বর্তমান সময়ের বহুল প্রচলিত একটি বদ্ধমূল ধারণা যে গৌতমবুদ্ধ নাস্তিক ছিলেন। বৌদ্ধ ধর্মের একটি বড় অংশ বা বেশির ভাগ বৌদ্ধই একটি বিশ্বাস করে আসছে। বৌদ্ধ ধর্মের যে অংশ আস্তিক তারা আবার বুদ্ধকেই ঈশ্বর মনে করেন। বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থ এবং গবেষকদের মতামত ও গবেষণা লব্ধ জ্ঞানে পড়াশুনা করে যতটুকুু আমি জেনেছি ও বুঝেছি তা এখানে তুলে ধরছি। আড়াই হাজার বছরের অমানিশায় আচ্ছাদিত এক জ্যোতির্ময় মহামানবের সঠিক পরিচয় তুলে ধরার জন্য আজকের এ লেখা।
গৌতম বুদ্ধের বুদ্ধত্ব লাভ এবং পরবর্তী ঘটনাগুলো দ্বারা প্রমাণ করে তিনি নাস্তিক নন, আস্তিক ছিলেন। আমরা যদি বুদ্ধের বুদ্ধত্ব লাভের ইতিহাস দেখি তাহলে দেখি, বুদ্ধত্ব লাভের পূর্বে গৌতম প্রথমে যথাক্রমে অরাড় কালাম।
ওপরে রুদ্র রামপুত্র নামক পুরোহিতের কাছে যান, সেখানে কিছু দিন অবস্থান করে তপস্যা করেন। তাঁদের প্রদত্ত মর্ম অনুশীলন করেন। দীর্ঘ অনুশীলন করার পরও তিনি বুদ্ধত্বের মর্ম লাভ করতে সম্ভব হননি। ফলে, তিনি তাঁদের কাজ থেকে চলে যান। পরে একা একা দীর্ঘ তপস্যা করেন এবং অবশেষে গৌতম বুদ্ধ “বুদ্ধত্ব” লাভ করেন। আমি এখানে বুদ্ধত্ব লাভের ধারাবাহিক শিক্ষা এবং তপস্যা ও কার্য্যক্রম এখানে তুলে ধরছি।
আত্মিক সাধনার জন্য অরাড় কালামের নিকট গমন : গৌতম বুদ্ধ আত্মিক সাধনার জন্য প্রথম অরাড় কালামের যে বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন তা তিনি নিজের ভাষায় বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “হে ভিক্ষুগণ, সেই আমি পরে যখন তরুন, নবীন, কৃষ্ণকেশ এবং ভদ্রযৌবনসম্পন্ন তখন স্নেহশীল ও অনিচ্ছুক মাতাপিতাকে কাঁদাইয়া, কেশ-শ্মশ্রু ছেদন করিয়া, কাষায় বস্ত্রে দেহ আচ্ছাদিত করিয়া আগার হইতে অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হই। প্রব্রজিত হইয়া কুশল কি সন্ধানে এবং অনুত্তর শান্তিবরপদ নির্বাণ অন্বেষণে অরাড় কালামের নিকট উপস্থিত হই। উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বলি, কালাম, আমি তোমার ধর্ম বিনয়ে ব্রহ্মচর্য আচরণ করিতে ইচ্ছা করি। অরাড় কালাম আমাকে কহিলেন, “আপনি এখানে থাকুন; তাদৃশ এই ধর্মতত্ত্ব যাহাতে বিজ্ঞ ব্যক্তি অচিরেই নিজেই নিজের গুরু হইয়া, স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা তাহা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থান করিতে পারেন।”
হে ভিক্ষুগণ, আমি অচিরে, অত্যল্পকালের মধ্যেই সেই ধর্ম আয়ত্ত করি। ওষ্ঠ-প্রহত এবং উচ্চারিত হইতে না হইতেই আমি সেই জ্ঞানবাদ বলিতে পারি, সেই স্থবিরবাদ জানিতে পারি, দেখিতে পাই, ইহার বৈশিষ্ট্যও জানিতে পারি, শুধু আমি নহি অপরাপর ব্যক্তিও তাহা অনায়াসে জানিতে পারে। তখন আমার মনে এই চিন্তা উদিত হয়; “অরাড় কালাম শুধু বিশ^াসের উপর নহে, এই ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়াই অবস্থান করেন বলিয়া তিনি তাহা প্রকাশ করেন। নিশ্চয় তিনি এই ধর্ম স্বয়ং জানিয়া দেখিয়া উহাতে অবস্থান করেন।” অনন্তর আমি তাঁহার নিকট উপস্থিত হই, উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বলি, “কালাম, ধ্যানের কোন স্তর পর্যন্ত এই ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তুমি উহাতে অবস্থান কর?”
