শামসুর রাহমান। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। তিনি ছিলেন কবি, সাংবাদিক অনুবাদক, গীতিকার। আধুনিক বাংলা কবিতার এক অনন্য প্রতিভাদীপ্ত কবি শামসুর রাহমান। তাঁর কাব্য শৈলী, সৃষ্টিশীলতা ও মননের দ্যুতিময় উপস্থাপনা তাকে দিয়েছে কবিতার বরপুত্রের উপাধি। ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর পুরান ঢাকায় জন্ম তাঁর। পৈত্রিক বাড়ি ঢাকা জেলার রায়পুর থানার পাড়াতলী গ্রামে। পিতা মোখলেসুর রহমান চৌধুরী এবং মাতা আমেনা খাতুন। আজ তার ৯২ তম জন্মবার্ষিকী। কবির জন্মদিনে শৈলী টিভির অনলাইন পত্রিকার পক্ষ থেকে তার প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
শামসুর রাহমানের ডাক নাম বাচ্চু। পৈত্রিক উপাধি ছিলো ‘চৌধুরী’। নাম থেকে তা বাদ দিয়েছিলেন তিনি। শামসুর রাহমান সাংবাদিকতার খাতিরে বিভিন্ন সময়ে বেশকিছু ছদ্মনাম গ্রহণ করেছেন। পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে এসব ছন্দনাম নিয়েছেন তিনি। নামগুলো হচ্ছে: সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাক। একবার মাত্র কবিতার প্রয়োজনে ছদ্মনাম নিয়েছেন তিনি। পাকিস্তান সরকারের আমলে কলকাতার একটি সাহিত্য পত্রিকায় মজলুম আদিব (বিপন্ন লেখক) নামে কবিতা ছাপা হয়।
আধুনিক বাংলা কবিতার এক অনন্য কবি শামসুর রাহমান। কাব্য রচনায় সৃষ্টিশীলতা ও মননের দ্যুতিময় উপস্থাপনা তাকে দিয়েছে কবিতার বরপুত্রের উপাধি। ছন্দোময় ও শিল্পিত শন্দ প্রয়োগে তিনি তাঁর কবিতায় বলেছেন দেশ, মাটি ও মানুষের কথা। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালির স্বাধীনতার কথাও বলেছেন কবিতার ভাষায়। নাগরিক এই কবি আমৃত্যু স্বদেশ ও শেকড়ের প্রতি ছিলেন দায়বদ্ধ। পাশাপাশি সমকালীনতা ধারণ করে সারাজীবন অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত সমাজের কথা বলেছেন তাঁর কবিতায়।
শামসুর রাহমানের সমগ্র কাব্যজীবনের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো মূলত স্বদেশপ্রেম। ক্ষত হৃদয়ের দগ্ধ যন্ত্রণা কবিতার মধ্যদিয়ে প্রকাশ করেছেন তিনি। শামসুর রাহমানের কবিতায় তার হৃদয়ের বেদনা ও দুঃখবোধ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল।
শামসুর রাহমান ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই.এ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। ১৯৫৩ সালে বি.এ (পাস কোর্স) পাস করেন।
১৯৪৩ সালে তাঁর প্রথম কবিতা ‘উনিশ’শ ঊনপঞ্চাশ’ প্রকাশিত হয় নলিনীকিশোরগুহ সম্পাদিত সোনার বাংলা পত্রিকায় তখন তাঁর বয়স মাত্র আঠারো। ১৯৬০ সালে তাঁর প্রথম কাব্য, প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’র প্রকাশিত হয়।
শামসুর রাহমান ১৯৫৭ সালে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন ইংরেজী দৈনিক মর্নিং নিউজ-এর সহ-সম্পাদক হিসেবে। কিছুদিন এ পত্রিকায় কাজ করার পর যোগ দেন রেডিও পাকিস্তানে। ১৯৬৪ সালে মর্নিং নিউজে উচ্চতর পদে যোগ দেন।
১৯৬৪ সালের শেষ দিকে প্রেস ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় ও প্রবীণ সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সম্পাদনায় দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক পদে তিনি যোগদান করেন। এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রা-র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর উল্ল্যেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ৮ টি ছড়ার বই, ৬৬ টি কবিতা, ৪ টি উপন্যাস, ৩ টি অনুবাদ, ৩ টি প্রবন্ধ। এছাড়াও তিনি অনেক গান রচনা করেছেন যা কণ্ঠ দিয়েছেন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পীরা।
“প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে”, “রৌদ্র করোটিতে”, “বিধ্বস্ত নিলীমা”, “বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে’’ “প্রেমের কবিতা”, “ইকারুসের আকাশ”, “বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়”, “অন্ধকার থেকে আলোয়” “উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে”, “কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি”, “আমার কোন তাড়া নেই” তাঁর উল্ল্যেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি।
বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য শামসুর রাহমান আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯), জীবনানন্দ পুরস্কার (১৯৭৩), একুশে পদক (১৯৭৭), আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮১), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণ পদক (১৯৮১), ভাসানী পুরস্কার (১৯৮২), পদাবলী পুরস্কার (১৯৮৪), স্বাধীনতা পুরস্কারে (১৯৯২) ভূষিত হন। সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য ১৯৮২ সালে তিনি জাপানের মিতসুবিশি পুরস্কার পান। ১৯৯৪ সালে কলকাতার আনন্দ বাজার পত্রিকা তাঁকে আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত করে। ওই বছর তাঁকে সাম্মানিক ডিলিট উপাধীতে ভূষিত করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯৬ সালে সাম্মানিক ডিলিট উপাধি দান করে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী। তিনি ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।