালিকা বধুর প্রথম রজত দর্শনের পর আর একবার বিয়ে হওয়া এবিবাহের প্রচলিত নিয়ম। চট্টগ্রামের বিয়ের আচার অনুষ্ঠান এবং বরণ কুলার উপাদান হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মতই একই উপদানেই প্রচলিত ছিল। যা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সম্মিলিত প্রতিক হিসেবে চট্টগ্রামে সুপ্রসিদ্ধ।
চট্টগ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ের অনুষ্ঠান সাধারণত তিন ভাগে বিভক্ত। যেমন, (১) শাস্ত্রাচার, (২) দেশাচার, (৩) লোকাচার। এ পর্যায়ে আমি হিন্দু বিয়ে শাদীতে প্রচলিত নিয়মানুযায়ী যেভাবে ক্রমানুসারে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে সেভাবে প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত পুরো বিয়ে শাদীর আনুষ্ঠানিকতাকে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরেছি।
বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নেয়া এবং নিয়মাবলী ঃ
হিন্দু শাস্ত্র মতে ছেলের অযুগ্ম বছরে রবি, চন্দ্র, তারা শুদ্ধ হলে এবং কন্যার যুগ্ম বছরে গুরু, চন্দ্র ও তারা শুদ্ধ হলে বিয়ে হওয়াই প্রচলিত নিয়ম।
গবেষকদের মতে, প্রাচীন চট্টগ্রামে হিন্দু সমাজে পেশাদার ঘটক ছিল। বর পক্ষই প্রথমে পাত্রী নির্বাচন করার জন্য ঘটক নিয়োগ করত। নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের টাকা দিয়ে পাত্রী সংগ্রহ করতে হতো । তখন অবশ্য নারীর সংখ্যা কম ছিল। এখন সময়ের ব্যবধানে তা উল্টো হয়ে গেছে। বিবাহে তখন পণ প্রথা বা যৌতুকের প্রচলন ছিল না। ঘটকেরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে গোত্র-বংশ মিলিয়ে বিয়ের উপযোগী পাত্রী খোঁজ করে নিত। এরপর কন্যাপক্ষ বরের বংশ, গোত্র, বাড়ী-ঘর, পুকুর, সহায় সম্পত্তি ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজ খবর নিত। সবকিছু পছন্দ মত হবার পর পাত্রীপক্ষ বর দেখার ব্যবস্থা করত। সে সময় বরকে পাত্রীপক্ষ বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে দেখত। বরের শিক্ষা-দীক্ষা, আদব-কায়দা ইত্যাদিরও পরীক্ষা নেয়া হতো। সাধারণত বরপক্ষের বাড়ীর পূর্বমূখী ঘাটা, উচু ভিটা, ও বাড়ীর পিছনে পুকুর না থাকলে কনের পক্ষ তাদের মেয়ে বিয়ে দিতে রাজী হতেন না। বরপক্ষ তাদের দাসী/বাদী পাঠিয়ে কনে দেখার ব্যবস্থা করত। দাসী কনের মাথার চুল হতে শুরু করে পায়ের নখ পর্যন্ত সকল অঙ্গ-প্রত্যাঙ্গ পুংখানু পুংখানুভাবে পরীক্ষা করে দেখত। উভয় পক্ষের পাত্র-পাত্রী পছন্দ হলে গনক (আর্চায্য) ডেকে পাত্রপাত্রীর কুষ্ঠী বিচার করে শুভাশুভ ও যোঠক মিলিয়ে দেখা হতো। এভাবেই সকল প্রকার পরীক্ষা নীরিক্ষার পর বিয়ের জন্য উভয় পক্ষ সম্মত হতো।