হে ভিক্ষুগণ, এইরূপে জিজ্ঞাসিত হইলে অরাড় কালাম কহিলেন, “আকিঞ্চনায়তন নামক অরূপ-ধ্যানস্তর পর্যন্ত।”
হে ভিক্ষুগণ, আমি অচিরে, অত্যাল্পকালের মধ্যে সেই ধর্ম অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থান করি। অনন্তর আমি অরাড় কালামের নিকট উপস্থিত হই, উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বলি, এই ধ্যানস্তর পর্যন্তই তো তুমি এই ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া উহাতে অবস্থান করো বলিয়া প্রকাশ করো। ‘হা, এই পর্যন্তই বটে!’ কালাম, আমিও তো এই ধ্যানস্তর পর্যন্ত স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া উহাতে অবস্থান করিতে পারি। [তিনি কহিলেন] ‘ইহা আমাদের মহালাভ, সুলব্ধ সৌভাগ্য যে আমরা আপনার সদৃশ সতীর্থ দেখিতে পাইতেছি। আমি যে ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থান করি বলিয়া প্রকাশ করি তুমিও সেই ধর্ম অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া উহাতে অবস্থান করিতে পার। তুমি যে ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া উহাতে অবস্থান করো, ঠিক সেই ধর্মই আমি স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া উহাতে অবস্থান করি বলিয়া প্রকাশ করি। এইরূপে আমি যে ধর্ম জানি তাহা তুমি জান, যে ধর্ম তুমি জান তাহা আমি জানি; আমি যাদৃশ তুমি তাদৃশ, তুমি যাদৃশ আমি তাদৃশ। অতএব, বন্ধু, আইস, এখন হইতে আমরা উভয়ে একসঙ্গে বাস করিয়া এই শিষ্যগণকে পরিচালিত করি।’ (মধ্যম নিকায়, প্রথম খ-, ঔপম্য বর্গ, আর্যপর্যেষণ সূত্র, সূত্র-৬। পঞ্চম খণ্ড, পৃ-২৩৪-২৩৫, ত্রিপাসো প্রকাশিত, প্রকাশ-২০১৭) ও (ত্রিপিটক, মধ্যম নিকায়, দ্বিতীয় খণ্ড, মধ্যম পঞ্চাশ সূত্র, রাজ বর্গ, বোধি রাজ কুমার), এখানে কিছুকাল অবস্থানের পর তিনি রুদ্র রামপুত্র নামক পুরোহিতের কাছে যান সেখানে কিছুকাল অবস্থান করে তপস্যা করেন। রুদ্র রামপুত্র পুরোহিতের নিকটে যে শিক্ষা লাভ করেন তা তিনি নিজ ভাষায় বর্ণনা করেন।
আত্মিক সাধনার জন্য রুদ্র রামপুত্র নামক পুরোহিতের কাছে যান :
