আমীরুল ইসলাম (১৯৬৪-)। সমকালীন শিশুসাহিত্যে অত্যন্ত সচল ও উল্লেখযোগ্য নাম। গদ্য ও পদ্য – উভয় মাধ্যমে তিনি শুধু সক্রিয় নন, স্বতঃস্ফূর্তও। কলাকৌশলের নতুনত্ব, ভাষার চমকপ্রদ ভঙ্গিমা, অদ্ভুত শব্দযোজনা ও বিষয়-বৈচিত্র্যের কারণে তাঁর রচনাগুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়। তাঁর ছড়ায় যেমন অভিনবত্বের সাক্ষাৎ মেলে, তেমনি পাওয়া যায় গতিশীল ও রঙিন ছবি। তাঁর লেখায় অকারণ বিশেষণের ছড়াছড়ি নেই, বিষয়-বর্ণনায় বাড়াবাড়ি নেই, ছন্দ-মিলের জোরজুরি নেই, ভাববিলাসের উচ্ছ্বাসও নেই; যা আছে-অকৃত্রিম ও অনন্য। তাঁর লেখায় ফুটে ওঠে লেখকের উচ্চাশা, আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন ও আত্মসচেতন মনের আঙিনা। দৃষ্টিভঙ্গির বিশেষত্ব, চতুর্মুখী চিন্তাক্ষেত্র এবং ছন্দের তির্যক গতি তাঁর লেখার মূল ভিত্তি। তিনি সবসময় জীবনের আলোকিত দিকের কথা তুলে ধরেন, বলেন স্বপ্নের কথা – সম্ভাবনার কথা। তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য স্পষ্টতা, সরলতা ও সাবলীলতা। তিনি বক্তব্য প্রকাশে যেমন অকুণ্ঠ, তেমনি পঙ্ক্তি নির্মাণে উজ্জ্বল রৌদ্রদীপ্ত। তাঁর ছড়া-কবিতার অবয়বে আছে এক ধরনের বিশেষ আমেজ ও আবহ সৃষ্টিকারী শক্তি। আঙ্গিক ও পঙ্ক্তি বিন্যাসে যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, ছন্দ-মাত্রা-পর্বে ভাঙচুর করেছেন, বাক্যবিন্যাসের বৈচিত্র্যে ও বৈভবে উপহার দিয়েছেন চিত্রল-সঙ্গীত। শব্দময়তার কারণে পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে অপূর্ব ধ্বনিময়তার আবেশ সঞ্চারিত হয়েছে। বর্ণিল, স্বপ্নময়, অভিনব ও আধুনিক ছড়ার নির্মাতা হিসেবে তিনি পেয়েছেন জনপ্রিয়তা, পেয়েছেন পাঠকের ভালোবাসা ও স্বীকৃতি।
২.
আমীরুল ইসলামের রচনার প্রধান উপলক্ষ শিশু, প্রধান উপজীব্য বিষয় হচ্ছে শিশুজগত। শিশুর স্বপ্নময় ভুবনটা তাঁর রপ্ত। শিশুর স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার জিনিসগুলোকে রূপে-রসে-গন্ধে জীবন্ত করে তুলেছেন তাঁর রচনায়। তিনি বলেন : ‘স্বপ্ন আমার স্বপ্নমাখা শিশুর মুখের হাসির জন্য’। শিশুর ইন্দ্রিয়জগত, শিশু হাসি-খুশি, আনন্দ ধ্বনি ও অভিমানের কথা চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। শিশুর মুখের হাসিই তাঁর প্রত্যাশা।
আইকম বাইকম
আমি ভাই খাই কম,
শুধু দুটো মুরগি
এক কেজি গুড়-ঘি।
সেই সাথে তেহারী
রুটি আর নেহারী
বিরিয়ানি কাচ্চি
সারাদিন খাচ্ছি।
ধেই ধেই নাচছি
খুব মজা পাচ্ছি।
আইকম বাইকম
আমি ভাই খাই কম।
এই ছড়ার ‘আমি’ মানুষটার সাথে পরিচয় ঘটলে যে কোনো শিশুই অন্য ধরনের আনন্দ পাবে। সারাদিন এতো খায় লোকটা, তবু সে বলে – ‘আমি ভাই খাই কম’। এ রকম অনেক ছড়া আছে, যেখানে রয়েছে বিস্ময় ও হাসির প্রাচুর্য। ছড়ার শরীরে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে হাস্যরস ও আনন্দ দ্যুতি।
এক যে ছিল কাল্লু
তার যে ছিল পাল্লু
তার নামটাই লাল্লু।

তারা আলুকে কয় আল্লুু
তারা বালুকে কয় বাল্লুু
তারা মামাকে কয় মাম্মু
আর খালুকে কয় খাল্লুু।

কিংবা –
যদি বলি ভাস্কো দা গামা
আমাদের সকলের মামা
যদি বলি জ্ঞানী গ্যালিলিও
আমাদের নানা হয় প্রিয়।
যদি বলি হিটলার খালু
আমাদের সাথে খায় আলু।
ব্যাপারটা কী রকম হবে?
