কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মানসচক্ষে বঙ্গ প্রকৃতির ঋতুরঙ্গের লীলা দেখেছেন, শুনেছেন তার নীরব আহ্বান। যে আহ্বান তিনি তাঁর সৃষ্টিতে সুর আর বাণীতে প্রকাশ করেছেন। তাঁর সৃষ্টিতে প্রতিটি ঋতুর সৌন্দর্য বর্ণনা এক অনন্য মাত্রায় বর্ণিত হয়েছে। কবিগুরু পরিণত বয়সে এসে অনুভব করেছেন, ছয়টি ঋতুর অপার সৌন্দর্য। প্রকৃতির এ লীলারঙ্গ তিনি শুধু বাহ্যিকভাবেই উপলব্ধি করেননি, দেখেছেন প্রকৃতির অন্তর্নিহিত ভিতরের রূপটিও। তিনি তা ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ঋতু পর্যায়ের গানে। হেমন্ত প্রকৃতপক্ষে নিভৃতচারী ঋতু। শরৎ ও শীতের মাঝামাঝি সে আসে অতি সন্তর্পনে। সে যেন কারো চোখে ধরা পড়ে না। কিন্তু বিশ্বকবির মানসচক্ষে হেমন্তের রূপ ঠিকই ধরা পড়েছে। তিনি হেমন্তকে সৃষ্টির ডালি দিয়ে সাজিয়েছেন। তিনি লিখেছেন-।
” কার্তিকের এই ধানের খেতে
ভিজে হাওয়া উঠল মেতে
সবুজ ঢেউ’য়ের পরে।
পরশ লেগে দিশে দিশে
হি হি করে ধানের শিষে
শীতের কাঁপন ধরে। ( বৃষ্টি রৌদ্র — শিশু ভোলানাথ)

তাঁর তিনশ ঋতুভিত্তিক গানের মধ্যে ‘হেমন্ত’এর গানের সংখ্যা কম হলেও দার্শনিক তাৎপর্য কোনো অংশে কম নয়। প্রতিটি ঋতুর মতো হেমন্তকে তিনি অবহেলা বা উপেক্ষা করেননি। তাইতো তিনি হেমন্তকে ‘হেমন্তলক্ষ্মী ” বলেছেন। হেমন্ত হলো অতি দীন, কুয়াশায় আচ্ছন্ন তার মুখ, চোখ তার ঢাকা হিমের ঘন কুয়াশার ঘোমটার নিচে। অতি সংকুচিত তার আবির্ভাব স্থিতিকাল।
দিগঙ্গনার অঙ্গন যার দান পূর্ণ সেই হেমন্ত আপন দানের আড়ালে নিজেকে আড়াল রাখে।কিন্তু নিজে তমসাচ্ছন্ন হয়েও সে বিশ্বের অন্ধকারকে জয় করার জন্য আহ্বান জানায়-‘ জয় করো এই তমসারে’। ( অরুণ দাশগুপ্ত)
কবিগুরুর হেমন্তের গান মোট পাঁচটি।পাঁচটি গানেই তিনি হেমন্তের রূপ সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন। হেমন্তকে তিনি ফসলের ঋতু হিসেবে দেখে “হেমন্তলক্ষ্মী ” বলেছেন। হেমন্তের দৃষ্টিগাহ্য রূপে তিনি বিমোহিত। কবিগুরু বলেছেন, ” ” “আমাদের সংবৎসরের ফসল হলো ধান,হেমন্তে তাহা মাঠ ভরিয়া প্রবীণ শোভায় পাঁকে,আর শীতে তাহা ঘর ভরিয়া পরিণত রূপে সঞ্চিত হয়।”’ তিনি হেমন্তকে নারীরূপেই তথা মাতৃরূপেই কল্পনা করেছেন। যা তাঁর গান গুলোতেই প্রকাশ পেয়েছে। গীতবিতানের প্রকৃতি পর্যায়ের উপপর্যায় হেমন্তের প্রথম গান হিমের রাতের ওই গগনের
গীতবিতান প্রকৃতি পর্যায়ের উপপর্যায় হেমন্তের প্রথম গান –
” হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে
হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে॥
ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো– “দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।'( হেমন্ত – ১৭১ গীতবিতান)
এই গানটিতে স্থায়ীর দ্বিতীয় চরণে তিনি”হেমন্ত ‘ শব্দটি ব্যবহার না করে “হেমন্তিকা ‘ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এই গানটিতে কবিগুরু নিজের মত করে বাণী ও সুর প্রয়োগ করেছেন। আবার ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো” দীপালিকায় জ্বালাও আলো” অর্থাৎ ধরিত্রীকে নিজের আলোয় সাজাতে বলেছেন। হেমন্ত ঋতু কুয়াশা ছড়ায়। ঘন কুয়াশায় প্রকৃতির চারদিক যখন আচ্ছন্ন করে ঘিরে ফেলে তখন আলোর প্রয়োজন। এই সময় দীপাবলি উৎসব। কবি সেই উৎসবের ডাক দিয়েছেন। ‘বেহাগ’ রাগ এর সুর করা এই গান। তিনি এই গানে শাস্ত্রের বিধি মেনে চলেননি। প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীত শাস্ত্রে হেমন্তের গানের জন্য ‘নটনারায়ণ’ ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গীতস্রষ্টা ও সুর স্রষ্টা কবিগুরু তা মানেননি। তিনি এইগানটিতে “বেহাগ ‘রাগ প্রয়োগ করে গানটি কে কতটা সুমধুর করে তুলেছেন তা রবীন্দ্রপ্রেমী শ্রোতারাই বুঝতে পারেন।হেমন্তের অবগুন্ঠিত রূপে আড়ালে সৌন্দর্য কবিকে রয়েছে বিমুগ্ধ। তিনি সেই সৌন্দর্যকে এভাবে বর্ণনা করেছেন-
হেমন্তের অবগুণ্ঠিত রূপের আড়ালের সৌন্দর্য্য কবিকে বিমুগ্ধ করেছপ।তিনি সেই সৌন্দর্যকে এভাবে বড়ণনা করেছেন—
” হায় হেমন্ত লক্ষী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা –
হিমেল ঘন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা।
এটি গীতবিতান এর হেমন্তের ২য় গান। এই গানটিতে কবি গুরু হেমন্তকে নারী রূপে কল্পনা করেছেন। একটি শব্দ হেমন্তলক্ষ্মী শব্দটাতে তার পূর্ণ রূপ প্রকাশ পেয়েছে।রবীন্দ্র সংগীত রাগ ও সুর নির্দেশিকা গ্রন্থের লেখক সুধীরচন্দ্র তার গ্রন্থে বলেছেন “গানটি রবীন্দ্রনাথের বাউল অঙ্গের গান।” কিন্তু অরুন দাশগুপ্তের মতে,” এতে পিলুর ছোঁয়া আছে। “বলা যায় মিশ্র ধারায়। গানটির ভাব কল্পনায় প্রথমেই রয়েছে প্রশ্ন- হেমন্তলক্ষ্মী আমাদের অন্নের যোগান দেয় তার মুখ কেন ঢাকা থাকবে? তারপর আভোগ পর্যন্ত কবির জিজ্ঞাসা আর জিজ্ঞাসা। কবিগুরুর মনে প্রশ্ন, যে ঋতু দিগঙ্গনায় অঙ্গন অন্নদানে পূর্ণ করে দেয় তার মুখ কুয়াশাদিতে মলিন আর অশ্রু ভরা চোখ। তাইতো কবির আবেগ-