ইহা অন্বেষণে সর্বোত্তম শান্তিপদ অনুসন্ধান করিতে করিতে যেখানে উ্দ্দক-রামপুত্র ছিলেন তথায় উপনীত হই। তথায় উপস্থিত হইয়া উদ্দক-রামপুত্রকে বলিলাম আবুস। আমি আপনার ধর্মবিনয়ে ব্রহ্মচর্য আচরণ করিতে ইচ্ছা করি। এরূপ উক্ত হইলে, রাজ কুমার! উদ্দক-রামপুত্র আমাকে বলিলেন, এখানে বিহার করুন, আয়স্মান! ইহা তাদৃশ ধর্ম যাহাতে বিজ্ঞপুরুষ অচিরেই স্বীয় আচার্যত্বকে স্বয়ং জানিয়া সাক্ষাৎকার করিয়া, প্রাপ্ত হইয়া বিহার করিতে পারেন। রাজকুমার! সেই আমি অচিরেই, অতিশীঘ্রই সেই ধর্মকে পরিপূর্ণ আয়ত্ত করিলাম। তখন আমি ওষ্ঠসঞ্চালন মাত্রই, ভাষিত ভাষণ মাত্রেই তৎক্ষণাৎ সেই জ্ঞানবাদ আর স্থবিরবাদ বলিতে পারি, জানিতে পারি বরিয়া জ্ঞাপন করিলাম। আর অপরেও তাহা করিল। (ত্রিপিটক, মধ্যম নিকায়, দ্বিতীয় খ-, মধ্যম পঞ্চাশ সূত্র; রাজ বর্গ, বোধি রাজকুমার) সেখানে কিয়ৎকাল অবস্থানের পর তিনি একাকি তপস্যা করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি নিজ ভাষায় বলেন।
কঠিন সাধনা :
তখন আমার দেহ পরিমার্জনা করিবার সময় সেই অল্পাহার হেতু পূতিমূল লোমরাশি অঙ্গ হইতে স্খলিত হইয়া পড়ে। রাজকুমার! তখন লোকেরা আমাকে দেখিয়া বলিত শ্রমণ গৌতম কালো হইয়া গিয়াছেন। কেহ কেহ বলিত শ্রমণ গৌতম কালো হয় নাই, তিনি শ্যামবর্ণ হইয়াছেন। কেহ কেহ বলিত শ্রমণ গৌতম কালো কিংবা শ্যামবর্ণ হন নাই, তাঁহার চর্মরঙ মঙ্গুলবর্ণ (মঞ্জুলবর্ণ?) হইয়াছে। রাজকুমার! আমার এমন পরিশুদ্ধ প্ররিস্কৃত চেহারা সেই অল্পাহার হেতু এতই বিনষ্ট হইয়াছিল। (ত্রিপিটক, মধ্যম নিকায়, দ্বিতীয় খ-, মধ্যম পঞ্চাশ সূত্র; রাজ বর্গ, বোধি রাজকুমার )।
অবশেষে গৌতম বুদ্ধ “বুদ্ধত্ব” লাভ করেন।
তিনি বুদ্ধত্ব লাভের পর এই শিক্ষা প্রচার করবেন কি না? প্রচার করলে কার নিকট, কিভাবে প্রচার করবেন এই দ্বিধাদ্ধন্দ্বে পরেন। প্রথম ভাবলেন প্রচার করবেন। পরক্ষণে ভাবলেন লোকেরা এই বাণী বা জ্ঞান বা শিক্ষা বুঝবে না। তাই প্রচার করে লাভ নেই। তখন উর্ধ্বলোকের মহাব্রহ্মা এটা জেনে যান। সেখানে তাঁর সামনে এসে হাসির হন এবং বলেন,
