বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই অনুষ্ঠান ও উৎসব প্রিয়মানুষ। নানা ধরনের, উৎসব আনন্দে এতদঞ্চলের মানুষ মেতে থাকতে পছন্দ করে। মেলা খেলায় মেতে থেকে তারা আনন্দ উপভোগ করে। জাতীয় ও ধর্মীয় বিভিন্ন উৎসব ছাড়াও বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পালিত হয় নানা ধরণের মেলা,খেলা ও লোকজ উৎসব। এবার বাংলাদেশের তেমন কিছু মেলা, খেলা ও লোকজ উৎসবের সাথে পরিচিত হওয়া যাক।
পিঠা উৎসব- বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। সেই ষড়ঋতুর একটি ঋতু শীতকাল। শীতকালের নানা রকম পিঠার মজাই আলাদা। শহর নগরের স্যান্ডুইচ, বার্গার এর মধ্যে আবহমান গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির নানান বাহারি পিঠা সত্যিই এক ভিন্ন মাত্রা বহন করে। প্রতিবছর চট্টগ্রাম শহরের ডিসি হিলে আয়োজিত পিঠা উৎসব তেমনি এক চমকপ্রদ উৎসব। নানা রকম বাহারি পিঠা যেমন- হৃদয় হরণ পিঠা, গোলাপ পিঠা, ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পাটিসাপটা, নকশি পিঠা, কলা পিঠা, শামুক পিঠা, বাঁশের পিঠাসহ আরো নানা ধরণের পিঠার সমাহার পিঠা উৎসবকে দেয় ভিন্ন এক মাত্রা । পিঠা উৎসবকে ঘিরে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা,সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন কারা হয়। পিঠা গ্রাম বাংলার নিজস্ব আভিজাত্যপূর্ণ খাদ্যদ্রব্য। এটি চালের গুঁড়ো, আটা, ময়দা, অথবা অন্য কোনও শস্যজাত গুঁড়ো দিয়ে তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের অঞ্চলভেদে পিঠার ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র পরিলক্ষিত হয়। গ্রামে নতুন ধান তোলার পর থেকেই পিঠা তৈরির আয়োজন করা হয়। শীতের ও পৌষ পার্বণের সময় বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে পিঠা তৈরি অতি স্বাভাবিক একটি ঘটনা। পিঠা সাধারণত মিষ্টি স্বাদের হয়ে থাকলেও ঝাল, টক বা অন্য যে কোনও স্বাদেরও পিঠে তৈরি হয়। শীতের সাথে যেনো হাজির হয় পিঠা উৎসব। শীতের সকালে খেজুর রসের স্বাদই আলাদা। রসে ভেজানো পিঠার ঘ্রাণ টানে সকল শ্রেণির মানুষকে। পিঠা উৎসব এখন ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নানা রকম পিঠা তৈরি করে এক ধরনের আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে।
নবান্ন উৎসব- আবহমান গ্রাম বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল লোকজ আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম। ‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। আর এই নবান্ন উৎসব হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত এক ধরনের লোকজ উৎসব। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয় । নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী প্রকৃতিকে নিবেদন করা নবান্নের অঙ্গ একটি বিশেষ লৌকিক প্রথা। এক সময় অত্যন্ত সাড়ম্বরে নবান্ন উৎসব উদযাপন হত,সকল মানুষের সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে নবান্ন উৎসব সমাদৃত ছিলো সকলের কাছে। কালের বিবর্তনে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই নবান্ন উৎসব বিলুপ্তপ্রায়। ১৯৯৮ সন থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উৎসব উদযাপন শুরু হয়। জাতীয় নবান্নোৎসব উদযাপন পর্ষদ প্রতিবছর পহেলা অগ্রহায়ণ তারিখে নবান্ন উৎসব উদযাপন করে। চট্টগ্রামের ডিসি হিলেও জাঁকজমকের সহিত নবান্ন উদযাপিত হয়। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে যেসব আচার, অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়- নবান্ন তার অন্যতম। নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐহিত্য ও সংস্কৃতি। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায় এই উৎসবকে ঘিরে।
