‘বাংলায় কাক ও কবির সংখ্যা সমান সমান’ – তির্যক বিজুরি-বাজ সহসা খেলে গেলো কার মুখের প্রসাদে, সেদিন এক কৌতুক আড্ডায়।
দোষ নিজের। কবির স্বভাব ধর্মে, নতুন কিছু লেখা হলেই তা শোনানোর ব্যাকুলতা দুলে ওঠে। ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর’ লিখে নতুন বৌঠানের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন রবি, কিংবা ‘ বিদ্রোহী ‘ লেখার পর নজরুলের সেই উদ্ভ্রান্ত অবস্থার কথা – আজ তেমন এক প্রমাণিত বিষয়।
এখানেও পরিচিত ভূমি পেয়ে কথার ছলে যেই বলে ওঠা – ‘ একশত সেরা বাংলা কবিতায় আমার ‘ ঈশ্বর ‘ ‘শূন্য ঈশ্বর ‘ কবিতা দু’টো থাকা উচিত’। যদিও মনে মনে- এতো এতো বাংলা কবিতার রত্নাকরে এক হাজারের মধ্যে থাকলে, নিতান্তই বন্ধু – বান্ধবীরা এই স্বীয় ঢাক নিজে পেটানোর সুবাদে কবিতা দু’ টোর অস্তিস্থ জানান দেওয়ার খুশিতে খানিক মশগুল হতে না হতে নিউটনের ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া মতো ঝলসে ওঠা সশব্দ এমন মন্তব্য। চারপাশে থাকা সতীর্থ ও অনুজদের হাসি হাসি মুখ দেখে মাকে নিয়ে লেখা ‘ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কবিতাখানি ‘ ও ‘ বনলতা সেন’ এর প্রতিপক্ষ ‘ রুপনারী ‘ র কথা মুখে এসেও আটকে গিয়েছিল ভাগ্যিস্। তার আগেই যে ছুটে এলো বিষ্ফোরক কথার ঢিল। অগত্যা কী-বা করা! সান্ত¡না কেবল হুমায়ুন আহমেদ এর সংলাপ মনে রেখে – ‘মানুষের মুখ তো আর বন্ধ করা যায় না’!’
কিন্তু কবিদের এসব পাগলামো প্রায় সবাই মেনে নেন সহজিয়া আনন্দে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য সেই চট্টগ্রাম কলেজ থেকে সতীর্থ বন্ধু ইসমাইল খান আর-ও আর-ও কতক কবির এরকম উন্নাসিকতার উদাহরণ টেনে বাণী দিলেন- ‘ কবিদের এমনতরো উদ্ভট আচরণ তাঁকে আনন্দ দেয়, এজন্য কবি মাত্রই তাঁর খুব পছন্দের মানুষ ‘। যাক্ এ যাত্রা বাঁচা গেলো।
শরৎচন্দ্র কে এক সভায় পৌরহিত্য করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে, সেই সভায় আরও জনৈক নামজাদা বাগ্মী থাকবেন বলা হলে, শরৎচন্দ্র বিশিষ্ট বাগ্মী সম্পর্কে সহাস্যে জিজ্ঞেস করেন-‘ থামতে জানে তো ! ‘ একথাও ঠিক বর্ষাক্রান্ত বাঙালি কবিদের মধ্যে এক রবীন্দ্রনাথ-কে বাদ দিলে খুব কম জন তালিকাই থাকবেন, যাঁরা অচঞ্চল ছিলেন বা থামতে জানেন সঠিক। বৃহতের দলে থাকবো কি?