পালি ঃ এবং বুত্তে, ভিক্খবে, বিপস্সী ভগবা অরহং সম্মাসম্বুদ্ধো তাং মহাব্রহ্মানং এতদবোচ মযহম্পি খো, ব্রহ্মে, এতদহোসি-যংনুনাহং ধম্মং দেসেয্য’ন্তি। তস্স মযহং, ব্রহ্মে, এতদহোসি- অধিগতো খো ম্যাযং ধম্মো গম্ভীরো দুদ্দসো দুরনুবোধো সন্তো পণীতো অতক্কাবচরো নিপুনো প-িতবেদনীযো। আলযরামা খো পনাযং পজা আলযরতা আলসযম্মুদিতা। আলরযমায খো পন পজায আরযরতায আলযসম্মুদিতায দুদ্দসং ইদং ঠানং যদিদং ইদপ্পচ্চযতাপটিচ্চসমুপ্পাদো। ইদম্পি খো ঠানং দুদ্দসং যুদদং মহাত্মা গৌতমের বুদ্ধত্ব লাভ ও এর পরবর্তী ঘটনাবলী : (ঈশ্বর বিশ্বাসের অকাট্য দলিল)
সব্বসঙ্খারসমথো সব্বৃপধিপটিনিস্স¹ো তন্হাক্খযো নিরোধো নিব্বানং। অহঞ্চেব খো প নধম্মং দেসেয্যং, পরে চ মে ন আজানেয্যুং; সো মমস্স কিলমথো, সা মমস্স বিহেসা’তি। অপিস্সু মং, ব্রহ্মে, ইমা অনচ্ছরিযা গাযথাযো পটিভংসু পুব্বে অস্সুতপুব্বা-
কিচ্ছেন মে অধিগতং, হলং দানি পকাসিতুং।
রাগদোসপরেতেহি, নাযঙ ধম্মো সুসম্বুধো ॥
পটিসোতগামিং নিপুণং, গম্ভীরং দুদ্দসং অণুং।
রাগরত্তা ন দক্খন্তি, তমোখন্ধেন আবুটা’তি।
ইতিহ মে, ব্রহ্মে, পটিসঞ্চিক্খতো অপ্পোস্সুক্কতায চিত্তং নমি, নো ধম্মদেসনাযা’তি। (সুত্তপিটকে দীঘনিকাযো, মহাপদানসুত্তং, সূত্র-৬৭)
অনুবাদ :
ভিক্ষুগণ, এইরূপ উক্ত হইলে ভগবান বিপস্সী মহাব্রহ্মাকে কহিলেনঃ “ব্রহ্মা, আমারও মনে এইরূপ হইয়াছিলঃ ‘আমি ধর্মপ্রচার করিব।’ কিন্তু আমি চিন্তা করিলামৎ “আমার অধিগম ধর্ম গম্ভীর, দুর্দর্শ, দুরানুবোধ, শান্ত, প্রণীত, অতর্কাবচর, নিপুণ, পণ্ডিত দেবনীয়। কিন্তু মানুষগণ আসক্তি-প্রিয়, আসত্তি-রত, আসক্তি-প্রমোদী। যাহারা আসক্তি-প্রিয়, আসক্তি-রত, আসক্তি-প্রমোদী তাহাদের পক্ষে ‘ইহা হইতে ইহার উৎপত্তি হয়” রূপ প্রতীত্যসমূৎপাদ অবধারণ করা কঠিন। ইহাও তাহাদের পক্ষে অবধারণ করা কঠিন যে, সর্ব সংস্কারের শান্তি, সর্ব উপাধির পরিহার, তৃষ্ণাক্ষয়, বিরাগ এবং নিরোধই নির্বাণ। আমি ধর্ম প্রচার করিলে অপরে যদি তাহা গহণ করিতে অক্ষম হয়, তাহা হইলে উহা আমার পক্ষে শ্রান্তিজনক ও বিরক্তিকর হইবে।” তন্মুহূর্তে আমার মনে অশ্রুতপূর্ব এই গাথাগুলি প্রতিভাত হইলঃ
আমি বহু কষ্টে অর্জিয়াছি যাহা,
কাজ নাই প্রকাশ করিয়া তাহা,
রাগ-দোষে লিপ্ত নব যারা,
এই ধর্ম বুঝিবে না তাহা!