মেজবান- চট্টগ্রাম এলাকার বহুমাত্রিক ঐতিহ্যবাহী একটি অনুষ্ঠান মেজবান। চট্টগ্রামের ভাষায় একে ‘মেজ্জান’ বলা হয়। সাধারণত কারো মৃত্যুর পর কুলখানি, চেহলাম, মৃত্যুবার্ষিকী, শিশুর জন্মের পর আকিকা উপলক্ষে, ধর্মীয় ব্যক্তির মৃত্যু বার্ষিকীতে মেজবানের আয়োজন করা হয়। এছাড়া নির্দিষ্ট উপলক্ষ ছাড়াও বা কোনো শুভ ঘটনার জন্যও মেজবান করা হয়। চট্টগ্রামের এই ঐতিহ্যবাহী মেজবানে এক ধরণের উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। চট্টগ্রামের এই মেজবানের দেশব্যাপী সুখ্যাতি রয়েছে। আনন্দ উৎসবকে কেন্দ্র করে মেজবান দেয়া হলে সেখানে এক ধরনের উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। তাই আবহমান গ্রাম বাংলার এক ঐতিহ্যম-িত উৎসবের নাম মেজবান।
সাম্পান উৎসব- সাম্পান চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এক নাম। এ সাম্পানকে নিয়ে চট্টগ্রামে রচিত কতো গান , কবিতা , কাব্যগাথা। তাই সাম্পান নামটিও যেনো চট্টগ্রামের সাথে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী সাম্পান উৎসব। রঙ-বেরঙের বহু সাম্পান এতে অংশ নেয়। এ উপলক্ষে নদীর দুই পাড়ে জড়ো হয় কয়েক হাজার মানুষ। অভয় মিত্র ঘাট এলাকা থেকে শুরু হয় এ সাম্পান প্রতিযোগিতা। কর্ণফুলীর সাম্পানওয়ালাদের পাশাপাশি এতে অংশ নেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মাঝিরা। চট্টগ্রামের মানুষের এ যেনো এক প্রাণের উৎসব। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছুটে আসে নানা শ্রেণি পেশার মানুষ এ সাম্পান উৎসব দেখার জন্য।
হালখাতা উৎসব- হালখাতা উৎসব বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। বাংলা বছরের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা তাদের আগের বছরের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে এদিন হিসাবের নতুন হিসাবের খাতা খোলেন। এজন্য খদ্দেরদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় ‘শুভ হালখাতা কার্ড’-এর মাধ্যমে ঐ বিশেষ দিনে দোকানে আসার নিমন্ত্রণ জানানো হয়। এই উপলক্ষে নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা তাদের খদ্দেরদের মিষ্টিমুখ করান। খদ্দেররাও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পুরোনো দেনা পরিশোধ করে দেন। আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা একটি মাত্র মোটা খাতায় তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। এই খাতাটি বৈশাখের প্রথম দিনে নতুন করে হালনাগাদ করা হতো। হিসাবের খাতা হাল নাগাদ করা থেকে‘হালখাতা’শব্দের উদ্ভব। এ উপলক্ষে ছাপানো হতো নিমন্ত্রণপত্র, চলতো নানা আয়োজন, উৎসব উদ্দীপনার মধ্যে অনুষ্ঠিত হতো হালখাতা উৎসব। গ্রামের হালখাতাতে ব্যবসায়ীরা বৈশাখের প্রথম দিনে সকালে এসে দোকান পরিষ্কার করে ফুল দিয়ে নানা বর্ণিল সাজে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সাজাতো। ক্রেতাকে আপ্যায়ন করতো রসগোল্লা, জিলাপি, খাজা, দই চিড়া ও মুড়ি দিয়ে। আর শহরের ব্যবসায়ীরা হালখাতার দিনে নানা রঙে আলোকসজ্জার মাধ্যমে দোকানকে বর্ণিল করে তুলতো। আর খরিদ্দারকে আপ্যায়ন করার জন্য মিষ্টান্ন, পোলাও মাংস ব্যবস্থা রাখতো। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যর এই প্রাণের হালখাতা উৎসব যেন আজ আধুনিক ডিজিটাল যুগের অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ক্রেডিট কার্ড আর ডেবিট কার্ড এর মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের যুগে অনেকটাই ম্লান। তবুও গ্রাম শহরের ঐতিহ্যম-িত ব্যবসায় অঞ্চলে সেই হালখাতার উৎসব যেনো এখনো পুরানো সেই স্মৃতিকে আমাদের নানভাবে মনে করিয়ে দেয়।
বই উৎসব- ইংরেজি সনের প্রথম দিনেই সারাদেশের প্রতিটি উপজেলার গ্রামে গ্রামে, শহর ও নগরে অনুষ্ঠিত হয় বই উৎসব। ইংরেজি জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন সকাল থেকে দেশের প্রাথমিক , মাধ্যমিক ও মাদ্রাসার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে বই বিতরণ করা হয়। শিশুকিশোরদের মধ্যে এ নতুন বই বিতরণ এক ধরণের নতুন উৎসবের আনন্দ ছড়িয়ে দেয়। নতুন বইয়ের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে শিশুকিশোর শিক্ষার্থীরা। নতুন বই হাতে শিক্ষার্থীদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ছুঁয়ে যায় শিক্ষক ও অভিভাবকদের মনও। এই বই উৎসব দেশে ধীরে ধীরে জাতীয় উৎসবে পরিণত হচ্ছে।
বসন্ত উৎসব- বাংলা সনের পহেলা ফাল্গুন হলুদ পাঞ্জাবি আর বাসন্তি রঙয়ের শাড়ি, ঢোলের বাদ্য, বেহালার সুর, নৃত্য, গান, আবৃত্তি আর কথামালায় পালিত হয় দিনব্যাপী বসন্ত উৎসব। সারা দেশের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এ উৎসবের আয়োজন করে। চট্টগ্রামে বসন্ত উৎসবের সবচেয়ে বড় আসরটি বসে ডিসি হিল প্রাঙ্গণে। সিআরবি শিরীষ তলায়ও বসন্ত উৎসব উদযাপিত হয়। সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে নানা আয়োজনে বসন্ত উৎসব এক ধরনের ভিন্ন আবহ সৃষ্টি করে।
নৌকা বাইচ-বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। আর এই নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকাবাইচ লোকায়ত বাংলার লোকসংস্কৃতিরই একটি ঐতিহ্যম-িত অংশ। তবে কবে লোকায়ত বাংলার এই ঐতিহ্যম-িত গণবিনোদন হিসেবে নৌকাবাইচের প্রচলন হয়েছিলো তার সঠিক ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আনন্দ আয়োজন, উৎসব ও খেলাধুলা সবকিছুতেই নদী ও নৌকার সরব উপস্থিতি। হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক বিনোদনের সংস্করণ বাংলাদেশের নৌকা বাইচ। সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বহমান নদীতে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতির এক ঐতিহ্যেরই অংশ।
লোকজ বলী খেলা-আবহমান বাংলার ঐতিহ্যম-িত একটি লোকজ খেলার নাম বলীখেলা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঐতিহ্যম-িত এই লোকজ খেলা সেই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এক ধরনের উৎসবের আমেজ সৃষ্টি করে। বলীখেলা এক বিশেষ ধরনের কুস্তি খেলা। এই বলী খেলার জন্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলী খেলার নাম সর্বজনবিদিত। এই বলী খেলাকে চট্টগ্রামে এক ধরনের উৎসব বিরাজ করে। এই লোকজ উৎসবকে ঘিরে বসে বিশাল মেলা। ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এই প্রতিযোগিতার সূচনা করেন। চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে প্রতিবছরের ১২ই বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয়। সারাদেশে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বলী খেলার ব্যাপক পরিচিতি আছে। সারা দেশে বিক্ষিপ্তভাবে বলী খেলা আবহমান বাংলার লোকজ উৎসবেরই একটি অংশ। বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গন ছাড়া এরকম খেলা আর কোথাও দেখা যায় না।