নজরুল যে মোটেই স্থিতধী ছিলেন না, তার ভুরি ভুরি প্রমাণ । দুলি বা দোলনচাঁপা যাঁর নাম রেখেছিলেন প্রমীলা, তাঁর সাথে প্রেম- বিয়ে সম্পাদনের আগে পরে নার্গিস, ফজিলাতুন্নেছা ও আরও কতক ঘিরে তাঁর বাঁকা হাতের বাঁশরি বেজেছে বেহিসাবি রাগিণী -তে। অন্তত বিশ্বজিৎ চৌধুরী বেশ চৌকস রূপটান এঁকেছেন নজরুলের প্রেম-পিয়াসী চরিত্র উন্মোচনে। তবে বিশ্বজিৎ এর প্রতি অনুযোগ এই, কেন তিনি নার্গিস নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদনে নার্গিসের পড়ন্ত প্রৌঢ় বয়সের চোখে ছানি পরা ছবি বাজারে নিয়ে আসলেন। বাঙালি নারীর চিরন্তন আবেদনি প্রতীক সুচিত্রা সেনেরও শেষ বয়সের ছবি বিদঘুটে কৌতূহলী জন মিডিয়া ভুবনে ছড়িয়ে দিয়েছে। আমরা যারা রূপ-মায়া কাননের বাসিন্দা, আমরা-তো তা চাইনে।
আগের কথাই আসি। সংখ্যাতত্ত্ব সমীকরণ যাই হোক না কেন, প্রতিটা বাঙালি চিত্ত অন্তত দু’ লাইন কবিতা লিখতে বা আওড়াতে যে সদা উদগ্রীব, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে ছেলে-মেয়ে, শিশু, ঠাকুর দা, ঠাকুরমা, দাদা-দাদী নানা- নানি সবাই। প্রশ্ন – এই ভাবপ্রবণ জাতির প্রধান অনুঘটক তাহলে কি জল ছলছল মেঘ- মল্লার রাগের বিস্তারে উচ্ছল বর্ষা !
সারস্বত দুনিয়ায় বাঙালির সীলমোহর দেওয়া পরিচয় হলো ‘ তার্কিক জাতি ‘ রূপে। গবেষণা সূত্রমতে বাঙালির আবার সর্বপ্রধান প্রিয় শব্দ হলো ‘ না ‘। যেখানে বিট্রিশ-দের প্রধান ব্যবহৃত শব্দ ‘এবং’, ‘অথবা’। বিষ্ময়ের বিষয় এরকম নেতিবাচক শব্দ ব্যবহারকারি এক জাতিগোষ্ঠী ৭১’ এর ৭ ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ” এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম / এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম “- আটত্রিশ নক্ষত্র বর্ণমালা গাঁথা স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠতম সোনালি কবিতার আগুনে উদ্দীপিত হয়ে সকল ধর্ম-বর্ণ মিলে রক্ত ও সম্ভ্রমের আত্মদানে ৭১’ এর ডিসেম্বরে-ই রচনা করেছে স্বাধীন বাংলাদেশ মানচিত্র। সুতরাং বাঙালি যে কবিতার ভাষা ভালো বোঝে, তা নিঃসন্দেহ।
কিন্তু এই যে অসংখ্য কবি সুজলা-সুফলা,শস্য-শ্যামলা কালো সোনার মতো উর্বরা মাটির দেশে জন্মাবে তা কে জানতো ! বুদ্ধদেব বসুর মতে উপমহাদেশে ‘ বর্ষা ও বিরহ ‘ অনুভূতি ‘ কবি কালিদাসের ‘ মেঘদূত ‘ এর সৃষ্টিকর্মে চিরস্থায়ী চিত্ররূপ পেয়েছে। বর্ষায় যাপিত জীবন উপসংহারে মধূসুদন যদিও লিখলেন- ‘ রমণী রমণ নিয়ে খেলা করে / দেব গান্ধর্ব যক্ষ সুখিত অন্তরে’, বস্তুত চর্যাপদ ক্রমে বিদ্যাপতির সেই আর্তি যেন জমে ওঠে মেঘস্বরে – ‘ এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর/ এ ভরা বাদর মাহ ভাদর / শূন্য মন্দির মোর ‘।
বৃষ্টি দানার মতো সরল ছন্দে ফররুখ আহমদ বর্ষা-তুলি টানলেন – ‘বৃষ্টি এলো কাশবনে/ জাগলো সাড়া ঘাসবনে ‘। আর শিরায় শিরায় বর্ষাকে ধারণ করা কবিতায় অমিয় চক্রবর্তী-র কবিতার চরণ- ‘অন্ধকার মধ্যদিনে বৃষ্টি ঝরে মনের মাটিতে ‘। শামসুর রাহমানের বর্ষাঘোর উচ্চারণ – ‘মুগ্ধাবেশে মনে হয় / আষাঢ় তোমার মন আর/ শ্রাবণ হৃদয় ‘।