তবে – তবে – তবে।
আবার কোনো কোনো ছড়ায় হালকা চালের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে সমাজের নির্মম সত্যকে এবং নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে। ‘বেকার সমস্যার’ চিত্র তুলে ধরেছেন পরোক্ষভাবে।
নাম কি তোমার? করিম মিয়া
আবাস কোথায়? গেণ্ডারিয়া।
বাপের কি নাম? সলিম আলী।
থাকতো কোথায়? নোয়াখালি।
খালু কেমন? মানুষ ভালো।
ভাবীর বরণ? মনটা কালো।
ফুপার মেজাজ? ভীষণ কড়া।
আপা কেমন? যায় না ধরা।
ভাই কী করে? কেয়ার টেকার
তোমার খবর? এখন বেকার।

আবার ‘মামা-মামী’ শীর্ষক ছড়ায় পাই –
তাই তাই তাই
মামা বাড়ি যাই
ছড়ায় পড়া মামার বাড়ি
কোথায় এখন পাই!
মামা থাকে আমেরিকায়
মামীর খবর নাই।
শিশু-মনকে রঙিন ও আনন্দমুখর করে তোলার ক্ষেত্রে মিষ্টি ছড়ার কোনো বিকল্প নেই। যুক্তিহীন বিষয় ও অবাস্তব চিত্র যেমন এসব ছড়ায় নানা স্বাদে মুখরোচক হয়ে ওঠে, তেমনি ছন্দ আর শব্দে প্রকৃতি পেয়ে যায় নতুন প্রাণ। এসব শিশুরঞ্জনী ছড়া রচনায় আমীরুল ইসলামের কৃতিত্ব আকাশচুম্বী। তাঁর শিশুমনস্ক অন্তরের গভীরতা ও বহুমুখিতা ছড়াগুলোকে দান করেছে নতুন মাত্রা। মনের জগতের সাথে ধ্বনির জগতের সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি তাঁর আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ ঘটিয়েছেন, বিষয় অনুষঙ্গের কল্পনার দীপ্তিতে আলোকিত করেছেন এবং গভীরতম উপলব্ধিকে দিয়েছেন অনিন্দ্য রূপ। কয়েকটি ছড়ার উদাহরণ দেয়া যাক:
ক) টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার
আজও মানে বুঝি নাই এই ছড়াটার!
হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর
আজও মানে বুঝি নাই এই কথাটার!
খ) ঝুমকা ঝাঁকা ঝুম,
আয়রে চোখে ঘুম।
বাবার কোলে হেলেদুলে
বিজয় বাবুর কান্না
ঝুমকা ঝাঁকা ঝাঁকি দিলে
ওঁয়াও ওঁয়াও আন – না।
গ) আমের পাতা জোড়া জোড়া
চললো ছুটে কাঠের ঘোড়া
ঘোড়ার পিঠে কে রে?