উভয় পক্ষ বিয়ের বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছানোর পর বর পক্ষের কয়েকজন কনের পিত্রালয়ে গমন করে বাগদান বা অষ্টদূর্বা অনুষ্ঠান করত। সে সময় অলংকারের ওজন, পদ, বিয়ের তারিখ ইত্যাদি বিষয়ে একখানা চুক্তিপত্র সম্পাদন করা হতো । তাতে বর কনের পিতা বা কাকা বা নিকটাত্মীয় সম্পর্কের কেউ স্বাক্ষর করতেন। বিয়ের পূর্বে বরের পিত্রালয়ে কনের পিতা-মাতার বেয়াই ভাতা অনুষ্ঠান করা হতো। কারণ চট্টগ্রামের হিন্দু সমাজের প্রচলিত নিয়মানুসারে মেয়ের বিয়ের পরে নাতী-নাতনী ভূমিষ্ট না হওয়া পর্যন্ত মেয়ের পিতা মাতা কেউ ছেলের বাড়িতে অন্ন গ্রহণ করতে পারতেন না। তাই বরপক্ষ অষ্টদূর্বা নেওয়ার পর কনের পিতামাতাকে তাদের বন্ধু বান্ধব সহ নিমন্ত্রন করে বেয়াই ভাতা খাওয়াতেন যার সামাজিক প্রচলন চট্টগ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো রয়েছে।
চট্টগ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিবাহের প্রকারভেদ ঃ
চট্টগ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ে শাদী দু’ভাবে অনুষ্ঠিত হয়। যেমন ঃ (১) চলন্ত বিয়ে, (২) নামন্ত বিয়ে।
১। চলন্ত বিয়ে : এটি বিত্তশালী হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত ছিল যা এখনও রয়েছে।
২। নামন্ত বিয়ে : নামন্ত বিয়ে স্বল্প বিত্তের আপামর হিন্দুদের জন্য প্রচলিত বিয়ে।
চলন্ত বিয়ে :
প্রাচীনকালে চট্টগ্রামের বনেদী হিন্দু সমাজে বিয়ের ৫/৭ দিন পূর্ব হতে প্রতিদিন বর কনের “তেলোয়াই দেওয়া” এবং তেল চড়ান অনুষ্ঠান করা হতো । এ দুটো অনুষ্ঠান বিয়ের প্রস্তুতিকালীন সম্বর্ধনা মূলক মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হতো । সম্ভবত শতবর্ষ পূর্বে হতে এ অনুষ্ঠান দুটো চট্টগ্রামের হিন্দু সমাজ হতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিয়ের আগের দিন দুপুরে বরকে তার পিতৃগৃহে “আইবুড়ো ভাত খাওয়ানোর অনুষ্ঠান করা হয়ে থাকে। সে উপলক্ষে তাকে নতুন কাপড়ে সাজিয়ে অবিবাহিতো জীবনের সমাপ্তি হওয়ার কারণে শেষ বারের ন্যায় ভাত খাওয়ানো হয়। শেষ বেলা ক্ষৌর কর্ম সারা হয়। সন্ধ্যা হতে অধিবাস আরম্ভ হয়। সেদিন পাঁচটি পুকুর হতে পাঁচ কলসি জল সংগ্রহ করে রাখা হয়। একে জল ভরান বলা হয়। আই নাড়–র চাল ধোয়ানো হয়। এ দুটো অনুষ্ঠান বিত্তশালীরা তাদের দাসদাসীদের দ্বারা সম্পন্ন করাতেন।
বিয়ের প্রারম্ভিক অনুষ্ঠান হিসেবে দধি মঙ্গল পালন করা হয়। সে উপলক্ষে বিয়ে বাড়িতে মেয়েদের পান-তেল করার জন্য ডাকা হয়। পাড়া পড়শির মেয়েরা সদল বলে উপস্থিত হয়ে “হলা” (একপ্রকার গ্রাম্য প্রচলিত গান) গেয়ে আমোদ আথ্রাদ করে নানা প্রকার রসিকতার মধ্য দিয়ে এ অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে। সেকালে চট্টগ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের জমিদার ও সওদাগরদের পরিবারের বিয়ে অত্যান্ত জাঁকজমকের সাথে অনুষ্ঠিত হতো । বরের বাপের বাড়ির ঘাটায় লম্বা লম্বা (ভাইজ্যা) বাঁশ জোড়া দিয়ে ৬০/৭০ হাত উপরে “নহবত খানা” বানানো হতো । এ নহতো ব খানায় সাত দিন ব্যাপী বাদ্য বাজানো হতো । কয়েক মাইল দূর হতে নহবত খানার এ বাদ্য বাজনা শুনা যেতো। সাত দিন ধরে চলত যাত্রাগান, কবিগানের মঞ্চ করে বিশাল অনুষ্ঠান করা হতো এবং পোড়ানো হতো হাজার হাজার আতশ বাজি ও রাতদিন অতিথিদেরকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো ব্যবস্থা করার কারণে রাত দিন চুলার আগুন জ্বলতেই থাকত।