ড. মহীবুল আজিজ এর সঙ্গে এক আলাপচারিতায়, তিনি কেমন করে যেন বলে গেলেন-‘ প্রেম এবং বর্ষায় রবীন্দ্রনাথ অনতিক্রম্য’ । এমন অব্যর্থ বাক্যের দূতিকা মেনে নিয়ে মূহুর্তে হয়ে রইলেম চুপ – গন্ধ বিধুর ধূপ। গীতবিতানে ষড়ঋতুর মধ্যে সর্বাধিক ১২০ গান বর্ষাবরণে নিবিড় থেকে রবীন্দ্রনাথ এই ঋতুর প্রতি র্তাঁর পক্ষপাতিত্ব উন্মুক্ত করেছেন।
প্রত্যেক বাঙালিকে কবিতা দিয়েছে বাংলার বর্ষা। বাঙালি চৈতন্যের সৃজনশীলতা শতমুখী ধারায় উৎসারিত হয়েছে স্বর্ণ সুযোগে লুকোচুরি খেলা মেঘ ও রৌদ্রের অক্ষর, বর্ষা জলতরঙ্গ। বাঙালি তাই অন্তর অবগাহন থেকে বর্ষা ভালবাসে, কবিতা ভালবাসে, কবি ভালবাসে। বাঙালিকে যদি ভাত না কবিতা, কোনটা ভালবাসে বেশি জানতে চাওয়া হয়, স্থির বিশ্বাস, বাঙালি মুখমন্ডলে চাঁদ হাসি ছড়িয়ে জবাব দেবে – ‘প্রয়োজনে ভাত দু’ একবেলা কম খাবো, কিন্তু কবিতা আমার চাই- ই।
আহমদ ছফা জানাচ্ছেন – রবীন্দ্রনাথ কোথাও কড়া আলো ফেলেননি। আর ‘সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে’ র এই বিশ্বকবি, যেটুকু তাঁকে পড়েছি, দেখলাম আত্মবিশ্বাসের জোরে শুধু এক জায়গায় ভবিষ্যৎবাণীর মতো বললেন- ‘ বাঙালিকে তাঁর গান গাইতে-ই হবে ‘। দ্বিতীয়, তেমন আত্মপ্রত্যয়ী সুর বাজলো তাঁর ‘ বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল ‘গানে। বলতে শুনি- ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছো দান/ আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান’। এরপরে – ‘আজ এনে দিলে, হয়তো দিবে না কাল/ রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল। আমার এ গান শ্রাবণে শ্রাবণে, তব বিস্মৃতি স্রোতের প্লাবনে, ফিরিয়া ফিরিয়ে আসিবে তরণী বহি তব সন্মান।’
বাংলার বর্ষা নজরুলের উথাল-পাতাল সৃষ্টি সম্ভারে অপূর্ব জোয়ার তুলবে, তা একপ্রকার নিশ্চিত-ই ছিল। গীতিকার নজরুল তা পৌঁছেও দিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। রাধিকা অভিসারিকার বর্ননায় ‘ নীলাম্বরী শাড়ি পরে কে যায় নীল যমুনায় ‘ বা অনুপ ঘোষালের কণ্ঠে শ্রুত ‘মেঘ মেদুর বরষা ‘ শুনলেই অধীরা চপলা অকূলা দুকূলা যমুনা সংগ বর্ষাপ্রিয়ার পরিপূর্ণ উপস্থিতি টের পাওয়া যায় ।
তার সাথে আজ – ‘দিনের বেলায় নেমে এলো রাত- তাইতো চাইছি / আষাঢ়িমা দেবে কিনা বলো সুন্দর!’যেন বহু যুগের ওপার হতে সুন্দর- কাতর আর এক কবিপ্রাণ বঁধুয়ার কাছে আকুতি জানাতে থাকে এই ভাষাতে। কেননা এখন যে ‘কবিতার মতো বৃষ্টি ঝরে / সৌন্দর্যের গন্ধ-ফুল হাতে / কে আছে অপেক্ষা করে!’
এমন কোন কি বাঙালি বালিকা, রমণী, বধূ আছে- যে বাংলার আকাশ হতে ঝরঝর মুখর শুভ্র পবিত্র রুপালি বৃষ্টি-ফুল মাথার খোঁপায় পরেনি! এমন কোন বাঙালি কবি কি আছেন যিনি বর্ষাগম কলমে পুরাতন হৃদয়ে নতুন পুলকে বেজে অনুভব উপলব্ধ একবার বলে ওঠেননি – ‘জানলেম, আজ জানালেম, মিনতি বিনীত পরিচয় আমার / আমি কবি, বাংলার, বর্ষার’।
লেখক : প্রফেসর ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশু স্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।