হরেন্দ্র বাবুর বয়স এখন সত্তরের কাছাকাছি। স্ত্রী সহ বাড়িতেই থাকেন। ছেলেমেয়েরা সবাই শহরে বসবাস করেন। বদমেজাজী লোক হিসাবে এলাকায় বেশ পরিচিত। মাথা গরমওয়ালা মানুষ সব কিছুতেই এদিক সেদিক হলে ক্ষেপে যান। এখন আমের মৌসুম। বাড়িতে আম গাছে আম ধরেছে প্রচুর। হরেন্দ্র বাবুর ভয়ে কেউ তার পাশ দিয়ে যায় না। পাড়ার দুষ্টু ছেলেরা মাঝে মাঝে দু’একটা ঢিল ছুঁড়ে। শুনলেই ঘরের ভিতর থেকে বড় গলায় হাঁক দেবেন ‘হেই কে রে?’ শুনে সবাই দৌড় দেয়। মাঝে মাঝে দুষ্টু ছেলেরা এভাবে হরেন্দ্র বাবুকে জ্বালাতন করে। প্রতিবছর আম পাকলে গাছের সব আম পাইকারদের কাছে তিনি বিক্রি করে দেন। এ বছরও বেশ আম ধরেছে। গাছ ভর্তি টসটসে পাকা আম। পাড়ার দুষ্টু ছেলে শিপন, রিপন ও সুমন। একদিন স্কুল ছুটি শেষে বুদ্ধি করে কীভাবে আমগুলো পাড়া যায় ? ওরা স্থানীয় বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। শিপন বলে,‘ধরা পড়লে কিন্তু রক্ষা নাই।’ রিপন বলে ‘তা তো জানি, ঢিল মারলে কিন্তু জানতে পারবে- গাছে উঠে পাড়া ছাড়া কোন উপায় নাই।’ সুমন বলে,‘গাছে উঠা সম্ভব না,তা ছাড়া গাছটা অনেক বড়।’ শিপন বলে ‘একটা বুদ্ধি আসছে মাথায়।’ সবাই বলে ‘বল বল।’-‘না বলছিলাম কি গতবার ভোটের সময় হরেন্দ্র দাদুর পাশের বাড়ির হিমাংশু কাকা যে মই মার্কায় ভোটে দাঁড়িয়েছিলো,ভোটের প্রচারের জন্য তিনি বেশ কটি আসল মই বানিয়েছিলেন, সেগুলো এখনো বাড়িতেই আছে।’ সুমন বলে, বেশতো কাল দুপুর বেলায় সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, ওখান থেকে মই এনে গাছে উঠে আম পাড়া যাবে। সুমন একটু সাহসী, সে বলে আমিই গাছে উঠবো, তোরা দুজন নিচে থাকবি। ওরা বলে ঠিক আছে। তাহলে কাল দুপুরে।’ দুপুরে সবাই যখন ঘুমে মত্ত ওরা হিমাংশু বাবুর বাড়ি থেকে মই আনে। দুজনে কাঁধে নেয়। আরেকজন দেখে কেউ দেখছে কী না। আম গাছে মই লাগিয়ে গাছে ওঠে সুমন। আর দুজন নিচে থেকে নির্দেশনা দিচ্ছে কোন কোন আমটা পাড়তে হবে। হঠাৎ একটু বড় গলায় শিপন বলে ওঠে, ‘এই তোর হাতের পাশেরটা ছিঁড়ে নেয়।’ হরেন্দ্র বাবু ঘুমের ঘোরে শুনে কে যেন আম পাড়ার কথা বলছে। লাঠি নিয়ে চিৎকার করে ‘কে রে কে হতচ্ছড়া? আম পাড়ছিস কে? দৌড়ে পালিয়ে যায় শিপন ও রিপন। সুমন গাছের ওপরে ভয়ে জড়োসড়ো হয় বসে থাকে একটি ডালের আড়ালে। এদিকে হরেন্দ্র বাবু লাঠি নিয়ে বের হয়েছেন। চোখে চশমা, তেমন ভালো দেখেন না আজকাল। গাছের ওপরে তেমন কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না। ভাবেন হয়তো দৌড়ে আসাতে মই ফেলে সবাই পালিয়েছে। গাছের নিচে গিয়ে দেখেন গাছে মই লাগানো, দেখেন মইটাতে সুন্দর রং মাখা। মনে মনে ভাবেন, এতো পাশের বাড়ির হিমাংশুর মই। গত নির্বাচনে ভোটের সময় মই মার্কায় ভোটে দাঁড়িয়েছিলো এবং এটি প্রচারের জন্য বানিয়েছিলো। কিন্তু নির্বাচনে জিততে পারেনি। নির্বাচনের সময় হরেন্দ্র বাবু হিমাংশু বাবুর বিপক্ষে ছিলো। মই দেখে হরেন্দ্র বাবুর মাথা আরো গরম। ‘ব্যাটা নির্বাচনে হেরে এখন সেই মই দিয়ে ছেলেপেলে লাগিয়ে আমার পাকা আমে মই দিচ্ছিস ? আমি এর একটা বিহিত করবোই।’ মইটি নিয়ে ঘরের খোলা বারান্দায় রেখে ঘুমুতে যান হরেন্দ্র বাবু। মনে মনে বলেন,‘ব্যাটারা দুপুরের ঘুমটাই মাটি করে দিলি।’ কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়েন হরেন্দ্র বাবু। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে গাছের ওপরে থাকা সুমনের। দূরে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ঘটনা দেখে শিপন ও রিপন। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে আবার আসে। এবার একেবারে চুপচাপ। দেখে হরেন্দ্র দাদু ঘুমিয়ে পড়েছে। মইটি বারান্দা থেকে এনে গাছে লাগিয়ে দেয়। টসটসে সব পাকা আম পাড়ে আর শিপন ও রিপন কুড়িয়ে জড়ো কওে থলেতে ভরে। সুমন গাছ থেকে মই বেয়ে নেমে আসে। সবাই বুদ্ধি করে মইটি যেভাবে বারান্দায় রেখেছিলেন হরেন্দ্র দাদু ঠিক সেভাবেই রেখে আসবে। যাতে কিছু বুঝতে না পারে। সবাই খুব সতর্ক হয়ে মইটি খোলা বারান্দায় ঠিক সেভাবে রেখে আসে। দূরে স্কুলের মাঠে গিয়ে সবাই মজা করে আম খায়। হরেন্দ্র বাবু ঘুম থেকে ওঠে দেখেন মইটি যথাস্থানেই আছে। ভাবেন যাক কেউ আর আম পাড়তে আসেনি। তিনি ভাবছেন এলাকার মেম্বার সুশান্ত বাবুকে ফোন দেবেন। কীভাবে হিমাংশুর মই এখানে এলো হিমাংশুকে ডেকে একটা বিহিত করবেন। ওমা ! হঠাৎ গাছের দিকে খেয়াল করে দেখেন লাল টুকটুকে আমগুলো একটিও নেই। কোন দুষ্টু ছেলের কা-! মাথা ভীষণ গরম হয়ে উঠছে। সাথে সাথে ফোন দিলেন মেম্বারকে। এই সুশান্তের পক্ষেই ভোটের সময় কাজ করেছিলো হরেন্দ্র বাবু। সুশান্তের মার্কা ছিলো ফুটবল। মেম্বার ছুটে আসে হরেন্দ্র বাবুর বাড়িতে। ‘কী জন্য ডেকেছেন কাকা?’ -‘আর বলো না গতবার ইলেকশনে না পেরে এখন হিমাংশু তার মই দিয়ে আমার গাছের আম নিতে বোধ হয় ছেলেপেলে লাগিয়ে দিয়েছে।’ -‘কী যে বলেন? আমার মনে হয় এটা পাড়ার কোন দুষ্টু ছেলের কাজ কাকা।’ -‘না এতে হিমাংশুও জড়িত থাকতে পারে।’ হরেন্দ্র বাবু যেটা বুঝেন সেটা। কোন কিছুই তাকে বুঝানো যায় না। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে হারার প্রতিশোধ নিচ্ছে হিমাংশু। আর বোধহয় ঐ দুষ্টু ছেলে রিপন, শিপনকে ও ব্যবহার করেছে। ওরা মাঝে মাঝে গাছে ঢিল ছুঁড়ে, তা আমি জানি।’ মেম্বার বলে, ‘কাকা আমি আসার সময় ওদেরকে মাঠে ফুটবল খেলতে দেখে এসেছি।’-‘ব্যাটা রাখ তোর ফুটবল, নির্বাচনে প্রতীক নিয়ে জিতেছিস বলে তোর আর ফুটবল প্রীতি গেলো না, আম পেড়ে কী ফুটবল খেলতে পারে না?’ মেম্বার বলেন, ‘আপনি কাকা সব কিছুতেই দোষ খুঁজে পান।’ ঠিক আছে, ‘হিমাংশুকে ডাকো, জানি কান টানলে মাথা আসবে। তার মই এখানে কীভাবে আসলো?’ হিমাংশুকে ডাকা হলো। তিনি সাথে দুইজন মুরুব্বীকে নিয়ে আসলেন। মেম্বার সাহেব কথা তুললে হিমাংশু বলে ‘এটা দুষ্টু রিপন শিপন সহ আরো অনেকের কাজ হতে পারে। কারণ তারা গতবার ভোটের সময় ভোট দিতে না পারলেও এই মই নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় আমাদের সাথে প্রচারণা চালিয়েছে। ওরা জানে এটা আমাদের বাড়িতেই আছে। ওদেরই কাজ।’ মেম্বার বলেন, ‘কাকাকে আমিও তাই বলি।’ ফুটবল খেলা থেকে রিপন শিপন, সুমনকে ডেকে পাঠানো হলো। খবর পেয়ে তাদের সাথে ছুটে এলো অনেক বন্ধু বান্ধব ও পাড়ার লোকজন। এলো ওদের অভিভাবকও। রিপন, শিপন সুমনদের মুখে কথা নেই। ক্ষোভে ফুঁসছে হরেন্দ্র বাবু। হরেন্দ্র বাবুর সখ একদিন এলাকার মেম্বার হবেন। কিন্তু প্রার্থী হলে কেউ না কেউ তাকে নানা অজুহাতে বসিয়ে দিতো। এবার সুশান্ত তাকে নির্বাচনে না দাঁড়াতে বলেছিলো। কিন্তু মনে সে দুঃখ থাকলেও কাজ করছিলো সুশান্তের পক্ষে। আর হিমাংশুকে হরেন্দ্র বাবু পছন্দই করে না। সে জন্য তার বিপক্ষে গিয়ে অগত্যা সুশান্তের পক্ষে কাজ করেছে। আজ দুজনকে সুযোগে পেয়ে তিনি বললেন, ‘হিমাংশু তোমার মই মার্কার মই দিয়ে আমার পাকা আমে মই দিলো ওরা, আর আনন্দে সুশান্ত মেম্বারের ফুটবল খেলে।’ সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। পাড়ার একজন মুরুব্বী বলে, ঠিক আছে কাকা ‘আমি আপনার ক্ষোভ বুঝি,আপনিই আগামীবার মেম্বার প্রার্থী। সেটা এখানেই ঠিক করা হলো।’ সবাই বলে ঠিক আছে। আপনার প্রতীক থাকবে কিন্তু আম। রিপন মুখ ফসকে বলে উঠে, ‘কী মজা আর চুরি করে পাড়তে হবে না, ভোটের সময় প্রচারের জন্য সরাসরি গাছ থেকে পেড়েই প্রচার করবো।’ উত্তেজিত হয়ে হীরেন্দ্র বাবু বলে, ‘চুপ ব্যাটা, আম চোর।’