একটা সুন্দর সম্পর্ক তখনই তৈরি হয় যখন ছোট ছোট চাওয়াগুলো ছোট ছোট পাওয়া তে পরিণত হয়, মনের কোন এক গহীনে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নগুলো যখন বাস্তবে রূপ নেয়। সেই চাওয়া পাওয়াগুলো কোন জড়োয়া গহনা দিয়ে সাজিয়ে রাখার মতন কিছু না, সেগুলো হবে কেবলমাত্র ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকা প্রতিটা মুহূর্ত।
একজন নারী তার জীবনের সবচাইতে বড় সেক্রিফাইসটা করে সেদিন যেদিন সে তার শৈশব থেকে শুরু করে যৌবনের কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলোকে বিসর্জন দিয়ে এক আকাশ মন খারাপ নিয়ে তার প্রিয়জনদের ছেড়ে অন্য কারো হাত ধরে সুখের সন্ধান খোঁজে। কিন্তু একজন পুরুষকে এরকম কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়না,তার প্রিয়জনদের ছেড়ে নতুন করে অন্য পরিবারে গিয়ে মানিয়ে নিতে হয়না।
তাকে শুনতে হয় না তুমি এটা জানোনা, ওটা জানোনা বা তোমার মা তোমাকে কোন কিছু শেখায়নি, আরও কত কি!
কিন্তু যে মেয়েটি বউ হয়ে আসে তার কাছ থেকে চাওয়ার কোন শেষ নেই,তাকে সকলের মন রক্ষা করে চলতে হয়, সম্পুর্ণ অজানা,অচেনা একটা পরিবেশে গিয়ে সবাইকে আপন করে নিতে হয়। দিন যায়, মাস যায়,বছর যায় সে হয়ে ওঠে ওই পরিবারেরই একজন। অচেনা মানুষ, অচেনা পরিবেশ, অচেনা সবকিছু, তার মধ্য দিয়েই শুরু হয় নতুন জীবন,স্বামী স্ত্রীর মধ্যে তৈরী হয় একটা আবেগময় মধুর সম্পর্ক। এভাবেই নিজেদের অজান্তে কখন যে তৈরী হয়ে যায় মায়া, ভালোবাসা,মনের সব অনুভূতিগুলো একে অপরের জন্য। হাসি, কান্না, আনন্দ, বেদনার মধ্য দিয়েই চলতে থাকে সেই অচেনা মানুষটির সাথে পথচলা। কিন্তু সবক্ষেত্রে সেই পথচলাটা কি সুখকর হয়! হয়না কেননা সম্পর্কটার মধ্যে যে ছোট ছোট চাওয়া পাওয়ার অনুভূতিগুলো তৈরি হওয়ার কথা সেটা খুব একটা হয়ে ওঠেনা। একসময় সেই চাওয়াটা হয়ে যায় একতরফা,আস্তে আস্তে সম্পর্কটা হতে থাকে ঠুনকো।
নিজের আপন জগৎ ছেড়ে সম্পুর্ণ অজানা অচেনা পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেয়া মেয়েটির ও যে কিছু ভালো লাগা থাকতে পারে, তারও কিছু চাইতে ইচ্ছে করে, পেতে ইচ্ছে করে তার প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে, সেটা অনেক সময় গুরুত্বহীন হয়ে যায়।
অনেকেই বলে থাকেন মেয়েদের চাওয়া পাওয়ার কোন শেষ নেই, আসলেই কি তাই!
