২০২০ সালে পুরো বিশ্বকে বিষময় করে এলো করোনা নামক ভয়ংকর সুন্দর এক ভাইরাস। চিনের উহান যখন পুড়ছে আমরা তখন সম্রাট নিরোর মতো বাঁশি বাজানোর মতো মেতে ছিলাম উৎসব আনন্দে। অতঃপর প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ে কেবলই মৃত্যুর মিছিল, করোনা রোগীর প্রতি অমানবিক আচরণ একই সাথে ফ্রন্ট যোদ্ধাদের এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মানবিকতা।
নিয়ন্ত্রণে করোনা যখন প্রায় সফল এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের তিন নেত্রীর একজন তখন ২০২১ সালের মার্চের শেষে বেসামাল পরিস্থিতি। দায়ী আমরাই সবাই যেন ভোগের ও ভোজের উৎসবে। অনুষ্ঠানে, ভ্রমণে রেস্তোরাঁয় এবং বিয়েতে হাজারো লোকের সমাবেশ। পুঁজিবাদী সমাজের পণ্য মোহাবদ্ধতা নামক ফাঁদে আটকে গেল মানুষ। এখন কেবলই একে একে ঝড়ে যাচ্ছে কতো কতো নক্ষত্র! করোনার বিষাক্ত নিঃশ্বাস বাতাসে।সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল! কোথাও ঠাঁই নেই! আর সংকটতো আছেই।
করোনা বার্তা দিচ্ছে অনেক। একশত বছর পরে এল মহামারী! এরই মাঝে বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি! কিন্তু বিরাট শক্তিধরেরাও হার মেনেছে এই করোনার কাছে।কেন!কারণ পুঁজিবাদের আগ্রাসী আচরণে দেশে বাজেটের বরাদ্দ বেড়েছে সামরিক খাদে।বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণা বা স্বাস্থ্যের জন্য যে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের ও চর্চা দরকার এটি উপলব্ধি করেনি কেউ। অতএব ক্ষুদ্র এই ভাইরাসকে প্রতিরোধে বেসামাল উন্নত বিশ্বও।
করোনা নামক এই ভাইরাসও এখন পুঁজিবাদের হাতে বন্দি।প্রথম দিকে দেখেছি করোনার নামে দুর্নীতির উৎসব আমাদের দেশে। এক শাহেদ রাতারাতি একজন বুদ্ধিজীবী হয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় টকশোতে যেমন তেমনি প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ে করোনা প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ। শাহেদের মতো আরও অনেকের করোনাকে ঘিরে কতো কোটিপতি হওয়ার প্রতিযোগিতা। আর স্বাস্থ্যসেবায় তিন প্রতিষ্ঠানের কি সমন্বয়হীনতা।একই সাথে ব্যবসায়ীদের হাতে গনতন্ত্রের পরাজয় ও দেখলাম।
করোনার নেতিবাচক প্রভাবে দেশে নামছে ক্ষুধার মহামারী! অর্থনৈতিক সংকটে হচ্ছে পেশাবদল। মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রায় বিলুপ্তির পথে।নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিণত হচ্ছে নিম্নশ্রেনির শ্রমিকে।প্রাইভেট কিন্ডারগার্টেনের অনেকে এখন পথে।কোন কোন কিন্ডারগার্টেন এখন অনলাইন দোকান।বেকার হয়ে গেছে অনেক নারী শিক্ষক।তাদের অনেকের জীবনে নেমে এসেছে দুর্যোগ।করোনা যতই বাড়ছে রমরমা হচ্ছে প্রাইভেট ক্লিনিক ও ল্যাবের ব্যবসা। মানবতা এখানে একেবারে গৌণ।করোনা কেন্দ্রিক নমুনা পরীক্ষা, ইনজেকশন বা ঔষধের বিক্রি যেমন তেমনি দামও আকাশচুম্বী!হায় করোনা এখন শুধু মানুষ মারার ভাইরাস না মুনাফা অর্জনের একটা উপাদান। টিকা নিয়ে ও কতো প্রতিযোগিতা! টিকার বাণিজ্যিক উৎপাদন ও সরবরাহ চেইন প্রতিষ্ঠার আগেই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা -ক্ষমতা ও বৃহৎ পুঁজির রাজনীতি, পেটেন্ট প্রতিযোগিতায় বিশ্বের জাঁদরেল অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্য সংঘাতের প্রবণতা ও উপলব্ধি করা যায়। সম্পর্কের রসায়ন ও কি চমৎকার ভাবে পাল্টে যাচ্ছে। যে চিন! এই ভাইরাসের জন্য দায়ী সেই চিন! ইতালিতে রিলিফ দিয়ে জি –৭ ভুক্ত দেশে নিজের স্বপ্নের আন্তর্জাতিক প্রকল্প -“ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড -এ ঢুকিয়ে দিল। আর এক জাহাজ করোনা পরীক্ষার কিট আর মাস্ক আমেরিকাকে বিনামূল্যে দান করে চিনের আলীবাবা খ্যাত জ্যাক মা এখন বিশ্বের সবচাইতে ধনী ব্যক্তির মুকুটের প্রাপ্তিতে আরও প্রভাবশালী।