প্রতি¯্রােতগামী ইহা নিপুণ গম্ভীর,
দুর্দর্শ সুসূক্ষ্ণ ইহা-রাগরক্ত যারা
অবিধ্যার অন্ধকারে ঢাকা-বুঝিবে না ইহা তারা।”
‘ব্রহ্মা এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে আমি নিরুৎসাহ হইলাম, ধর্মদেশনায় আমার প্রবৃত্তি হইল না।” (ত্রিপিটক, দীর্ঘনিকায়, দ্বিতীয় খ-, মহাপদান সূত্রান্ত,)
যখন মনে মনে এটা চিন্তা করছিলেন লোকেরা এ শিক্ষা বুঝবে না। তাই প্রচার করে লাভ নেই। তখন উর্ধ্বলোক থেকে মহাব্রহ্ম এটা জেনে যান। আর সোজা তাঁর সামনে এসে হাজির হন। এ ঘটনা এভাবে উল্লেখ রয়েছে-
৫। “ভিক্ষুগণ, তখন মহাব্রহ্মা “ভগবান বিপস্সীর নিকট ধর্ম প্রচারের প্রতিশ্রুতি লাভ করিয়াছি” এইরূপ চিন্তা করিয়া তাহাকে অভিবাদন এবং প্রদক্ষিণপূর্বক ঐ স্থানেই অন্তর্ধান করিলেন। ” (ত্রিপিটক, দীর্ঘনিকায়, দ্বিতীয় খণ্ড, মহাপদান সূত্রান্ত,)
পালি : “অথ খো সো, ভিক্খবে, মহাব্রহ্মাসেয্যথাটি নাম বলবা পুরোসো সমিঞ্জিতং বা বাহ্ং পসারেয্য, পসারিতং বা বাহং সমিঞ্জেয্য; এবমের ব্রহ্মলোকে অন্তরহিতো বিপস্সিস্স ভগবতো অরহতো সম্মাসন্বুদ্ধস্স পুরতো পাতুরহোসি। অথ খো সো, ভিব্খবে, মহাব্রহ্মাএকংসং উত্তরাসঙ্গং করিত্বা দক্খিুং জাণুম-লং পথবিযং ভগবন্তং অরহন্তং সম্মাসম্বুদ্ধং এতদবোস- দেসেতু, ভন্ডে, ভগবা ধম্মং, দেসেতু দুগতো ধম্মং, সন্তি সত্তা অপ্পরজক্খজাতিকা; অস্সবনতা ধন্মস্স পরিহাযন্তি, ভবিস্সন্তি ধম্মং, সন্তি সম্মা অপ্পরজক্খজাতিকা; অস্সবনতা ধম্মস্স পরিহাযন্তি, ভবিস্সন্তি ধম্মস্স অঞ্ঞাতারো’তি।” (সুত্তপিটকে দীঘনিকাযো, মহাপদানসুত্তং)।
বাংলা অনুবাদ :
“অনন্তর, ভিক্ষুগণ, সেই মহাব্রহ্মা, যেরূপ বলবান পুরুষ সঙ্কুচিত বাহু প্রসারিত করে, অথবা প্রসারিত বাহু সঙ্কুচিত করে, সেইরূপই ব্রহ্মলোক হইতে অন্তর্হিত হইয়া ভগবান বিপস্সীর সম্মুখে আবিভর্’ত হইলেন। তৎপরে, ভিক্ষুগণ, মহাব্রহ্মা একাংশ উত্তরাসঙ্গে আবৃত করিয়া দক্ষিণাজানুমণ্ডল ভূমিতে স্থাপন করিয়া ভগবান বিপস্সীর দিকে অঞ্জলি প্রণত করিয়া তাঁহাকে এইরূপ কহিলেন;
“হে ভগবান, ধর্মপ্রচার করুন, হে সুগত ধর্মপ্রচার করুন, সাংসারিকতার মহিলনতায় যাহাদের চক্ষু নিস্প্রভ হয় নাই, এমন প্রাণীও আছে। ধর্মশ্রবণের অভাবে তাহারা বিনষ্ট হইতেছে, তাহরা ধর্মের জ্ঞান লাভ করিবে। (ত্রিপিটক, দীর্ঘনিকায়, দ্বিতীয় খণ্ড, মহাপ্রনাদ সুত্রান্ত)