সেকালে চট্টগ্রামের এসব বিয়েতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ন্যায় চৌদল ও পাল্কীর প্রচলন ছিল। গ্রামে গঞ্জে যেখানে যাতায়তের অসুবিধা সেখানে এখনও এ চৌদল ও পাল্কীর প্রচলন দেখা যায় যদিওবা বর্তমানে তা নাই বল্লেই চলে। সে সময়কালে বর কনের বাড়িতে বিয়ে করতে যেত চৌদলে করে এবং নতুন বউকে আনা হতো পাল্কী করে। বিয়ে উপলক্ষে বিয়ে বাড়ির প্রবেশ পথে কলাগাছ পুঁতে মঙ্গল ঘট স্থাপন করে বরণ কুলা সাজানো হয়। বিয়ের দিন সকালে বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ ও ষোড়শ মাতৃকা পূজা করা হয়। দূর্বা ঘাস, ঘিলা ও কাঁচা হলুদ বাটা দিয়ে বর এবং কনের গায়ে হলুদ দেয়া হয়, এরপর পাঁচ পুকুরের জল দিয়ে তাদের ¯œøান করানো হয়। বর সাজানোতে বরের মুখ ও কপালে সুগন্ধি চন্দনের ফোটা দেয়া হয় এবং বরের সোহাগ কাটা হয়। এসময় বরের আত্মীয় স্বজনেরা বরকে মাইন/উপহার বা শিকলী দেয়। এ অনুষ্ঠান শেষ হলে বরকে মায়ের কাছে নেয়া হয়। বরের মা বিছানো পাটির উপর বসে ছেলেকে কোলে তুলে নেয়। ছেলেকে কোলে নিয়ে বিষাদমাখা অশ্রুধারায় ছেলের হাতে এক গ্লাস দুধ দিয়ে তিনটি দুধের কুলি করতে বলে। ছেলে কুলি করার পর ছেলের বাম হাতের কনিষ্ট আঙ্গুলীতে কামড় দিয়ে নিখুঁত ছেলেকে খুতা করে দেয়, যাতে কোন অশুভ দৃষ্টি ছেলের উপর না পরে। এরপর মা ছেলের মুখ চুম্বন করে। ছেলে মায়ের স্তনে মুখ দিয়ে তা চুষে খাওয়ার ন্যায় অভিনয় করে এবং এরপর ছেলে মার জন্য দাসী আনতে যেতে মায়ের অনুমতি প্রার্থনা করে, মা ঘরের লক্ষী আনার জন্য ছেলেকে অনুমতি দেয়।
এসব অনুষ্ঠান শেষ করে বরকে চৌদলে বসিয়ে দেয়া হয়। বরের কোলে একটি অল্প বয়স্ক শিশুকে তার আত্মীয় স্বজনদের মধ্য হতে বসিয়ে দেয়া হয়। যা পবিত্রতার প্রতিক হিসেবে দেখা হয়। অতপর ঢোল বাদ্য সহ বর ও বরযাত্রীরা কনের পিতৃগৃহের দিকে যাত্রা করে। এ সময় বরের চৌদলের উপর পুষ্প বৃষ্টি অথবা খই বা চাউলের বৃষ্টি ছিটানো হয়। বরযাত্রীরা কনের বাড়ীর ঘাটায় এসে পৌছলে কনের প্রতিবেশীরা তাদেরকে সেখানে আটকিয়ে দেয়। একে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় “গেইট ধরনী” বলা হয়। তখন বর পক্ষকে “গেইট ধরনী” বাবদ বাতাসা বা জিলাপীর পাতিল দিয়ে আপোষ করতে হয়। এখন অবশ্য তা টাকার অংকের মাধ্যমে নিস্পত্তি করা হয়। এরপর কনে পক্ষের বিশিষ্ট দুয়েকজন লোক সহ বরণ কুলা নিয়ে বরযাত্রীকে আগ বাড়িয়ে নিয়ে আসে। বর ও বরযাত্রীরা বিবাহ আসরে আসন গ্রহণ করার পর তাদেরকে পান মিঠা দিয়ে বর ও তার সহযাত্রীদেরকে কনে পক্ষের পক্ষ হতে অভ্যর্থনা জানানো হয়।