সামাজিক ভাবে করোনা মানে নিরাপদ দূরত্বে। আহা এই বিচ্ছিন্নতা তো ধীরে ধীরে এমনিতেই ঢুকে গিয়েছিল। এমনকি পারিবারিক ভাবেও। আইসোলেটেড হয়ে থাকা অভ্যাসে পরিণত হচ্ছিল। করোনা আক্রান্ত রোগীর কোয়ারান্টাইন! একা থাকো একা হয়ে যাও।তাই করে দিল করোনা।মাস্ক এবং মাস্ক। হায় আমরাতো মুখোশধারীতে পরিণত হয়েই ছিলাম।মনে এক মুখে এক। এখন গরুর মতো আমাদের মুখেও মাস্ক। এটি যেন বিধাতা নির্ধারণ করে দিলেন। কতো কতোটা সময়ের জন্য এই মাস্ক! জানিনা কেউ।
করোনা কাদের নিয়ে যাচ্ছে বেশি! বয়স্কদের। উন্নত বিশ্বে বয়স্কদের এমনিতেই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। এই অপসংস্কৃতিতে আমরাও অনেকে অভ্যস্ত হচ্ছিলাম। এখন পিতা নামক বটবৃক্ষের ছায়াতো হারিয়ে যাচ্ছে করোনায়। মমতাময়ী মায়ের শূন্যতায় অনেকে। করোনার ভেতরে এক গভীর বার্তা! আমরা হয়তো অনেকে বুঝতে পারছি।
সবচাইতে ভয়ানক হচ্ছে মানসিক অবসাদ! আত্মহত্যার প্রবণতা ভয়ংকর বার্তায় দেশে বিদেশে। করোনা নামক এই মহামারি থেকে জানিনা কখন মুক্তি আসবে। তবে শুধু লকডাউনই সমাধান না। এটিকে ঠেকাতে হলে রাষ্ট্রের সাথে জনগণের গভীর সংশ্লিষ্টতায় সমন্বিত কর্মসূচি নেওয়া জরুরি। এখনো স্বাস্থ্যসেবার তিন প্রতিষ্ঠানে মাঝে কোথাও একটা ঘাটতি আছে তা টকশোতেই বোঝা যায়। মনে রাখা দরকার –জনবিচ্ছিন্ন গণতন্ত্র কখনো সুষ্ঠু সমাধান আনতে পারেনা।
স্বাস্থ্যসেবায় চিকিৎসক ও সেবিকাদের কোভিড নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ ও সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে জনবল বাড়াতে হবে। বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতালে দক্ষ জনবলের সাথে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী দরকার। ব্যবসায়ীদের যদি প্রণোদনা দেওয়া যায় তবে স্বাস্থ্য খাতে কেন না। সামনে বাজেট আসছে, সামরিক খাতের বরাদ্দে অতিরিক্ত বরাদ্দ না রেখে অবশ্যই স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা দরকার। দক্ষ জনগণ ছাড়া গণতন্ত্র মুখথুবড়ে পড়ার আশংকাই বেশি। করোনা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বিষয়ে রাষ্ট্রের সাথে সংশ্লিষ্টদের এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। কেেরানা এদেশে এলো প্রবাসীদের হাত ধরে। আমরা সচেতন বা উদাসীন ছিলাম। বিশ্বায়নের এ যুগে সবাই একসূত্রে গাঁথা। সুতরাং করোনার যে অপ্রতিরোধ্য ঢেউ এখন। তা ঠেকাতে প্রবাসীদের আইসোলেশনের জন্য বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের অনেকেই মনে করেন–এদের কোয়ারান্টাইনের জন্য বিভিন্ন মানসম্মত হোটেলে রাখার ব্যবস্থা করার ব্যাবস্থা রাষ্ট্রের স্বার্থেই করা প্রয়োজন। কোটি কোটি টাকা এমনিতেই কিভাবে কুক্ষিগত বা পাচার হচ্ছে তাতো দেখছে জনগণ।
করোনা পরবর্তী পৃথিবী কেমন হবে জানিনা। মার্কিন ভাষাবিদ ও দার্শনিক নোয়াম চোমস্কি বলছেন–করোনা ভাইরাসের ভালো দিকটি হচ্ছে মানুষ হয়তো ভাবতে শুরু করবে কেমন পৃথিবী আমরা চাই। করোনা পরবর্তী সময়ে একদিকে যেমন আগমন ঘটতে পারে হিংস্র সরকারের অন্যদিকে ব্যক্তিগত লোভ ও লাভের বিপরীতে সূচিত হতে পারে সমাজের এমন মৌলিক সংস্কার যা নিশ্চিত করতে মানুষের প্রয়োজনের সাথে গড়ে উঠবে সামঞ্জস্য পূর্ণ মানবিক বিধান।