আপন দানের আড়ালেতে রইলে কেন আসন পেতে,
আপনাকে এই কেমন তোমার গোপন ক’রে রাখা ॥
এই আবেগ মাখা রোমান্টিকতা কথা শুধু কবিগুরুর গানেই সম্ভব। যা তাঁর খুব কম গানেই আছে। হেমন্ত এর তৃতীয় গানে আমরা পাই প্রেম-বিরহের কানাকানি।
“হেমন্তে কোন্ বসন্তেরই বাণী পূর্ণশশী ওই-যে দিল আনি॥
বকুল ডালের আগায় জ্যোৎস্না যেন ফুলের স্বপন লাগায়।
কোন্ গোপন কানাকানি পূর্ণশশী ওই-যে দিল আনি॥”
এটি গীতবিতানের হেমন্ত এর তৃতীয় গান। এই গানটি মিশ্র রাগ এর গান। এই গানটিতে কবিগুরু বেহাগ ও খাম্বাজ এই দুটি রাগের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।অরুণ দাশগুপ্তের মতে গানটিতে হেমন্তের চেয়ে বেশি আছে আসন্ত বসন্তেরই মধুর আবেশ। স্থায়ীর প্রথম চরণে বলা হলো “হেমন্তে কোন বসন্তেরই বাণী পূর্ণশশী ওইযে দিল আনি।” হেমন্তের এই কুয়াশা ঢাকা পূর্ণিমার রাত্রিটি কবিকে পৌঁছে দিল আসন্ন বসন্তের আগমন বার্তা।এই বিশেষ পূর্ণিমা রাত্রিটি মুহূর্তেই মুছে দিল হেমন্তের সব মালিন্য আর নানা মনোরম ছবি এঁকে গড়ে তুলল হেমন্তের পটভূমিতে সুন্দর এক বাসন্তী পরিবেশ যেমন-‘বকুল ডালে আগায় জোৎস্না জাগিয়ে দিলে ফুলের স্বপ্ন।’ এই গানটিতে খাম্বাজ সুর সুন্দর ভাবে প্রয়োগ হয়েছে। সেইসঙ্গে দাদরা তালের ছন্দ রবীন্দ্রপ্রেমীদের মনে খুশির আমেজ জাগিয়ে তোলে।
গীতবিতানে হেমন্তের চতুর্থ গানটি হল বিরহ কারত আকুতি। কবির ভাষায়
“সে দিন আমায় বলেছিলে আমার সময় হয় নাই–
ফিরে ফিরে চলে গেলে তাই॥
তখনো খেলার বেলা– বনে মল্লিকার মেলা,
পল্লবে পল্লবে বায়ু উতলা সদাই॥”
শরতের শেষে হেমন্তের আগমনে সকরুণ প্রণয় প্রতীক্ষার চিত্র গানটিতে অব্যক্ত বিরহ বেদনা ফুটে উঠেছে। গানটির সবচেয়ে উল্লেখিত অংশ সঞ্চারীতে কুহেলিবিহীন, ভূষণবিহীন এই দুটি শব্দই হেমন্তের নিস্প্রভ, নির্ভূষণ আর মলিন রূপ ফুটে উঠেছে। এই গানটির সুরের ক্ষেত্রেও এসেছে অন্যরূপ। বেহাগ রাগ এর আবেগমিশ্রিত মধুর গানটিতে বিরহ কারতা ভরে উঠেছে।গীতবিতানের পঞ্চম ও শেষ হেমন্তের প্রাচুর্যতাকে কবি বন্দনা করেছেন।
“, নমো, নমো
নমো, নমো, নমো।
তুমি ক্ষুধার্তজনশরণ্য
অমৃত-অন্ন-ভোগধন্য করো অন্তর মম।।”
এই ঋতু বঙ্গঁসন্তানদের অন্নের জোগান দেয় সে
“ক্ষুধরর্তজন স্মরণ্য”। তাইতো কবিগুরু সৃষ্টিতে হেমন্ত লক্ষ্মী স্বরূপিনী আর অন্নপূর্ণা। স্বল্পসংখ্যক গান নিয়েই তিনি হেমন্ত বন্দনা করেছেন। সুর ও বাণী তে তার সৃষ্টি তাইতো যুগল মিলন। এটাই তাঁর সৃষ্টির অনন্য প্রকাশ।