খুব ছোট ছোট চাওয়া তাদের, সেই চাওয়াগুলোর মধ্যেই তারা আনন্দ খ্ুঁজে পায়, খুঁজে পেতে চায় জীবনে বেঁচে থাকার প্রেরণা। তারা চায় তার প্রিয় মানুষটি সবসময় তার পাশে থাকুক, হাতটি শক্ত করে ধরে রাখুক। ভুল ভ্রান্তি, দোষগুণ, আনন্দবেদনা নিয়েই ভরে উঠুক ভালোবাসায় ভরা সুখের নীড়।
চাওয়াগুলো হয়তো এমন সকাল বেলা কাজে বের হওয়ার সময় স্বামী হাসিমুখে বিদায় নেবে তার স্ত্রীর কাছ থেকে, অফিসে পৌঁছে জানিয়ে দেবে সে পৌঁছে গেছে। অফিসে কাজের ফাঁকে একবার ফোন করে জেনে নেবে তার প্রিয় মানুষটি কি করছে, লাঞ্চ করতে গিয়ে মনে পড়বে তার প্রিয়তমার কথা, তৎক্ষণাৎ তাকে ফোন করে জেনে নেবে তার খাওয়া হয়েছে কিনা কিংবা দুপুরে হঠাৎ বাসায় ফিরে একসাথে লাঞ্চ করা।
ছোট্ট একটা শব্দ ভালোবাসি, ভালোবাসি শব্দটা মাঝে মাঝে মুখেও বলতে হয় তাহলেই একটা সুন্দর সম্পর্ক আরও মধুর হয়, সুদৃঢ় হয়।
হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলা ভালোবাসি অথবা অফিস থেকে ফেরার পথে প্রিয়তমার প্রিয় ফুল এনে তাকে চমকে দেওয়া,এক কাপ চা কিংবা কফি বানিয়ে তার সামনে এসে বলা এটা তোমার জন্য, হঠাৎ করে কিছু সময়ের জন্য নিজেদের মতন করে হারিয়ে যাওয়া অথবা মন খারাপের কোন এক বিকেলে গলা জড়িয়ে ধরে আবদার করে বলা চলো আজকের সন্ধ্যাটা আমরা বাইরে ঘুরে আসি। তাছাড়া ছোট ছোট খুনসুটি আর ঝগড়া ঝাটি তো থাকবেই, এরকম পাগলামির মধ্য দিয়েই কেটে যাবে তাদের সুন্দর মুহূর্তগুলো।
আসলে মেয়েটি চায় তার প্রিয় মানুষটির কাঁধে হাত দিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে। সে যেভাবে তার প্রিয় মানুষটির সামান্য মাথাব্যথায় অস্থির হয়ে উঠে তার প্রিয় মানুষটির ও যেন তার প্রিয়তমার সামান্য অসুস্থতায় মন কেমন করে ওঠে, ভালোবাসা মাখা হাতটা মাথায় রাখলে একনিমিষেই ভালো হয়ে যাবে তার অসুস্থতা। এই ছোট ছোট চাওয়া পাওয়ার আনন্দগুলোই জীবনে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয়।
জীবন বহমান নদীর মতো। তাই এক জীবনে হয়তো সবকিছু একসাথে পাওয়া সম্ভব হয়না, যতটুকু পাওয়া যায় তার মাঝেই সত্যিকার সুখ খুঁজে নিতে হয় তবেই তো সম্পর্ক টা মজবুত হয়।
একটা চারা গাছকে যেমন অনেক যত্ন করে বড় করে তুলতে হয় ঠিক একইভাবে একটা সম্পর্ক ও অনেক যত্ন আর ভালোবাসার মধ্যে দিয়েই আস্তে আস্তে পরিপক্ক হয়।
নিজে ভালো থাকার চাইতে প্রিয় মানুষটির ভালো থাকাটা মনে প্রশান্তি এনে দেয়। তাই পরষ্পরের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ, বন্ধুত্ব আর ভালোবাসাই পারে একটা বিশুদ্ধ সম্পর্ককে আজীবন টিকিয়ে রাখতে, তা না হলে সুন্দর সুন্দর সম্পর্কগুলোর মৃত্যু তো ঘটবেই অবিরত।
শর্মিষ্ঠা চৌধুরী : লেখক , শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী