অদম্য-অপ্রতিরোধ্য এক জীবনসংগ্রামীর নাম আনোয়ারা আলম। যিনি বাঙালি নারীদের আধুনিক পথচলায় অন্যতম নির্দেশক। একাত্তর জ্যৈষ্ঠ পার করে আসা এই নারী এখনো শির উঁচু করে চলেন। অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করেননি, করেননি আপস। জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে, কিন্তু তিনি সেগুলোকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছেন। চিকিৎসক পিতার কন্যা তিনি। বিয়ে হয়েছে অল্প বয়সে। স্বামীও চিকিৎসক। দীর্ঘদিন লিবিয়ায় কাটাতে হয়েছে আনোয়ারা-শামসুল আলম দম্পতিকে। দেশে এসে আবার পড়ালেখায় মনোনিবেশ, নতুন একটি কলেজে অধ্যাপনায় যুক্ত হন। শাফায়াত আহমাদ সিদ্দিকীর যোগ্য নেতৃত্বে কলেজটিকে প্রতিষ্ঠিত করেন। পরবর্তীতে আগ্রাবাদ মহিলা কলেজের গুরু দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হয়।
কলেজটির অধ্যক্ষ্যের দায়িত্ব পালনকালে তাঁকে নানামুখী চক্রান্তের শিকার হতে হয়েছিল। কিন্তু সবকিছুকে তিনি সামলে নিয়েছেন। সবচেয়ে বড়কথা, স্বামীসহ পরিবারের অন্যদের সমর্থন-সহযোগিতা ছিল। চাকুরি, সংসার, লেখালেখি-এই ত্রয়ী কর্মকে তিনি সৃজনশীলতার দৃষ্টিতে দেেেখছেন। সেজন্য পরিবারের অন্য সদস্যরা তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছে। বৈশ্বিক মহামারীতে হারিয়েছেন ভাইসহ অনেক স্বজন। তারপরেও দমে যাননি। ভার্চুয়ালি প্রায় প্রতিদিন যুক্ত থাকছেন সৃজনশীল অনুষ্ঠানে, লেখালেখি তো আছেই। বয়স নয়, ইচ্ছাশক্তি তাঁকে অদম্য করে তুলেছে।
শেখার কোনো বয়সসীমা নেই। মানুষ প্রতিনিয়ত শেখে এবং শেখায়। কিন্তু সব মানুষের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়। সমাজে কিছু মানুষ আছেন যারা প্রতিনিয়ত শেখান, শেখেনও। স্তরায়িত সমাজে এ ক্ষেত্রে কোনো নারী যদি প্রভাব বিস্তার করেন কিংবা ভূমিকা রাখেন, সমাজকে আলোড়িত করেন, আন্দোলিত করেন -তাহলে সেটা দৃষ্টান্ত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সব নারী তা পেরে উঠেন না। একবিংশ শতাব্দীতেও নারীর পথচলা মসৃণ নয়। নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের বুলি যতো আওড়াই না কেন, তাদের এখনো ভাবা হয় গৃহকর্মী হিসেবে।
কিন্তু আনোয়ারা আলম -এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি ছুটে চলেছেন সম্মুখপানে। সাত দশক পেরিয়েও দেদীপ্যমান। নানা গুণে প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজসেবা, উপস্থাপনা-প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি উজ্জ্বল। মেধা, ধৈর্য্য ও পরিশ্রমের জন্য তাঁর রয়েছে পরিচিতি। পেশা থেকে অবসরে যাওয়ার কিছু আগে পিএইচডি শেষ করেছেন। সমাজে সব মানুষ উচ্চ মেধাসম্পন্ন নয়। উচ্চ মেধা ও মননের অধিকারীরা সমাজে নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানচর্চাকে প্রতিষ্ঠিত করে। যার দারুণ সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়।
আনোয়ারা আলম সাহিত্যে নিমগ্ন থাকেননি। তিনি নারী ক্ষমতায়ন, অধিকার, সমতা ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার। তাঁর পদচারণা বাংলাসাহিত্যের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায়। তিনি বড়দের জন্য যেমন লিখেছেন, তেমনি শিশুদের জন্য তাঁর লেখনি শক্ত ভিতের উপর নির্মিত। প্রশাসক হিসেবে তিনি ছিলেন দক্ষ। তবে এই দক্ষতা একদিনে গড়ে ওঠেনি। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-‘বসন্তের বৃষ্টি’, ‘নারী ও সমাজ’, ‘নারীর জীবন’, ‘ভিন দেশে ঝরা পালক’, ‘ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের নারী’, ‘আমার শিক্ষকতার জীবন’ ‘ছোটদের প্রীতিলতা’,‘ছোট্ট এক রাজকুমারী’,‘নারীর জীবন এবং ইত্যাদি’ ‘প্রসঙ্গ প্রিয় অপ্রিয়’,‘গোধূলি বেলায় মেঘের ভেলায়,‘এক যে ছিল রাজকুমারী,’ ‘ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম ও শিশু : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’, ‘ঘুমন্ত রাজকুমারী’, ‘রূপাঞ্জল ও রাজকুমার’,‘ গেরিলা যোদ্ধার গল্প শোন’, ‘যাদুর শহর’, ‘মুক্তিযোদ্ধা মা’, ‘নিয়তি’,। সম্পাদিত গ্রন্থ : ‘শহীদ রুমি স্মারকগ্রন্থ’, ‘অগ্নিযুগের বিপ্লবী নারী’,‘শ্যাম-শেফালী স্মারক’।
আনোয়ারা আলমের গবেষণাধর্মী বেশ কয়েকটির মধ্যে ‘ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের নারী’ অন্যতম। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের নারী যে প্রোজ্জ্বল তিনিই প্রথম সুনিপুণভাবে উপস্থাপন করেছেন। এনেছেন পাঠকের সামনে। এই আন্দোলনে অনেক অজানা বিপ্লবী নারীকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। ‘ঊনিশ শতকের শেষ অধ্যায়ে দেখা যায়, বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের মেয়েদের মত চট্টগ্রামের মেয়েরাও বিদ্রোহী হয়েছে। বিদেশি পণ্য বর্জনের শপথ নিয়েছে। সে শপথকে যেন তারা গ্রহণ করেছে কবিতায়, গানে, সমস্ত প্রাণ ভরে- যে সুর ভেসে উঠেছে সমগ্র বাংলার আকাশে বাতাসে। সে সুরে যেন আঁধার কেটে যায়। কুহেলিকা ভেদ করে স্বচ্ছ হয়ে আসে মুক্তির পথ- যে পথ সংগ্রামের, দুর্বলের নয়, সে পথ শক্তিময়ীর।’
‘ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম ও শিশু : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’ আনোয়ারা আলমের গবেষণা অভিসন্দর্ভ। শিশুশ্রম নিয়ে এনজিও পর্যায়ে কিছু গবেষণা হলেও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে শিশুশ্রম, বিশেষত ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন বরেণ্য সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন। তিনি লিখেছেন-‘তাঁর (আনোয়ারা আলম) এই গবেষণা কাজটিতে তিনি কখনোই শিশুশ্রমের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে বিস্মৃত হননি। তিনি দেখিয়েছেন আইএলওর একটি অধুনা হিসাব মতে, ১৭ বছরের শিশু, যারা শ্রমে জড়িত, তাদের সংখ্যা ২৪ কোটি ৭ লাখ, ৫ বছর থেকে ১৪ বছরের শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ২১ কোটি ১০ লাখ । এদের মধ্যে এশিয়াতে ১২ কোটি ৭৩ লাখ , আফ্রিকায় ৪ কোটি ৮০ লক্ষ, ল্যাটিন আমেরিকায় ১ কোটি ৭৪ লক্ষ। তিনি শিশুশ্রমের সঙ্গে দারিদ্র্যের সম্পর্ক কি ভয়াবহ তা ইউনিসেফের ২০০৪ পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন। সে সময় প্রায় ৬০০ কোটি মানুষের মধ্যে ২০০ কোটি ছিল শিশু। এর মধ্যে ১২ কোটি ৭ লাখ শিশু ছিল প্রায় সব শিশুর অধিকার থেকে বঞ্চিত, ১৫ কোটি শিশু ছিল প্রায় অভুক্ত। ১০ কোটি ৭ লক্ষ শিশু ঘরবাড়িহীন, আশ্রয়বঞ্চিত। ৩২ কোটি শিশু পায় না কোন চিকিৎসা সেবা ও শিক্ষা।
শিশুদের কল্পনার জগতকে আনোয়ারা আলম ‘এক যে ছিল রাজকুমারী,’ ‘গেরিলা যোদ্ধার গল্প শোন’ ‘ঘুমন্ত রাজকুমারী’, ‘রূপাঞ্জল ও রাজকুমার’,‘ ‘যাদুর শহর’ প্রভৃতি গ্রন্থে। শিশুতোষ গ্রন্থপাঠে মনে হয়, তিনি শিশুর মনোজগতে সহজে প্রবেশ করেন। শিশুদের নিয়ে খেলছেন। কখনো কাল্পনিক, আবার কখনো বাস্তবতা এবং ইতিহাসকে সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তিনি অবাধে বিচরণে পারঙ্গম। কামনা করছি তাঁর দীর্ঘায়ু জীবন।