ষাঁড়ের লড়াই -বাংলাদেশে ষাঁড়ের লড়াই একটি প্রসিদ্ধ খেলারূপে একসময়ে প্রচলন ছিল। এই ষাড়েঁর লড়াই করার জন্য ষাঁড়কে আলাদাভাবে লালন পালন করা হতো। ষাঁড়টিকে মোটাতাজা করা হতো শুধু লড়াই করার জন্য। শুকনো মৌসুমে গ্রামের বাজারে ঢাকঢোল পিটিয়ে ষাঁড়ের লড়াই দেখার আমন্ত্রণ জানানো হতো। মাঠে ষাঁড়ের মালিকগণ তাদের ষাঁড়গুলোকে বিভিন্ন সাজে সজ্জিত করে নিয়ে আসতেন। দু’দিকে দুজন ব্যক্তি রশি দিয়ে বেঁধে নিয়ে এসে দু’পক্ষের ষাঁড়কে ছেড়ে দিয়ে সবাই মিলে ঢাক ঢোল পিটিয়ে ও বিভিন্ন তালে তালে গান করত। এভাবে উপস্থিত সকল ষাঁড়ের মধ্যে যে ষাঁড়টি প্রথম স্থান পেত তাকে পুরস্কার দেয়া হতো। সে পুরস্কার গরুর গলায় বেঁধে বাজারে বাজারে দেখানো হতো। গ্রামীণ এই লোকজ খেলা বর্তমানে প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবুও কখনও কখনও এধরনের খেলার সংবাদ মেলে।
বাংলা নববর্ষ-বাংলা পঞ্জিকার বৈশাখের প্রথম মাস বৈশাখের প্রথম তারিখ অর্থাৎ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি সকল বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন। দিনটি বাংলাদেশ বাংলা নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লোকউৎসব হিসাবে বিবেচিত। দিনটি বাংলাদেশ সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গৃহীত। এই উৎসবকে ঘিরে শোভাযাত্রা, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেলা, পান্তাভাত খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়।
বর্ষা উৎসব- বর্ষা উৎসব যার অন্য নাম- বর্ষা বরণ বা বর্ষা মঙ্গল উৎসব। বাংলাদেশে বর্ষাকালকে বরণ করে নেওয়ার জন্য দিনব্যাপী পালিত উৎসবই হচ্ছে বর্ষা উৎসব। বাংলা বর্ষপঞ্জির তৃতীয় মাস আষাঢ়ের প্রথম দিন বর্ষা উৎসব পালিত হয়। দিনটি গান, নাটক, কবিতা আবৃত্তি, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, পুতুলনাচ, ইলিশ উৎসব প্রভৃতি আয়োজনের মাধ্যমে উদযাপিত হয়। বর্ষার আছে একটি নিজস্ব সুর। সেই সুরের আমেজ পেতেই নগর জীবনে যেনো বর্ষা উৎসবের আয়োজন।
পৌষ মেলা- বাংলা একাডেমি চত্বরে প্রতি বছর পৌষমেলা অনুষ্ঠিত হয়। পৌষমেলার উদ্দেশ্য হলো গ্রামীণ জনপদের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বর্ণিল মেলার চিত্রকে ক্ষুদ্র সংস্করণের মাধ্যমে নগরবাসীর সামনে তুলে ধরা। প্রতিবছর শত শত দর্শনার্থী এই পৌষ মেলায় আসেন। তবে পৌষ মেলার জন্য বিখ্যাত হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলার শান্তি নিকেতন। এখানে অনুষ্ঠিত হয় একটি বার্ষিক পৌষ মেলা ও উৎসব। এই মেলার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বাংলা লোকসংগীত- বিশেষত বাউল গানের অনুষ্ঠান।
বাউল উৎসব-বাউল একটি বিশেষ লোকাচার ও একটি আধ্যাত্মিক মতবাদ। এই মতবাদ বা ধারা সৃষ্টি হয়েছে আবহমান বাংলার এই মাটিতেই। বাউল স¤্রাট লালন সাঁইয়ের গানের মধ্য দিয়ে এই বাউল মত প্রতিষ্ঠিত হয়। বাউল গান যেমন জীবন দর্শনের সাথে সম্পৃক্ত, তেমনই সুর সমৃদ্ধ একটি ঐতিহ্যম-িত সংগীতেরও একটি ধারা। বাউলদের সাদামাটা জীবন আর একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোই যেনো তাদের চিরায়ত জীবনাচার। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমুহের মাঝে বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বাউল উৎসব অনুষ্ঠানের সংবাদ মেলে । এ উৎসবে দেশের নানা অঞ্চল থেকে বাউলরা যোগ দেয় এবং বাউল গানে উৎসবকে মুখরিত করে তোলে। এটি বাংলার গ্রামীণ জনপদের একটি লোকজ ঐতিহ্যেরও অন্যতম অংশ।
চৈত্র সংক্রান্তি- বৈশাখের আগে ঋতুরাজ বসন্তের আগমনও বাঙালির উৎসব। যেটাকে আমরা বসন্ত উৎসব বলি। তেমনি প্রাচীন প্রথানুসারে বসন্তের বিদায়ও হয় উৎসবের মাধ্যমে। বসন্তের শেষ মাস চৈত্র,আর চৈত্রের শেষ দিন চৈত্র সংক্রান্তি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, চৈত্র সংক্রান্তি ধর্মীয় আচার থেকে লোকসংস্কৃতির অংশ হয়েছে। এদিনে আচার অনুষ্ঠানকে পূণ্যের কাজ গণ্য করা হয়। চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবেও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির চিরায়ত সব বাহারি খাবারের আয়োজন হয়। গ্রাম ছাপিয়ে শহরে ও নগরে চৈত্র-সংক্রান্তির উৎসব বড় হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে। বাড়ছে উৎসবের এই উৎসবের পরিধিও।
ঘুড়ি উৎসব- আজ থেকে প্রায় দুই হাজার আটশত বছর আগে চীনে ঘুড়ি উড়ানো শুরু হয়। পরবর্তীকালে এটি এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন বাংলাদেশ, ভারত, জাপান এবং কোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও ইউরোপে ঘুড়ি উড়ানো খেলাটির প্রচলন ঘটে প্রায় ষোল’শ বছর আগে। কাগজ দিয়েই সাধারণত ঘুড়ি বানানো হয়। বিশ্বজুড়েই ঘুড়ি ওড়ানো একটি মজার খেলা। এছাড়াও বহু দেশে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ঘুড়ি ওড়ানো একটি বিনোদনমূলক অবসর বিনোদন। বাংলাদেশে, বিশেষ করে পুরনো ঢাকায় পৌষ মাসের শেষ দিন, অর্থাৎ পৌষ সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানো উৎসব পালন করা হয়। এছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে ঘুড়ি ওড়ানো প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়।
লালন উৎসব- বাউল স¤্রাট ফকির লালন শাহের তিরোধান দিবস উপলক্ষে কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়িতে হয় আলোচনা সভা, লালন সংগীতানুষ্ঠান ও লালন মেলা। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন সহযোগিতায় লালন একাডেমি এ মেলার আয়োজন করে। লালন উৎসব উপলক্ষে উপলক্ষে লালন মাজারকে সাজানো হয় নানান সাজে। মাজারের ভেতরে লালন একাডেমির আশপাশ এলাকায় বসে বাউল ফকিরদের আলাদা আলাদা আসর। বাইরে উন্মুক্ত লালন মঞ্চে চলে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উৎসবকে ঘিরে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় কালি নদীর পাড়ে বসে লোকজ মেলা।
মধুমেলা- যশোরের কেশবপুরে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মস্থান সাগরদাঁড়িতে তাঁর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মধুমেলা মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার রূপকার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজসংস্কারের সূচনা করে গেছেন। বাঙালি জাতি তার জন্য গর্বিত। তাঁর এ অবদানকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই মধু মেলার আয়োজন। মধুমেলায় রাতে মধু মঞ্চে নাটক, কবিতা আবৃত্তিসহ মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক নাটক, যাত্রা, নৃত্যসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত শিল্পীরা গান পরিবেশন করেন। মধু ভক্তদের আকর্ষণীয় করার জন্য মধুমেলায় বসে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সার্কাস, জাদু প্রদর্শনী, মৃত্যুকূপ, নাগরদোলা, ইঞ্জিনচালিত ট্রেন ও বিভিন্ন ভ্যারাইটি স্টলসহ নানা ধরনের স্টল। মধুমেলা উপলক্ষে কবির জন্মভূমির স্মৃতিবিজড়িত কপোতাক্ষ নদ, জমিদার বাড়ির আ¤্রকানন, বুড়োকাঠ বাদাম গাছতলা, বিদায় ঘাটসহ মধুপল্লীতে মধু ভক্তদের মিলন মেলায় পরিণত হয়।
জসিম মেলা- ফরিদপুর শহরতলীর অম্বিকাপুরের পল্লীকবি জসীম উদ্যানে জসীম পল্লী মেলার আয়োজন হয়। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসন ও জসীম ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ মেলার আয়োজন করে। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে অম্বিকাপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে কবির সমাধিসংলগ্ন জসীম উদ্যানে এ মেলা আমাদের অন্যতম লোকজ মেলায় পরিণত হয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে ফরিদপুরে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
হাসন রাজা উৎসব- বাংলাদেশের একজন মরমী কবি এবং বাউল শিল্পী হাসন রাজা। মরমী কবি হাসন রাজার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সুনামগঞ্জে হয় হাসনরাজা লোক উৎসব। সুনামগঞ্জ শহরের জুবিরী স্কুল সংলগ্ন বালুর মাঠে স্থানীয় শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে তাঁর বিখ্যাত গান ‘বাউলা কে বানাইলোরে’ এবং ‘লোকে বলে বলেরে’ এসব গানের মধ্য দিয়ে উৎসবের সূচনা হয়। মেলায় হাসন রাজার জীবন ও দর্শন নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি জাতীয় ও স্থানীয় শিল্পীরা বাউল গান পরিবেশন করে।
বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম উৎসব- সুনামগঞ্জের বরাম হাওরের তীরবর্তী উজানধল গ্রামের মাঠে হয় শাহ আবদুল করিম লোকজ উৎসব। উৎসবে বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের জীবন দর্শন,গান ও তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং লোকজ মেলার আসর বসে।
সুলতান মেলা- বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে নড়াইলে বসে সুলতান মেলা। নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের সুলতান মঞ্চ চত্বরে জেলা প্রশাসন ও এস এম সুলতান ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ মেলার আয়োজন করে।
মাছ ধরা উৎসব- সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায় প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে মাছধরা উৎসব নামে এক ব্যতিক্রমী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এ অঞ্চলের এক হাওড় এলাকায় এ মাছধরা উৎসবে ঐ এলাকার বিভিন্ন অঞ্চল হতে মাছ ধরার গ্রামীন ঐতিহ্যের নানা উপকরণ নিয়ে মাছ ধরতে আসে। বিভিন্ন মিডিয়াতে এ সংবাদ গুরুত্বসহ প্রচারিত হয়।
আবহমান গ্রাম বাংলার এসব মেলা,খেলা ও লোকজ উৎসবগুলো ছাড়াও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে নানা ধরণের উৎসব। যেগুলো একান্তই বাঙালির। বাঙালির প্রাণের এসব অনুষ্ঠান বাঙালি সংস্কৃতিরই অংশ । পৃথিবীর আর কোন জাতির মধ্যে এমন বৈচিত্রময় মেলা, খেলা ও উৎসবের দেখা মেলা ভার। এসব উৎসবকে ঘিরেই আবর্তিত হয় বাঙালির সুখ দুখের প্রাত্যহিক জীবনযাপন।