বর পক্ষের বাড়িতে যেসব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয় তদ্রুপ কনের বাড়িতেও বিয়ের পূর্ব দিনে বর পক্ষের ন্যায় আইবুড়ো ভাতের অনুষ্ঠান, ক্ষৌরকর্ম, অধিবাস পালন, পানতেল দেয়া ইত্যাদি অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয় এবং বর পক্ষের পক্ষ হতে কনের জন্য বস্ত্রালংকার কনের পিত্রালয়ে বুঝিয়ে দিয়ে আসা হয়। বিয়ের আসরে কনেকে আনার আগে কনের মাথার তালু হতে পায়ের তালু পর্যন্ত মাপের সাত নলা সুতা দিয়ে আয়লা গ্রহণ করে। সে সুতা একটি কলার ডগায় পেঁচিয়ে রাখা হয়। কনের কপাল ও মূখে বরের ন্যায় চন্দনের ফোটা দেয়া হয় এবং গলায় ফুলের মালা দেয়া হয়। বাড়ির উঠোনে বিবাহ বাসরে বেধী নির্মাণ করা হয়। একপাশে একটি ছোট নকল পুকুর খনন করে জল দ্বারা তা পূর্ণ করে রাখা হয় এবং তার চার কোনায় চারটি কলা গাছ পুঁতে দেয়া হয়। কনের আয়লা গ্রহণের সাতনাল সুতো দিয়ে ঐ কলাগাছ চারটির চারিদিকে পেচিয়ে তা বেঁধে দেয়া হয়।
বিয়ের লগ্ন সন্নিকটবর্তী হলে প্রথমে বরকে বিয়ের আসরে আনা হয়। ঘরের হাইচের নীচে বা ঘরের সামনে রক্ষিত অংশে দু’জনে একটি চাদর ধরে তার নীচ দিয়ে পাট পিড়িতে বসিয়ে কনেকেও বিয়ে আসরে এনে সাতবার বরের চারদিকে প্রদক্ষিন করানো হয়। তখন কনে প্রতিবার প্রদক্ষিনের পর বরকে প্রণাম করে। এরপর বর কনের “শুভ দৃষ্টি” হয়। এসব কার্য্যাদি শেষে পুরোহিতের সামনে বর কনেকে পাশাপাশি বসানো হয়। বরের গাঁ খালি থাকে। উভয়ের মাথায় সোলারমুকুট থাকে। লগ্ন আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথে পুরোহিতো বিয়ের কার্য্যক্রম ধর্মীয় দশকর্ম শুরু করেন। হিন্দু বিবাহ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের অংশ বিশেষ। বিবাহকালে বর নারায়ণ স্বরূপ। কনের পিতা বরের পিতৃ সমতুল্য গুরুজন হলেও বিয়ের কার্যক্রম চলাকালে নারায়ণরূপী বরের হাঁঠুর গিরা তথা পায়ে হাত দিয়ে কন্যার পিতাকে কন্যা সম্প্রদান করেন। হিন্দু শাস্ত্র মতে বরকে কন্যা সম্প্রদানের সাথে ৮০ রতি পরিমাণ স্বর্ণ দক্ষিণা স্বরূপ দেওয়ার নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। অর্থনৈতিক সমস্যা জর্জরিত বর্তমান সময়ে সাধারণ লোকদের পক্ষে এ ব্যয় ভার গ্রহণ করা অসম্ভব বিধায় প্রতিকি হিসেবে একটি আংটি বা অন্য ধরনের প্রতিকি চিহ্ন দিয়ে এ কাজ সারা হয়।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর প্রভৃতি দেব-দেবতা, চন্দ্র, সূর্য্য, গ্রহ, তারা ইত্যাদিকে সাক্ষী রেখে বর কনে একে অপরকে স্বামী স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেন। বরকে স্ত্রীর চারিত্রিক দোষ ছাড়া আর সর্বপ্রকার দোষ ক্ষমা করার অঙ্গীকার করতে হয়। পুরোহিত বিয়ের মন্ত্র পাঠ, যোগ-যজ্ঞ করে বিয়ের ক্রিয়া অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে। হিন্দু বিয়ে সম্পাদনে ব্রাহ্মণ পুরোহিতের ক্রিয়া কর্মের মধ্যে নাপিতেরও একটি ভূমিকা রয়েছে। নাপিত বর ও কনেকে ঐ সময় মহাবাক্য পাঠ করে শোনায়। বিয়ের সময় বর বধুর প্রতি ফুল অথবা খই, চাউল ও ডিম নিক্ষেপ করা হয়। বিয়ের মূল অনুষ্ঠান শেষ হলে বর কনেকে ঘরে নিয়ে খাওয়ানো হয়। সেখানে বর কনের বন্ধু, বান্ধব, ভ্রাতৃবধু, প্রভতি সহ বাসর জাগে। অর্থাৎ নতুন বর বধুকে দিয়ে তাদের ঘর সংসারের প্রথম পাঠের অভিনয় করানো হয়। চট্টগ্রামী ভাষায় এটি নতুন বর বধুর খেলা খাওয়ানো নামে অভিহিতো । পরের দিন ভোর বেলা বর কনেকে বিদায় দেয়া হয়। সে সময় মা বধু বেশী কনেকে কোলে নিয়ে বসে থাকে। তখন বর পক্ষ একখানি নতুন শাড়ীতে এক কাদি পাকা কলা বেঁধে কনের মায়ের কোলে ফেলে দিয়ে কনেকে কোলে করে পাল্কিতে তুলে নেয়। যা কনের মাকে ভূলিয়ে বধু নিয়ে যাওয়া বলা হয়। পাল্কির সাথে বধুর ভাই সম্পর্কীয় কেউ সারা পথ পাল্কির খুঁটি ধরে সাথে সাথে যায়। তাকে ডুলি বা পাল্কি ধরে যাওয়া বলা হয়ে থাকে। বর্তমানে গাড়ীর প্রচলন হওয়াতে এসব অনুষ্ঠানাদি অতিশয় সহজ হয়ে গেছে। এখন বরের সাথে ডুলি গাড়ী চড়েই যেতে পারে।
বধুর পাল্কি বা গাড়ী শ্বশুর বাড়ির উঠানে আসার সাথে সাথে বরের মা, মাসী, পিসি, মামী বা কেউ প্রথমে পাল্কির উপর এক ঘটি জল ঢেলে দেয়। পাল্কির দরজার সামনে একটি শুকনো গোবরের ঘুটে রাখা হয়। বধু প্রথমে বাম পা নামিয়ে ঘুটের উপর রাখে অতপর ডান পা মাটিতে নামিয়ে উঠানে দাঁড়ায়। তখন একখানি পাথরের থালায় রাখা একটি টাকি মাছ বা ফুল নব বধুর সামনে নিয়ে তা তাকে ধরতে বলা হয়। বধু তা হাত দিয়ে ধরে। এরপর এক গ্লাস দুধ বধুর হাতে দেয় তিনটি কুলি করতে। দুধ দিয়ে কুলি করার পর বধুকে কোলে করে রান্না ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বধুকে রান্না করা ভাত তরকারী দেখানো হয়। এরপর তাকে ধানের গোলা বা ডোল অথবা অল্প ধান দেখানো হয়। এটিই হল বধু বরণ অনুষ্ঠান।
আমি প্রথমেই উল্লেখ করেছি এখানকার সামাজিক আচার অনুষ্ঠানাদির মধ্যে হিন্দু, মুসলিম সকলেরই কিছু না কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ সকলেই একই সামাজিক, সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বসবাস করে থাকে। তাই প্রাচীনকালের মুসলিম বিয়ের সাথে হিন্দু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার অনেক মিল রয়েছে।
বধু বরনের পর রয়েছে বাসি বিয়ে। এ অনুষ্ঠানেও অনেক অনেক আচার অনুষ্ঠান রয়েছে। লেখার কলেবর বৃদ্ধির কারণে আমি বিস্তারিত বর্ণনায় যাচ্ছি না, শুধু সংক্ষেপে এসব আনুষ্ঠানিকতার বর্ণনা দিচ্ছি। বাসি বিয়েতেও বিয়ের ন্যায় কলা গাছের বেদী করা হয় এবং বধুর আয়লা সুতাও পেচানো হয়ে। বেদীতে বর বধুর গায়ে হলুদ হয় এবং পাঁচ পুকুরের জল দিয়ে ¯œøান করানো হয়, ভিজা কাপড় বদলানোর পর বর বধুর মাথা আছড়িয়ে প্রথম সিদুঁর পড়িয়ে দেন এবং কাঁদা হতে আংটি খুঁজে বের করা, রান্নাবান্না করে সকলকে পরিবেশন করার অভিনয় এবং প্রাত্যহিক জীবনের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়েও অভিনয় করা হয়।