খোকন আসে তেড়ে।
ঘ) একটা নদী এগিয়ে গেছে কূল নেই
টাক মাথা যার তার মাথাতে চুল নেই।
ডুমুর কাছে ফল রয়েছে ফুল নেই
কন্যে কাঁদে কানে সোনার দুল নেই।
‘মানুষ হলো সিংহ’ এতে গুল নেই।
টেবিল আছে কিন্তু চেয়ার টুল নেই।
শাস্তি আছে কিন্তু আজ আর শূল নেই
ভুল করেও রাজ-রাজড়ার ভুল নেই।
ঙ) ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি
ডাইনোসরের ডিম বিক্রি?
কোথায় ডিম? ডাইনো-ডিম
ফুটে বেরোয় হাট্টিম টিম।
৩.
সমকালীন ছড়া রচনাতেও আমীরুল ইসলাম একজন দক্ষ শিল্পী। কৌতুকের বক্রতায় এবং ব্যঙ্গ নিপুণ বক্তব্যে তাঁর ছড়া পাঠকের চোখ-কান-কৌতূহলকে উজ্জীবিত করে সহজেই। তিনি সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহকে ধারণ করে ছন্দে-মিলে এমনভাবে উপস্থাপন করেন, তাতে প্রোজ্জ্বলিত হয় বিন্যাসের নৈপুণ্য।
দোকান খুলেই পয়সা টাকা
সব সাজালাম পানদানীতে
কারণ একটু পরেই ‘ওরা’
আসবে নাকি চান্দা নিতে!
(চান্দা)
বাজারে যাও – দু’নম্বরী
হোটেলে খাও – দু’নম্বরী
বাসে চাপো – দু’নম্বরী
ওজন মাপো – দু’নম্বরী
পড়ালেখায় ¬- দু’নম্বরী
গুরু শেখায় – দু’নম্বরী
নাটক গানে – দু’নম্বরী
সকলখানে – দু’নম্বরী
দোকান-পাটে – দু’নম্বরী
হাটে-মাঠে-দু’নম্বরী
গ-া-কড়ায় – দু’নম্বরী
ছড়ায় ছড়ায় – দু’নম্বরী
(দু’নম্বরী)
আমীরুল ইসলামের এ ধরনের ছড়ার বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট, সংশয়ের অবকাশ নেই। লেখকসত্তাও তাঁর নিঃসন্দিগ্ধ। কখনো চড়া গলায়, কখনো নিুস্বরে। যা বলতে চান-অবলীলায় বলে ফেলেন। কোনো দ্বিধা নেই, শংকা নেই, চাতুর্য নেই।
উল্টাফুল্টা সিক্সটি নাইন
দেশটা জুড়ে চলছে ফাইন
স্বাধীনতা বিরোধীরা
আজকে ক্ষমতায়
গভীর মমতায়।

মরি হায়রে হায়!
রাজাকারে রাজাকারে
দেশটা চেয়ে যায়!
অথবা
তিনি হাল ফ্যাশনের নেতা
ভাবেন শুধু ইলেকশনে
কেমনে যাবে জেতা?
সুযোগ বুঝে মন্ত্রী হবেন
থাকবে বাড়ি-গাড়ি,
বিপদ এলেই গাঁট্টি ফেলে
বিদেশ দেবেন পাড়ি।

জনগণের সঙ্গে তারা
সম্পর্কহীন
তাক ধিনা ধিন ধিন।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী এই লেখক শুধু সমসাময়িক প্রসঙ্গকে তাঁর নিজস্ব কথনভঙ্গিতে বিন্যস্ত করেছেন তা নয়, তিনি তাঁর বিশ্বাসের সাথে একাত্ম হওয়ার জন্য পাঠককে উদ্বুদ্ধও করেছেন।
তিনি ‘ধর্ম’ ছড়ায় বলেছেন :
পানির ধর্ম অন্যরকম
নয় সে মুসলমান –
জল বললেও পানির কিন্তু
হয় না অসম্মান।
পানি এবং জলের মধ্যে
কিসের ব্যবধান?
অন্যদিকে ‘এসব বড় নয়’ ছড়ায় প্রকাশ পেয়েছে লেখকের অতুলনীয় চিন্তা-চেতনা। তিনি বলেছেন :
কে হিন্দু? কে মুসলিম
এসব বড় নয় –
আমরা সবাই বীর বাঙালি
এটাই পরিচয়।
…………………………..
কে বৌদ্ধ? কে খ্রিস্টান?
এসব বড় নয় –
কণ্ঠে আছে শক্তিমন্ত্র
জয় বাংলার জয়
আমরা সবাই বীর বাঙালি
এটাই পরিচয়।
সমকালকে আত্মস্থ করার প্রবল আগ্রহ আমীরুল ইসলামের মধ্যে থাকলেও তিনি আত্মসচেতন ও শিল্পের সঙ্গে সম্পূর্ণ অঙ্গীকৃত। রচনার শৈল্পিক উৎকর্ষ ও বক্তব্যের স্পষ্টতার জন্য তিনি সুধী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। নতুন সৌরভ ও দীপ্তি নিয়ে তাঁর অনুভূতি, আবেগ ও কল্পনাকে তিনি পরিব্যপ্ত করেছেন। সমাজ-পরিপার্শ্ব, বিশ্বাস-নিশ্বাস, চারদিকের অস্থিরতা-অস্বাভাবিকতা-আস্থাহীনতা সর্বোপরি দেশের সমকালীন প্রতিচ্ছবিই মূর্ত হয়ে ওঠেছে তাঁর নানা লেখায়। এসব রচনায় তিনি কোথাও শাণিত, কোথাও বর্ণাঢ্য হিসেবে নিজেকে গভীর ও অর্থময় করে তুলেছেন।
দেশ, জাতি ও দেশের মানুষের প্রতি রয়েছে আমীরুল ইসলামের প্রচ- অনুরাগ। নিখাদ দেশপ্রেমের কারণে তাঁর রচনায় ঘুরে ফিরে এসেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা – ভাষা আন্দোলন, শহীদ মিনারের কথা, এসেছে আত্মদানকারী মহান শহীদদের কথা। যেমন Í
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ রক্তে লেখা দিন
সেই স্মৃতিতে শহীদ মিনার আজও অমলিন।
(ভাষার লড়াই)।
অথবা,
শহীদ যারা অমর তারা
হয় না, তাদের মরণ
প্রতিবছর একুশ তারিখ
তাদের করি স্মরণ।
(শহীদ মিনার)
অথবা,
বন্ধু মনা মুক্তিযোদ্ধা তুমি আমার ভাই
জীবনভর আমি তোমার বিজয় গাথা গাই।
(লক্ষ্মীপুরের মনা)
অথবা,
স্বাধীন দেশের তুমি সোনার ছেলে
জীবন দিলে যুদ্ধে অবহেলে
তোমার স্মৃতির গন্ধ নিয়ে আজ
সোনার দেশে আলোর কারুকাজ
(শহীদ মুক্তিযোদ্ধা)
এইভাবে স্বদেশবোধের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে তাঁর ছড়ার সিঁড়ি। দেশ মাতৃকার দুঃখে তিনি দুঃখিত হন, ব্যথায় হন ব্যথিত। তাই দেশকে গড়ে তোলার জন্য তাঁর অকৃত্রিম আহ্বান:
তর্ক ভুলে, বিভেদ ভুলে দেশকে গড়ে তোলো
খোলো খোলো তোমরা সবাই আলোর দুয়ার খোলো।
যদিও বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, ‘প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে অনুভব না করেন, এমন কোনো কবি নেই’, তবুও আমরা আমীরুল ইসলামকে আলাদাভাবেই চিহ্নিত করতে চাই, বলতে চাই তিনি একজন প্রকৃতিঘনিষ্ঠ লেখক। শিশুমনের কল্পনা প্রকৃতির ভেতর দিয়ে প্রকাশ করার একটা আশ্চর্যরকম ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। শিশুর মনোভঙ্গির সাথে নিজের মনোভঙ্গিকে মিলিয়ে এমন একটা ভুবন তিনি তৈরি করেন, যা এককথায় চমৎকার।
মেঘের দেশে ছবির মেলা
কবির মত তাকাও
গভীর চোখে দেখতে পাবে
অনেক ছবি-আঁকাও।
এই দেখা যায় হাতি
জ্বলছে মোমের বাতি।

হঠাৎ হাতি উধাও
কেউ যদি ফের শুধাও
হাতি তো নেই এখন দেখি
ছুটছে একটা ঘোড়া
ঘোড়াটা খুব আস্তে হাঁটে
এক ঠ্যাং তার খোঁড়া।

আরে আরে ঘোড়া কোথায়
হঠাৎ দেবে উঁকি
দেখবে তুমি হাসছে কেমন
পাশের বাড়ির খুকি।
ও খুকি তুই একলা
নাম কিরে তোর মেঘলা?
দেখতে দেখতে মেয়ে খুকি
পরীর মত ভাসে
একটা ছবি দেখতে দেখতে
অন্য ছবি আসে।

এই তো দেখি নৌকা
চার পাশে মেঘ চৌকা।
এই দেখা যায় বৃষ্টি
মেঘ ভেসে যায় মিষ্টি।
হঠাৎ দেখি সাইকেল
কিংবা কবি মাইকেল
বলছি কথা সইত্য
আলাদিনের দইত্য
মেঘের দেশে ঘুরছে
কালো ধোঁয়ায় উড়ছে।

মেঘের দেশে অনেক ছবি
খুঁজলে যাবে পাওয়া
যেই না তুমি ধরতে যাবে
অমনি ছবি হাওয়া।
অপূর্ব। এ রচনায় সম্পূর্ণ একটা ছবির সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তাঁর কথনভঙ্গিতে যেমন নতুনত্ব আছে, তেমনি আছে ভাব ও চিত্রকল্পের সমাহার। প্রতিটি প্যারায় ফুটে উঠেছে বিস্ময়ের ছবি। শব্দে, ছন্দে ও কল্পনায় লেখাটি যেমন সৌকর্যমণ্ডিত, তেমনি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ ধরনের আরো কয়েকটি লেখার উদাহরণ দেয়া যাক :
ক) মন ঝুর ঝুর। বালু ঘুর ঘুর। দূরে নদী তীর
পাল তোলা নাও। যায় তির তির।
ঢেউ ছলছল। নদী কথা বল। নদী কথা কয়।
কী যে গীতিময়। নদী কথা কয়।
বায়ু ঝির ঝির। দূরে নদী তীর।
ছবি আঁকলাম। এই নদীটির
ছবি আঁকলাম।
(ছবি)
খ) চাঁদ ডুববে
ফুল ফুটবে
খুব সকালেই
তুমি উঠবে
মাঠে ছুটবে।
………………..
পাখি উড়বে
তুমি ঘুরবে
আলো আসবে
রোদ হাসবে
দেখে এইসব
ভালোবাসবে। (ভালো)
গ) শীতের সকালে শিউলির ফুলে
নিশির শিশির নাচে দুলে দুলে
ভেজা বর্ষায় কদমের ডালে
হাওয়ার নাচন লাগে কোন পালে
এসব নিয়েই স্বপ্ন মাখানো
সোনার বাংলাদেশে,
সেই ছেলে এসে কোটি মানুষের হৃদয়ে রক্তে মেশে।
(সে এক সোনার ছেলে)
আমীরুল ইসলামের লেখায় বিষয়-বৈচিত্র্য যেমন আছে, তেমনি আছে প্রকাশ-বৈচিত্র্য। নিজস্ব দৃষ্টিশক্তি ও সৃষ্টিশক্তির গুণে তাঁর খ্যাতি আজ পরিচিত সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বহিরাঙ্গনে। ‘এইতো বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত লেখায় দেশের প্রকৃতির সাথে বাঙময় হয়ে উঠেছে একুশে ফেব্রুয়ারি, পয়লা বোশেখ, ঈদ ও পুজোর মহা উৎসব। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত-বসন্ত সব ঋতুরই যেন ছায়া আছে এতে। বর্ণনায়, ছন্দে, উপস্থাপনায়, মিলে, বিন্যাসে লেখাটি লেখকের সৃষ্টিপ্রেরণারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
এই তো আমার ধানের দেশ
গানের দেশ। প্রাণের দেশ।
বাংলাদেশ।
…………………..
