আমার কন্যাকে নিয়ে আমাদের “ কন্যা দিবস” এর আদিখ্যেতা দেখে আমার বাসার দুজন পুরুষের একজন ভীষণ টেনশনে পড়ে গেল। আমার পুত্রধন আর সইতে না পেরে বলে,
— মা পুত্র দিবস কবে?
বললাম,– পুত্রদিবস সেপ্টেম্বরের শেষ রবিবার ছাড়া বছরের বাকি ৩৬৪ দিন।কন্যাদের ভাগ্যে মাত্র ১ দিন পড়েছে।
-কেন?
-ঐ ১ দিনই সবাই একটু খাতির করে, খোঁজ নেয়, উইশ করে। আবার সব আগের মত চলতে থাকে।
— তাহলে তুমি পুত্রদিবসে আমাকে উইশ করনা কেন?
– করি তো। প্রতিদিন খাতির করি তাই তুমি বুঝতে পার না। তোমাকে করি, তোমার বাবাকে করি।এই দুনিয়াটা চলে পুরুষের ইচ্ছায় বুঝেছো।পুরুষ হচ্ছে সব বাসার বস্।মহা পাঁজি। তুমি বড় হলে সব বুঝতে পারবে।
ছেলে আমার কথার সাথে তার দেখা দুনিয়াকে মেলাতে পারেনা। আবার প্রশ্ন করে :
– মা, তুমি কি পুরুষ?
– না, আমি তো মা তাই আমি নারী।পুরষ হয় ছেলেরা।এই যেমন তোমার বাবা, আমার বাবা, তুমি।
– তাহলে আমরা তো তোমার ইচ্ছায় চলি। তুমিইতো বাসার বস। তাহলে তুমিই কি মহা পাঁজি বস্?
– ছি বাবা মা কি কখনো মহা পাঁজি হয়?
আমি পড়ে গেলাম মহা ফ্যাসাদে। মনে মনে কথা সাজাই। কি বলে ছেলেকে বোঝাই।
– তাহলে কি আমার বাবা, তোমার বাবা সবাই মহা পাঁজি?
– এই দুঃসময়ে আমার পতি দেবতা এসে হাজির।
-হ্যাঁ, আমারও একই প্রশ্ন।
পুরুষদ্বয়ের প্রশ্নফাঁদে আমি হাবুডুবু খেতে খেতে বলি
– দেখো তোমরা হলে মহা পুরুষ।কিছু কিছু মহা পাঁজি পুরুষ তোমাদের মত মহা পুরুষদের জাত মারছে, ভাত মারছে, ইজ্জতও মারছে নারী জাতিকে মানা ভাবে হেয় করে,নীচু করে,অবহেলা,অত্যাচার করে। তা নাহলে নারীরা কি সাধে আন্দোলন করে? অধিকার আদায়ের জন্য দিবস পালন করে?
পতি দেবতা মানতে নারাজ।
– মেয়েদের স্বভাবই এমন।সব কিছুতেই সুবিধা খোঁজে। দেখনা চাকরীতে নারী কোটা চাই,সংসদে নারী আসন চাই। গাছেরটাও চায় আবার তলারটাও কুড়ায়।
– বাজে কথা বলবে না বলছি।মহাপুরুষ তো তাই ধ্যানে বসে থেকে আর কিছু দেখতে পাওনা।আচ্ছা বলতো কোন যুগে মেয়েরা কি কি সুবিধ ভোগ করেছে এই পোড়া দেশের মরা সমাজে? শুধু অবহেলা আর নিপীড়ন ছাড়া? আমি চোখ ঘুরালেই দেখি মহা পাঁজি হতচ্ছাড়া গুলো হোন্ডা করে গুন্ডা সেজে সারা শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, নাহয় গলির মাথায় পাড়ার বখাটে গুলো হল্লা করে চায়ের দোকান মাতাচ্ছে আর মেয়ে দেখলে শিষ দিচ্ছে।গান গাইছে। তা সে মায়ের বয়সি হোক বা মেয়ের বয়সি।
– তুমি বলছো মেয়েরা ধোয়া তুলসীপাতা?
– তা না, বাগানে হাজার ফুলের মাঝে দুয়েকটা আগাছা থাকতেই পারে।তাই বলে গোলাপ বাগানকে তো তুমি শেওলা-ছাতার দলে ফেলতে পারোনা।
– তোমরা নারীরা সুবিধামত থিওরি খাটাও।বেগম রোকেয়া বলেছেন সাইকেলের দুই চাকার মত সমতা রেখে চলতে।তোমরা কী করলে?আমাদেরকে সাইকেল থেকে ল্যাং মেরে নামিয়ে দিয়ে একাই প্যাডেল চেপে চলতে চাইছো। একটু পান থেকে চুন খসলেই আন্দোলন, প্রতিবাদ, কলাম লেখার শেষ নেই। আমি তো রীতিমত ভয় পাই কিছু নারীবাদী কবি লেখিকাদের পুরুষ বিদ্বেষী আচরণে। পুরুষের মত চুল ছাঁটতে ভালো লাগে, পুরুষের মত পোশাক পরতে স্বচ্ছন্দ লাগে, পুরুষদের সাথে মেলামেশার অভিজ্ঞতা নিয়ে রীতিমত উপন্যাস রচনা করে হৈচৈ ফেলে দিতে পারে।

তোমার কথা শুনতে শুনতে আমার মাথা ঘুরছে। একটু থামবে? দেখো স্বীকার কর আর নাই কর পুরুষ জাতিটাই বিচিত্র। তোমার মত মহা পুরুষ যেমন আছে, তেমনি বীরপুরুষ, কাপুরষ, লম্পট, মাতাল, জুয়াড়ী, ধর্ষকেরও অভাব নেই। তাদের কারণেই নারীবাদীরা সোচ্চার হয়। যাতে মেয়েরা ভালোভাবে বাঁচে। বেগম রোকেয়া পুরুষ সমাজকে যেমন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তাদের বৈষম্য নীতি তেমনি নারীদেরকে ও পথবাতলে দিয়েছেন। তা নাহলে কোথায় পড়ে থাকতো এদেশের মেয়েরা।
–সাখওয়াৎ সাহেবের মত স্বামী না পেলে বেগম রোকেয়া কি আর নারী জাগরণের অগ্রদূত হতে পারতেন? সেকথা এই নারী বাদীরা ভুলেও বলতে শুনেছো কখনো? তুমি যে বলছো পুরুষরা লম্পট ধর্ষক। মানছি তবে সেটা হাতে গোনা। তা নাহলে তোমাদের বাপ ভাই কাউকে হিসাবের খাতা থেকে বাদ দিতে পারবে না।
–পুরুষরা সব যদি ফেরেস্তাই হতো তাহলে ঘরে ঘরে মেয়েরা এত নির্যাতিত হত না।যদিও আমার কথাগুলো তোমার কাছে গৎবাঁধা বুলি মনে হচ্ছে, তবুও বাস্তবতা এটাই সারা পৃথিবী জুড়ে নারীরা বৈষম্যের শিকার,নিপীড়নের শিকার।
আমাদের এত তত্বকথার তর্ক শুনতে শুনতে আমার পুত্রধন বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমারও সবজি কাটা ফুরিয়েছে। কিন্তু কন্যাদিবস থেকে নারীদিবস পেরিয়ে পুরুষ চরিত্রেরঅ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে যুক্তিতর্ক শেষ হতে চাইছে না।
–আসলে একে অপরকে যখন সন্মান দেয়, বিশ্বাস করে তখন কোন অসহনশীল অবস্থার সৃষ্টি হয় না। কিন্তু পুরুষের প্রকৃতি ও প্রবৃত্তিটাই বুঝি এমন যে সে সবসময় কর্তৃত্ব আর শ্রেষ্ঠত্বের জায়গাটা পেতে চায় সেটা পুরুষ বা নারী যার উপর জোর খাটিয়ে হোক।
– তোমরা মেয়েরা অবলা সেজে সিম্প্যাথি নিতে চাও। তুমি অনেস্টলি বল কটা পরিবারে পুরুষ নারী নির্যাতনে যুক্ত? কখনো শুনেছো শ্বশুর বউ জ্বালায়? শাশুড়ি, ননদ জ্বালায়। মেয়েদের ফাঁদে পড়েই ছেলেরা পরকীয়ায় জড়ায়। তাও ছেলেদেরই চরিত্র্র হনন করা হয়। পুরুষ ঘুষ খেয়ে হোক, চুরি করে হোক যে সব স্ত্রীদের সোনায় মুড়িয়ে রাখে তারাই মাথায় উঠে নারী স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা বলে সেমিনার কাঁপায়। আর বোলনা এইসব সো কল্ড নারীবাদীদের কথা।
আমি শুনছি আর ভাবছি আমার ভদ্রলোক আমাকে কোন দলে ফেলেছেন? নারীর নানাবিধ চরিত্র পুরুষও বিশ্লেষণ করে …..
আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে আমার কন্যার ডাকে।
-মা, বাবা কি তোমার বয় ফ্রেন্ড?
– কী?
– বল না। বাবা তোমার কোন গার্লফ্রেন্ড আছে?
– বেয়াদব মেয়ে! এসব কি বলছিস আবোল তাবোল? তুমি হাসছো কেন?
না, তোর বাবা আমার বয়ফ্রেন্ড হতে যাবে কেন?
– তবে অন্য কেউ? ওয়াও! কে মা? আজ তাকে তুমি উইশ করেছো?
– একটা চড় মারবো এখন।কি হয়েছে হ্যাঁ? কি হচ্ছে এসব?
– রেগে যাচ্ছো কেন? আজকে” বয়ফ্রেন্ড দিবস “ তাই জিজ্ঞেস করলাম বাবা কে উইশ করেছো কিনা? তুমি বল না সবসময় তোমরা দুজন হলে বন্ধু।
-“বয়ফ্রেন্ড দিবস “ছিঃ! সেটা আবার কি?
বয় মানে ছেলে ফ্রেন্ড মানে বন্ধু। আজকে সবাই নিজের বয়ফ্রেন্ডকে উইশ করবে, গিফট দেবে…..
আমার সাহেব মেয়ের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে অবাক হওয়ার ভান করছেন। আর হাসছেন। আমার এমন রাগ হচ্ছে দেখে।
– আর কোন কোন দিবস পালন করবে তোমরা পুরুষরা?
বয়ফ্রেন্ড শব্দটা শুনতেই আমার লম্পট, বদমাশদের চেহারা মনে পড়ছে।
– মা, তুমি খুবই আনস্মার্ট।
-হ্যাঁ তাই, তা তুমি কি এই দিবস পালন করবে ভাবছো?
–যাহ্! আমি তো এখনও বড়ই হইনি।
– খুব পেকেছো, এখন পড়তে বস।“ স্বাধীনতা দিবস” অনুচ্ছেদটা শিখে দাও।
— তুমিতো খুব মজা পেয়েছো মনে হচ্ছে? নিজেকে বয়ফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড মনে হচ্ছে না?
-( হাসতে হাসতে) ভাবছি গার্লফ্রেন্ড দিবস কবে আসবে?
— বাহ! জ্যান্ত বউকে সামনে রেখে গার্লফ্রেন্ডের স্বপ্ন দেখছো? বললাম না, কয়লা ধুলে ময়লা যায় না।পুরুষ মানুষ মানেই মহা পাঁজি।
– হা! হা! হা!…….
ছেলেকে খাটে শুইয়ে রেখে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো।চোখে চোখ রাখলো।হাতে হাত রাখলো। বলল
— আজ যে দিবস হবে হোক। আমার প্র্র্রতিদিন বিবি দিবস। তুমি ছাড়া আমার এই ঘর অন্ধকার,আমার আর আমার সন্তানদের পৃথিবী তুমি। তুমি আছো তাই সব সুন্দর, তুমি ছাড়া সবই মিথ্যে।
আমি চোখ বুজে শুনছি…..আর মনে মনে গুনগুনিয়ে গাইছি… ভালোবাসি ভালোবাসি এই সুরে, কাছে দূরে…..