মাটির গোপন গর্ভে অজাত ছিলাম,
কৌমের কাঙ্ক্ষার বীর্যে আমার উত্থান।
[মাটির মহিষ]
….
লিলি গাংগুলি পাখি নয়
তাই তার গান শুনতে পেয়েছিলাম খুব কাছাকাছি থেকে
পাখিরা শোনায় গান দূর থেকে
আর অরণ্যে সে আমাকে শুনিয়েছিল গান পাশাপাশি হেঁটে
পাতার জড়তা ভাঙতে ভাঙতে পাখির স্বভাবে।
তার নখ নিখুঁত রক্তিম
তাজা কোন শালিখের রক্ত দিয়ে মাখা
পোষা কোন টিয়ের মত তার গায়ে বাঁধা ছিল রুপোর নূপুর।
[লিলি গাংগুলি পাখি নয়]
….
জলে ও কাদায় বপন করেছি আগামী দিনের আশা
বর্গীর পাখি খেয়ে গেছে সব সম্ভাবনার ধান।
বাঁকানো কাস্তে হাতের মুঠোয় জেগেছে আদিম চাষা
সূর্যের মত কাস্তের চোখে জ্বলে ওঠে অভিমান।
[জলে ও কাদায়]

এরকম হীরকসম পংক্তির আশ্চর্য প্রয়োগ আমরা প্রত্যক্ষ করি কবি ওমর কায়সারের কবিতায়। ওমর কায়সার এমন এক কবি, যিনি সবসময় সমকালকে স্পর্শ করেন। তাতে দ্রোহ আছে, প্রেম আছে, দুঃখ আছে, বিরহ আছে, আছে প্রকৃতি ও জীবনের নানা জটিলতা। যদিও তাঁর ভেতরে বাস করে ধ্যানমগ্ন এক মানুষ। তিনি সমাজের কথা বলেন, সৌন্দর্যের কথা বলেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ়, প্রগতিশীলতাকে ধারণ করেন বলে তাঁর প্রতিটি উচ্চারণ খুবই স্পষ্ট, অর্থবহ ও গভীর। কবিতার প্রকাশভঙ্গি, বিষয়-বৈচিত্র্য, শব্দের অনন্তের দোতনা ও ছন্দের অমোঘ বাণীতে তিনি ভাস্বর। তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ভুবন। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ, আকাশ বুনন, প্রতিমা বিজ্ঞান, বাস্তুসাপও পালিয়ে বেড়ায়, প্রাচীন প্রার্থনাগুলো, নির্বাচিত কবিতা, আমিহীন আমার ছায়াগুলো। গ্রন্থের নামকরণেই ধারণা করা যায় কবি ওমর কায়সারের চিন্তাচেতনা ও দর্শন। নিবিড় পাঠের মাধ্যমে স্পর্শ করা যায় তাঁর কবিতার কলকব্জা।

ওমর কায়সার কবিতায় সাময়িকতাকে ডিঙোতে পারেন অনায়াসে। সুন্দর সমন্বয় করতে পারেন প্রেম আর দ্রোহের। প্রতিটি কবিতায় ফুটে ওঠে নিজস্ব দর্শন। তাঁর পঙক্তিগুলো যেমন সরল-স্মার্ট-আঁটোসাটো, তেমনি উপমায় নতুনত্ব লক্ষণীয়। ভাব আর ভাষা দিয়ে তিনি অবলীলায় স্পর্শ করতে পারেন পাঠকের মন। এখানে তাঁর একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিচ্ছি :

স্বরম-লের মতো সাজিয়ে রেখেছো সাত সাতটি চেয়ার
অথচ মানুষ আছে আটজন
একজন নিশ্চিত ঝরে যাবে জেনেও মানুষ চেয়ার-সঙ্গীত শোনে
আর বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে সাতটি চেয়ারের চারপাশে আটজন দখলমত্ত মানুষ
এভাবে বারবার একেকটি চেয়ার উঠে যাবে আর এক একজন মানুষ ঝরে যাবে।
[চেয়ারের গান]

ওমর কায়সার নিজেকে কেবল কবিতার অঙ্গনে সীমাবদ্ধ রাখেননি, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও রেখেছেন তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর। প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য প্রভৃতি শাখায় তিনি স্বতঃস্ফূর্ত ও নিবেদিত। প্রকাশিত হয়েছে উপন্যাস : অ্যাকুরিয়ামের দিনগুলো, কিশোর উপন্যাস : দূর সাগরে পথ হারিয়ে ও মেছো ভূতের গল্প ; ছোটদের গল্প: পরি ও জাদুর তুলি, জাদুর বেলুন, অবিকল স্বপ্নের মতো, সে এক আশ্চর্য বাতি’ এবং পরিবেশ বিষয়ক গ্রন্থ : তৃণভূমি। এ ছাড়া বেশ কিছু সংকলন সম্পাদনা করে তিনি সুধিজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর শিশুসাহিত্য আমাদের আরেক সম্পদ। এমন এমন ছড়া তিনি উপহার দিয়েছেন, যা অভাবনীয়। তাঁর একটি ছড়ার উদাহরণ দিতে চাই, যেটি আমি বিভিন্ন বক্তৃতায় উল্লেখ করি।