অজাত, অভূত, অসংস্কৃত এক সত্তার পরিচয় :
গৌতম বুদ্ধ শুধুমাত্র একজন ইশ^র আছেন আর তিনি তাঁর মনোনীত প্রতিনিধি এটাই বলে যান নি, বরং সেই ঈশ^রের স্বরূপও বর্ণনা করেছেন। বলেছেন তিনি অজাত, অভূত, অকৃত ও অসংস্কৃত সত্তা। অর্থাৎ যার কোন জাত নেই, জন্ম নেই, রূপান্তর নেই, পরিবর্তন নেই, তাঁর প্রজাতিভূক্ত কেউ নেই। তিনি জন্ম নেন নি। তাঁকে জন্ম দেয়া হয় নি। কিন্তু তিনিই সবার জন্মের ও অস্তিত্ব লাভের কারণ। তিনি বলছেন,
মূল পালি :
“অত্থি, ভিকখবে, অজাতং অভূতং অসঙ্খতং, নো চেতং ভিক্খবে, অভবিস্স অজাতং অভূতং অকতং অসঙ্খতং। নযিধ জাতস্স ভূতস্স কতস্স সঙ্খতস্স নিস্সরণং পঞ্ঞাযেথ। যস্মা চ খো, ভিক্খবে, অত্থি, অজাতং অভূতং অসঙ্খতং, তস্মা জাতস্স অভবিস্স অজাতং অভূতং অকতং অসঙ্খত’ন্তি দেসনাপঞ্ঞত্তি নিব্বানস্স বেবচনপঞ্ঞত্তি চ। “নযিধ জাতস্স ভূতস্স কতস্স সঙ্খতস্স নিস্সরণং পঞ্ঞাযতী তি।” (ত্রিপিটক, নেত্তিপ্রকরণ, ৪.ক.১১ প্রজ্ঞপ্তি হারবিভঙ্গ,)
“হে ভিক্ষুগণ, অজাত অভূত অকৃত অসংস্কৃত একজন আছেন। হে ভিক্ষুগণ; যদি সেই অজাত অভূত অকৃত অসংস্কৃত না থাকিত এই সংসারে জাতের ভূতের কতের সংস্কৃতের নিৎসরণ প্রত্যক্ষ হইত না। হে ভিক্ষুগণ; যেই কারণে অজাত অভূত অকৃত অসংস্কৃত থাকে সেই কারণে জাতের ভূতের কৃতের সংস্কারের নিঃসরণ প্রত্যক্ষ হইয়া থাকে। হে ভিক্ষুগণ; যদি অজাত অভূত অকৃত অসংস্কৃত না থাকিত- ইহা নির্বাণের দেশনা প্রজ্ঞপ্তি এবং বিবচন প্রজ্ঞপ্তি। এই সংসারে জাতের ভূতের কৃতের সংস্কৃতের নিঃসরণ প্রত্যক্ষ হইত না। (ত্রিপিটক, নেত্তিপ্রকরণ, ৪.ক ১১ প্রজ্ঞপ্তি হারবিভঙ্গ। পবিত্র ত্রিপিটক, অষ্টাদশ খণ্ড, ত্রিপাসো বাংলাদেশ প্রকাশিত, প্রকাশ২০১৭)
প্রায় একই ধরনের উদ্ধৃতি ত্রিপিটকের অন্যান্য পুস্তকেও ব্যবহৃত হয়েছে। নিম্নে আরো দু’টি বইয়ের উদ্ধৃতি উপস্থাপন করা হলো-
“ভিক্ষুগণ, তেমন অৃত আছে যাহা জন্ম, উৎপত্তি, সৃষ্টি এবং সংস্কারের অধীন নহে। যদি তেমন কিছু না থাকিত তবে এই জাত, উৎপন্ন, সৃষ্ট ও সংস্কৃত আত্মভাবের নিঃসরণ দৃষ্ট হইত না।”(পবিত্র ত্রিপিটন, (উদান, তৃতীয় পরিনির্বাণসংযুক্ত সূত্র) একদশ খণ্ড, ত্রিপিটক পাবলিশিং সোসাইটি বাংলাদেশ, প্রকাশ ২০১৭)
“হে ভিক্ষুগণ, এমন কিছু আছে যাহা অজাত, অভূত, অকৃত, অসংযত বা অবিমিশ্র। যদি এমন কিছু না থাকে অজাত, অভূত, অকৃত, অসংযত বা অবিমিশ্র নয়, তাহা হইলে জাত, ভূত, কৃত, সংযত বা বিমিশ্র যাহা তাহা হইতে নিঃসরণ জানা যাই না। (পবিত্র ত্রিপিটক, (ইতিবুত্তক, অজাত সূত্র)একদশ খণ্ড, ত্রিপিটক পাবলিশিং সোসাইটি বাংলাদেশ, প্রকাশ ২০২০)
উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলোতে একজন অজাত অভূত, অকৃত ও অসংস্কৃত সাত্তার কথা বলা হয়েছে। আর বলা হয়েছে, “হে ভিক্ষুগণ; যদি সেই অজাত অভূত অসংস্কৃত না থাকিত এই সংসারে জাতের ভূতের কৃতের সংস্কৃতের প্রতিসরণ প্রত্যক্ষ হইত না।
বিষয়টি একটু চিন্তার, একটু ভাবার দাবি রাখে। এজন্য আমরা প্রথমে ব্যবহৃত শব্দগুলোর সরল অর্থ উপস্থাপন করতে চাই।
পালি ‘জাত’ শব্দের অর্থ পালি বাংলা অভিধানে লেখা হয়েছে- জন্মপ্রাপ্ত. উৎপন্ন জন্মগত, যে ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করিয়াছে, যাহা উৎপন্ন হইয়াছে।আর বলা হয়েছে এর বিপরীত শব্দ হলো ‘অজাত’ বা ‘অভূত’ । অর্থাৎ যে জন্মগ্রহণ করে নি তাকে ‘অজাত’ বা ‘অভূত’ বলে। আবার পালি ‘অসঙ্খতং’-শব্দের অর্থ বলা হয়েছে অসংস্কৃত, কারণ সম্ভুত নয় এমন, যাহা কার্য কারণ দ্বারা উৎপন্ন হয় না, অনুৎপন্ন উৎপন্ন হয় না এইরূপ।
তাহলে এই সূত্রের সরল অর্থ দাড়াচ্ছে, এই বিশ^জগতে একজন আছেন যিনি জন্ম নেননি, যাকে জন্ম দেয়া হয়নি, অথবা কোন কার্য-কারণের কারণেও তিনি উৎপন্ন হন নি। কিন্তু তিনি আদি থেকেই বিদ্যমান আছেন। আর তিনি আছেন বলেই এই বিশ^জগতের যা কিছু জাত, ভূত, কৃত ও সংস্কৃত বা মিশ্র তা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি না থাকলে কিছুই সৃষ্টি হতো না।
এই বিশ^জগতের যা কিছু আছে যেমন আলো, বাতাস, গাছপালা, জীব-জন্তু, গ্রহ-নক্ষত্র, এমন কি বিশ্ব জগৎ কোন কিছুই আদি-অনাদী ও চিরস্থায়ী নয়। সব কিছু অস্থায়ী, পরিবর্তনযোগ্য, লয়শীল। এর কারণ সবাই জন্ম নিয়েছে। সব কিছু উৎপন্ন হয়েছে। সব কিছু কার্য-কারণের ফলে অস্তিত্বে এসেছে। অর্থাৎ খোদ এই বিশ^জগত বা এর কোন কিছুই অজাত, অভূত, অকৃত ও অসংস্কৃত গুণের বা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নয়। সব কিছু জাত, ভূত, কৃত ও সংস্কৃত বা মিশ্র। আর শাস্ত্র বলে এমন বৈশিষ্ট্যের সব কিছুই হলো অস্থায়ী। আর বুদ্ধ বলেছেন, এসব কিছুর বিপরীতে একজন অজাত, অভূত ও অসংস্কৃত সত্তা আছেন। যিনি নিজ সৃষ্ট নন, নিজে জন্ম নেন নি। কিন্তু তিনিই সবার জন্মের ও সৃষ্টির কারণ। তিনি না থাকলে কেউ জন্ম নিত না, সৃষ্টি হতো না।
আর আস্তিক ধর্মগুলো এই সত্তাকেই ঈশ্বর বলে। যিনি ঈশ্বর, তিনি ‘অজাত, অভূত, অকৃত ও অসংস্কৃত’। অর্থাৎ তাঁকে কেউ জন্ম দেয় নি। বরং তিনি সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর কোন রূপান্তর নাই, কোন পরিবর্তন নাই। কিন্তু তিনি সবাইকে পরিবর্তন করেন। তিনি কোন কার্য-কারণে সৃষ্টি নন। সব কার্য-কারণ তাঁর থেকে সৃষ্টি, তাঁর পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়। অর্থাৎ এমন এক সত্তা বা ঈশ্বর আছেন বলেই সব কিছু সৃষ্টি হয়েছে। নতুবা কিছুই সৃষ্টি হতো না। এটাই গৌতম বুদ্ধ বলেছেন।
তাই, এটা একটু নিরপেক্ষ বিবেক নিয়ে চিন্তার বিষয়, ভাবার বিষয় গৌতম বুদ্ধ ঈশ্বর শব্দ ব্যবহার করেননি। কিন্তু এমন কিছু গুণবাচক নাম ব্যবহার করেছেন যা কেবল ঈশ্বরের জন্যই প্রযোজ্য, অন্য কারো জন্য নয়। যদি আস্তিক না হতেন, এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী না হতেন, তাহলে তিনি ভিক্ষুদের সম্মোধন করে কখনও এটা বলতেন না-‘হে ভিক্ষুগণ; অজাত অভূত অকৃত অসংস্কৃত আছে। হে ভিক্ষুগণ, যদি সেই অজাত অভূত অকৃত অসংস্কৃত না থাকিত এই সংসারে জাতের ভূতের কৃতের সংস্কৃতের নিঃসরণ প্রত্যক্ষ হইত না।’
তিনি যদি আস্তিক কিংবা ঈশ্বরের প্রেরিত অবতার বা প্রতিনিধি না হতেন, ঈশ্বর সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান না রাখতেন, ঈশ্বরের পরিচয় ভালোভাবে না জানতেন তাহলে তিনি কখনও ঈশ্বরের এই স্বরূপ তুলে ধরতে পারতেন না। এ পরিচয় দিতে পারতেন না।
আর জগতের সামনে যিনি ঈশ্বরের এমন পরিচয় তুলে ধরছেন বা এত চমৎকার স্বরূপ বর্ণনা করেছেন তাঁকে নাস্তিক বলা বা নাস্তিক্যবাদ তাঁর প্রতি আরোপ করা অন্ধের ঢিল ছোঁড়া বা সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছু নয়।
(সূত্র : শাহ মোহাম্মদ নূরুল আমিন রচিত একেশ্বরবাদী বুদ্ধ আড়াই বছরের অমানিশায় আচ্ছাদিত এক জ্যোতির্ময় মহামানব)