পরিশেষে বধুর কোলে দেয়া হয় নবজাতক শিশুর প্রতীক একটি পুতুল। এ ঘরকন্নার অনুষ্ঠানটিকে উপভোগ করে বরের ভ্রাতৃবধুরা। তারাই এ অনুষ্ঠানের মূল পরিচালক। এরপরের অনুষ্ঠানাদিকে বিয়ের অনুষ্ঠান হিসেবে আমি বর্ণনা করতে চাইনা। কারণ তা আরো দীর্ঘায়িত হবে। শুধু মাত্র কয়েকটি বিষয়ের দিকে পাঠকদেরকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে চাই, তা হল, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বর কনের তেলোয়াই দেওয়া, বউ নামানী, ঘাটা ধরণী, হাইচ ধরা, মঙ্গল ঘট ইত্যাদি প্রাচীনকালের খুবই প্রচলিত শব্দ। আমি এখানে তাই এসবের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করিনি। এতে লেখার কলেবর বৃদ্ধি পাবে।
নামন্ত বিয়ে:
চট্টগ্রামের স্বল্প বিত্তের অর্থাৎ গরীব সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে এ নামন্ত বিয়ের প্রচলন রয়েছে। এ বিয়ে বরের পিতৃগৃহে অনুষ্ঠিত হয়। নামন্ত বিয়েতে আগের দিন নির্দিষ্ট সংখ্যক বরযাত্রী নব বধুর পোষাক পরিচ্ছেদ, অলংকার, পান-সুপারি, বাতাসা, মিষ্টি, পাল্কি ও ঢোলবাদ্য সহকারে কনের পিতৃগৃহে আসেন। কনে পক্ষ নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী বরযাত্রীদেরকে আপ্যায়ন করেন। অতঃপর কনেকে বরের পিতৃগৃহে নিয়ে আসা হয়। সেখানে কনের অধিবাস প্রভৃতি ধর্মাচার ও লৌকচার সকল অনুষ্ঠানাদি পালন করা হয় এবং সেখানে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট লগ্নে কনে পক্ষ বরের পিতৃগৃহে এসে কন্যা সম্প্রদান করে বিবাহ অনুষ্ঠান সমাধা করে। নামন্ত বিয়েতে উভয় পক্ষেরই খরচ সাশ্রয় হয়। বিয়ের যাবতীয় কার্যক্রম চলন্ত বিয়ের অনুরূপই।
হিন্দু বিবাহের প্রাচীন এসব আচার অনুষ্ঠান এখনও চট্টগ্রামের হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। তবে আধুনিকতার ছোয়ায় অনুষ্ঠানের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। অন্যথা এখনও সকল অনুষ্ঠানাদি অবিকল একই রকম রয়েছে। লেখার শুরুতেই আমি সঙ্গত কারনেই বলেছিলাম হিন্দু কোন ধর্মের নাম নয়। এটিকে আবারও উল্লেখ করে বলতে চাই সিন্দু নদের অধিবাসী আমরা সকলেই হিন্দু সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। তাই হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান সকলের সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের মাঝে যথেষ্ট মিল লক্ষ্যনীয়। যদিওবা কিছু কিছু বিষয়কে ধর্মীয় আবরনে উপস্থাপন করে ভিন্ন রূপ দেয়া হয়। সকল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই একই ধারায় সমান্তরালভাবে প্রবাহমান। আমরা এদেশের হিন্দু, এদেশের মুসলমান, এদেশের বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান সকলেই একই আত্মার ভিন্ন নাম। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে আমরা একে অপরের সহযোগী। আমরা সকল প্রকার ধর্মীয় বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে একই সংস্কৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বাঙালি হয়ে বাঁচতে চাই।