আসবে ঈদ। পুজোর দিন।
এই একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষা দিবস
পয়লা বোশেখ।
সব মিলিয়ে এই তো আমি
এই তো আমার বাংলাদেশ।
৪.
বুদ্ধদেব বসুর আরেকটি উক্তির উদ্ধৃতি টানছি। তিনি বলেছিলেন, ‘কবিতা যে কখনো পুরনো হয় না, কখনো ফুরোয় না, কয়েকটি, আপাতসামান্য শব্দের সমাবেশ থেকে যে এক অনন্য ভাবম-ল উৎসারিত হয়, তার কারণ কি প্রধানত ধ্বনি নয়? ছন্দোবন্ধন নয়?’ সেই ধ্বনি বা ছন্দের ওপর আমীরুল ইসলামের রয়েছে ঈর্ষণীয় দখল। তিনি ছড়ার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে ছড়াতে চান ধ্বনির বিচ্ছুরিত আভা। নতুন ধ্বনি অন্বেষণের দিকে তাঁর ঝোঁক বেশি। স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত – এই দুই ছন্দে তিনি ছড়াগুলো নির্মাণ করলেও উপস্থাপনায় বৈচিত্র্যময়তার কারণে ছড়ার সাথে সাথে মনের মধ্যে ফুটে ওঠে রঙিন ছবি এবং কানে বাজতে থাকে ধ্বনিমর্মরের মোহনীয় সুর। অন্ত্যমিল, মধ্যমিল ও অনুপ্রাসের বিস্ময় এমন সুসম্পন্ন ও সঙ্গত যে, তা এককথায় অভিনব। তুচ্ছ বিষয় বস্তুকেও ধ্বনি কল্লোলিত করার কৌশল তাঁর রপ্ত। স্বরবৃত্ত ছন্দের স্বাভাবিক পথ দিয়ে চলার পাশাপাশি কম পরিচিত পথেও তিনি পা রেখেছেন। যেমন :
তুমি কি দূরের পাখি?
ঘুম ঘুম সুরের পাখি?
তুমি গান গাইতে জানো?
তোমার ঐ কণ্ঠস্বরে
সুরেলা ঝর্নাধারা
অবিরল ধারায় ঝরে।
মাত্রাবৃত্তে ছন্দেও আমীরুল ইসলাম স্বচ্ছন্দ ও সপ্রাণ। তাঁর রচনায় ৪ মাত্রা পর্বের পংক্তির সন্ধান যেমন মেলে, তেমনি পাই ৫ মাত্রা, ৬ মাত্রা, ৭ মাত্রা এবং ৮ মাত্রার পর্বের বিচিত্র ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি।
যেমন : ৪ মাত্রার পর্ব : চোখ মুছে আবেশে/একা একা ভাবে সে
উড়ে যাবে আকাশে/নিয়ে কোটি টাকা সে।
৫ মাত্রার পর্ব : দেখতে চাই/মায়ের মুখ
সবার সুখ
শিশুর হাসি। ফুলবাগান
স্বপ্নময়/তুলির টান।
৬ মাত্রার পর্ব : ডানায় রোদের/রঙ মেঘে পাখি/আকাশে নিয়েছে/ঠাঁই
পাখিরা আমার/বন্ধু আসিও/পাখি হয়ে যেতে/চাই
৭ মাত্রার পর্ব : পাখিরা ভালো থাক/
পাখিরা বেঁচে থাক/
পাখিরা কেন উড়ে/যায়?
মুক্ত পাখি সব/
করছে কলরব/
পাখিরা স্বাধীনতা/চায়!
