সুরসম্রাট খেতাবপ্রাপ্ত বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। বাবা আলাউদ্দিন খান নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি সেতার ও সানাই এবং রাগ সঙ্গীতে বিখ্যাত ঘরানার গুরু হিসাবে সারা বিশ্বে প্রখ্যাত। সরোদই ছিল তার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাহন। তবে স্যাক্সোফোন, বেহালা, ট্রাম্পেটসহ আরও অনেক বাদ্যযন্ত্রেও তার যোগ্যতা ছিল অপরিসীম। আজ ৮ অক্টোবর তাঁর ১৫৯ তম জন্মবার্ষিকী। এইদিনে এই সংগীত সাধকের প্রতি রইলো শৈলী টিভি অনলাইন পত্রিকার পক্ষ থেকে জানাই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।
১৮৬২ সালের ৮ অক্টোবর তিনি ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে এক সঙ্গীতপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সবদর হোসেন খাঁ ওরফে সদু খাঁও ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ। মাতার নাম সুন্দরী বেগম। তাঁর সঙ্গীতগুরু ছিলেন আগরতলা রাজদরবারের সভাসঙ্গীতজ্ঞ তানসেনের কন্যাবংশীয় রবাবী ওস্তাদ কাশিম আলী খাঁ এরপর তিনি ওস্তাদ ওয়াজির খান এর নিকট শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৩৫ সালে বিশ্বখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের সঙ্গে বিশ্ব ভ্রমণে বের হন তিনি। এ সময় তিনি ইংল্যান্ডের রাণী কর্তৃক সুরসম্রাট খেতাবপ্রাপ্ত হন। ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব পদ্মভূষণ ছাড়াও পদ্মবিভূষণ, বিশ্ব ভারতীয় দেশীকোত্তমসহ দিল্লি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি। আলাউদ্দিনের ডাকনাম ছিল আলম। বাল্যকালে অগ্রজ ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁর নিকট সঙ্গীতে তার হাতেখড়ি হয়। সুরের সন্ধানে তিনি দশ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এক যাত্রাদলের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। ওই সময় তিনি জারি, সারি, বাউল, ভাটিয়ালি, কীর্তন, পাঁচালি প্রভৃতি গানের সঙ্গে পরিচিত হন। অতঃপর কলকাতা গিয়ে তিনি প্রখ্যাত সঙ্গীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ওরফে নুলো গোপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
সাত বছর পর নুলো গোপালের মৃত্যু হলে আলাউদ্দিন কণ্ঠসঙ্গীতের সাধনা ছেড়ে যন্ত্রসংগীত সাধনায় নিযুক্ত হন। স্টার থিয়েটারের সঙ্গীতপরিচালক অমৃতলাল দত্ত ওরফে হাবু দত্তের নিকট তিনি বাঁশি, পিকলু, সেতার, ম্যা-োলিন, ব্যাঞ্জো ইত্যাদি দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখেন। সে সঙ্গে তিনি লবো সাহেব নামে এক গোয়ানিজ ব্যান্ড মাস্টারের নিকট পাশ্চাত্য রীতিতে এবং বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ অমর দাসের নিকট দেশিয় পদ্ধতিতে বেহালা শেখেন। এ ছাড়া হাজারী ওস্তাদের নিকট সানাই, নাকারা, টিকারা, জগঝম্প এবং নন্দবাবুর নিকট মৃদঙ্গ ও তবলা শেখেন। এভাবে তিনি সর্ববাদ্যে বিশারদ হয়ে ওঠেন।
তিনি সঙ্গীতজগতে এক নতুন ঘরানার প্রবর্তন করেন, যা ‘আলাউদ্দিন ঘরানা’ বা শ্রেণী ‘মাইহার ঘরানা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
আলাউদ্দিনের পরামর্শ ও নির্দেশে কয়েকটি নতুন বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবিত হয়। সেগুলির মধ্যে ‘চন্দ্রসারং’ ও ‘সুরশৃঙ্গার’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি অনেক রাগ-রাগিণীও সৃষ্টি করেন, যেমন: হেমন্ত, দুর্গেশ্বরী, মেঘবাহার, প্রভাতকেলী, হেম-বেহাগ, মদন-মঞ্জরী, মোহাম্মদ (আরাধনা), মান্ঝ খাম্বাজ, ধবলশ্রী, সরস্বতী, ধনকোশ, শোভাবতী, রাজেশ্রী, চণ্ডিকা, দীপিকা, মলয়া, কেদার মান্ঝ, ভুবনেশ্বরী ইত্যাদি। তিনি স্বরলিপিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর বহুগানের স্বরলিপি সঙ্গীতবিজ্ঞান প্রবেশিকা গ্রন্থে নিয়মিত প্রকাশ হতো। তিনি ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ১১০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।