কালো এক ষাঁড়
বাঁকা করে ঘাড়
তেড়ে আসে তার
সাম্প্রদায়িক হিংসায়-

যেন সেই ষাঁড়ে
এগোতে না পারে
বাধা দিতে তারে
আমাদেরও ঠিক
বড় বড় দুটো শিং চাই।

অন্যদিকে তাঁর কিশোর গল্প তুলনাহীন, ছোটোদের মনে কৌতূহল সঞ্চার করতে সক্ষম। ‘সে এক আশ্চর্য বাতি’ গ্রন্থের ফ্ল্যাপে কিছু কথা লেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। আমার কথাগুলোর কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি।
ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছেন: ‘ছোটোদের জন্য গল্প উপন্যাস ও শিক্ষামূলক সাহিত্য রচনায় আমাদের সাফল্য নির্ভর করে কিসের ওপর? প্রথমে আমাদের প্রয়োজন সেইসব প্রতিভাবান লেখক, যাঁরা সহজ, সরস ও অর্থপূর্ণ রচনা তৈরির ক্ষমতা রাখেন। তারপর চাই সংস্কৃতিমান সম্পাদক, যাদের সাহিত্য ও রাজনীতিতে যথাযথ প্রশিক্ষণ থাকে; এবং সর্বোপরি প্রয়োজন শিশুপাঠ্য গ্রন্থাবলি যথাসময়ে এবং যথোচিত উৎকর্ষে সমৃদ্ধ করে প্রকাশের নিশ্চয়তা বিধানের কারিগরী সুযোগসুবিধা।’
শিশুসাহিত্য রচনার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো সহজ ও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন। ছোটোদের মনে কৌতূহল সঞ্চার করা এবং তাদের নরম, কোমল ও আনন্দময় মনকে উজ্জীবিত করার জন্য সহজ ও আকর্ষণীয় রচনার বিকল্প নেই। এর মধ্যেই নিহিত আছে চিরায়ত সাহিত্যগুণ। শিশুসাহিত্য এমন এক মনন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় যা লেখকের জন্য শ্রমসাধ্য হলেও তার প্রকাশ সাবলীল ও প্রাণবন্ত; শ্রম, চেষ্টা ও প্রতিভার সমন্বয়ে সৃষ্টি হতে পারে এমন অভাবনীয় সাহিত্য।
ওমর কায়সার এমন এক লেখক, যিনি ছোটোদের উপযোগী সাহিত্য রচনায় দক্ষ ও কুশলী কারিগর। শিশু মনস্তত্ত্ব আয়ত্তে নিয়েছেন অনেক আগেই। শিশুসাহিত্য যেন শিশুর আনন্দসঙ্গী হয়ে ওঠে, তার জন্য তিনি মেধা আর শ্রম দিয়ে চলেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। তিনি মনে করেন, শিশুসাহিত্য শিশুর মানসিক খাদ্য। এই খাদ্য তার মনকে করে সতেজ ও সবল। শিশুর স্বপ্ন ও কল্পনাশক্তির বিকাশে উপভোগ্য শিশুসাহিত্যের কোনো বিকল্প নেই।
ওমর কায়সার সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় স্বচ্ছন্দ ও নিবেদিত হলেও শিশুসাহিত্য রচনায় আমরা তাঁর বিশেষ দরদ ও দক্ষতা লক্ষ করি। তাঁর ‘সে এক আশ্চর্য বাতি’ অসাধারণ এক বই। কিশোর মনে মুক্তমন, উদার চিন্তা ও স্বাধীনচিত্ততার জাগরণ তুলতে অদ্ভুত ও বিস্ময়কর বই এটি। কবিতায় তিনি যেমন সমাজের কথা বলেন, সৌন্দর্যের কথা বলেন, তেমনি ছোটোদের উপযোগী লেখায় তুলে ধরেন স্বপ্নের কথা। তাঁর প্রতিটি উচ্চারণ খুবই স্পষ্ট, অর্থবহ ও গভীর। রচনার প্রকাশভঙ্গি, বিষয়-বৈচিত্র্য ও বক্তব্যের অসাধারণ উপস্থাপনায় তিনি ভাস্বর। তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ভুবন।
সুস্থ শিশু বলতে শুধু শারীরিকভাবে সুস্থ শিশুকেই অনেকে বুঝে থাকেন। যদিও শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবে শিশুকে সুস্থ রাখা জরুরি। মানসিকভাবে সুস্থ না হলে শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। আমি মনে করি, শিশুর মানসিক বিকাশে ওমর কায়সারের গল্পের বইটি বড় সহায়ক হতে পারে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন সাংবাদিকতাকে। পূর্বকোণ, ভোরের কাগজ হয়ে বর্তমানে দৈনিক প্রথম আলোতে কর্মরত আছেন তিনি, বার্তা সম্পাদক হিসেবে। প্রায় ৪০ বছর ধরে আমি তাঁর সঙ্গে আছি। তাঁকে দেখছি। আমার নানা সাংগঠনিক কাজে আমি তাঁর সহযোগিতা পেয়ে এসেছি। আমরা যখন কিশোরকবিতা আন্দোলনের কথা বলি, তখন আসে তাঁর নাম। এদেশের প্রথম কিশোরকবিতার সংকলন ‘ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে’। এটি সম্পাদনা করেছেন অজয় দাশগুপ্ত, ওমর কায়সার ও উত্তম সেন। তাঁরা ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। আমাদের প্রথম জাতীয় ছড়া উৎসব ও প্রথম কিশোর কবিতা সম্মেলনের আয়োজনে অন্য অনেকের চেয়ে ওমর কায়সারের সনিষ্ঠ সহযোগিতার কথা এখনো আমার মনে আছে। আমি তাঁর সাহিত্য জীবনের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।

[ছবি : সস্ত্রীক ওমর কায়সার]