৮ মাত্রার পর্ব : আঁধারের পথ থেকে/ শত্রুরা আসে
কিশোর লুকিয়ে থাকে/তারই আশেপাশে
শত্রুরা টের পেয়ে/গুলি ছোড়ে জোরে
গুলির ধোঁয়ায় যেন /ধুলেবালি ওড়ে
লুই আরাগঁ বলেছিলেন : ‘কবিতার ইতিহাস তার টেকনিকের ইতিহাস।’ যিনি যত বেশি টেকনিক সচেতন, তিনি তত বেশি সফল। এদিক দিয়ে আমীরুল ইসলামের তুলনা নেই। ছড়ার রূপরীতি ও আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তিনি ব্রত আছেন। প্রচলিত ধারার বাইরে ছড়ায় নিজস্বতা সৃষ্টিতে তিনি বেশ আগ্রহী। ‘স্বপ্ন কিনি’ নামের একটি ছড়ার উদাহরণ দিতে চাই :
আমি এক ছোট্ট বালক পাখির পালক
মাথায় আমার
ভাঁজে ভাঁজে রঙিন জামার।
আমি রোদ স্বপ্ন কিনি
আমি ঐ পাহাড় চিনি।
আমি যাই নদীর কাছে
মাছেরা ঘুমিয়ে আছে।
পাখিদের স্বপ্ন কিনি,
আমি যাই ফুলের কাছে
ফুলেরা ঘুমিয়ে আছে
ফুলদের স্বপ্ন কিনি।
হাশেম খান শিরোনামে ছড়াটির কথাও উল্লেখ করা যায় :
হাশেম খান । তুলির টান।
ছবির প্রাণ । জানের জান।
দূরের মাঠ। নদীর ঘাট।
শিশুর মুখ। হৃদয় বুক।
দুঃখ সুখ।
এরকম আরো অনেক ছড়ার উদাহরণ দেয়া যায়। মধ্যমিল, অন্ত্যমিল ও অনুপ্রাসকে এড়িয়েও তিনি ছড়া রচনায় প্রয়াসী হয়েছিলেন। যেমন ‘নামকরণ’ :
নাম কি মেয়ের? শাপলা
শাপলা মানে ফুল।
নাম কি ছেলের? দোয়েল
দোয়েল মানে পাখি।
নাম কি মেয়ের? মেঘনা
মেঘনা মানে নদী।
নাম কি ছেলের? অভি
অভি মানে তারা।
৫.
আমীরুল ইসলামের গ্রন্থসংখ্যা দুই শতাধিক। পেয়েছেন খ্যাতি। পেয়েছেন পুরস্কার-স্বীকৃতি। আধুনিক বাংলা ছড়ার আলোছায়ায় তিনি ঋদ্ধ হয়েছেন, দৃঢ় হয়েছেন নানা ঘাত-প্রতিঘাতে। তিনি যেমন নিরীক্ষাপ্রবণ ও বুদ্ধিদীপ্ত, তেমনি সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত। গদ্য ছড়া ও অনুবাদ ছড়ার মাধ্যমে তিনি বাংলা ছড়ায় নতুন মাত্রা প্রদানে চেষ্টায় রত। কি সংখ্যাপ্রাচুর্যে, কি অভিনবত্বে, কি ব্যঞ্জনায় তিনি গড়ে নিয়েছেন আমাদের শিশুসাহিত্যের স্থায়ী আসন। সময়ের ধারা অনুপাতে তাঁর রচনার সংখ্যা অত্যধিক। বিষয়বৈচিত্র্য, প্রকাশবৈচিত্র্য ও ছন্দবৈচিত্র্যের কারণে তিনি উজ্জ্বল ও সপ্রতিভ। বাংলাদেশের ছড়াকে দিগন্তবিস্তারী ও দিগন্তবিহারী করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। বাংলা ছড়ার আবহমান ঐতিহ্য এবং সমকালের ক্ষত-বিক্ষত বাস্তবতার নিখুঁত সমন্বয়ে তিনি তৈরি করেছেন এমন এক ভুবন, যা তাঁর ছড়াকে দিয়েছে বিশিষ্টতা। তাঁর স্বাতন্ত্র্যই তাঁর ছড়ার বৈশিষ্ট্য।