দেশে এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধী প্রতিবাদী সাহিত্য আন্দোলন স্পার্ক জেনারেশান-এর সূচনাকালে চট্টগ্রাম কবিকুলে সমৃদ্ধ থাকলেও এখানে গদ্য লেখক প্রায় দুষ্প্রাপ্যই ছিলো বলা যায়। কথাটা আগেও বলেছি হয়তো। এই প্রতিবাদী আন্দোলন সেদিন চেয়েছিলো কবিতার পাশাপাশি গদ্যেরও একরাশ উদ্যমী সৃষ্টিশীল লেখক চট্টগ্রামে তৈরি হোক।
তাই, গদ্যচর্চার জন্যে সম্পাদক প্রকাশনী থেকে “সম্পাদক” নামে নিরীক্ষামূলক একটি সাহিত্য সংবাদ বুলেটিন প্রকাশ শুরু করি আমরা, শিশির দত্তকে সম্পাদনার ভার দিয়ে। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৬ ই জুলাই ১৯৭৫ সালে। বহু বিচিত্র ধরনের মননশীল গদ্য ও তথ্যের সমাবেশে লেখকের ও পাঠকের আগ্রহ তৈরির প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছিলো। গদ্য লেখার আহ্বান জানানো হয় লেখকদের উদ্দেশে। ওই লক্ষ্যে সম্পাদক : দ্বিতীয় সংখ্যা, ১৫ এপ্রিল ১৯৭৮, সাজানো হয় আবসার হাবীব, কমল সেনগুপ্ত, খালিদ আহসান, স্বপন দত্ত ও শিশির দত্তের অতি ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিবন্ধ, ” আমি তুমি প্রেম চুমু দুঃখ প্রিয়তমার চিঠি ” ইত্যাদির সমাহারে।একই বিষয়ে অভিনব গদ্য পাঁচজনের। অন্যদিকে, প্রিয়তমার চিরকুট ফাঁস করে দেয়ার ঘটনার বিরূপ প্রতিক্রিয়া সামলানোর ঝুঁকিও নিয়েছিলো লেখকেরা।
সম্পাদক-এর এই সংখ্যাটি বেশ পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। গদ্য যে কতো ধরনের হতে পারে তারও একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত হলো, এই গদ্যপত্র। প্রায় ৪২ বছর আগের কাহিনী এটি। সেই কালে চট্টগ্রামে উল্লেখ করার মতো ঔপন্যাসিকের ছিলো না। গদ্য রচনাকারের আজকের যে ঢল চট্টগ্রামে তার জন্যে আমাদের এখন গর্ব হয়। এমন একটা চট্টগ্রামই দেখতে আমরা চেয়েছিলাম স্পার্ক জেনারেশানের সেই সাংস্কৃতিক শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে।
জীবনের অন্দরমহলের স্বাদ সংস্কৃতির সরোবরে কালে কালে নানা রূপান্তরের ঢেউ তুলেছে। সেসব ঢেউ মানস সরোবরের পাড়ের কিনারায় এসে মিলিয়ে যেতে যেতে আবার মোহগ্রস্ততায় কখনও কখনও অনুবর্তনের চক্রে আবর্তনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সেরূপ রবীন্দ্রসাহিত্য বাঙালির মনোম-লকে মুগ্ধ করে দীর্ঘদিন অধিকারে রাখে। রবীন্দ্র যুগের প্রভাব বলয় থেকে বের হওয়ার প্রচেষ্টা প্রধানত বেশ গতিময় হয়ে ওঠে ১৯২৩ সালে কল্লোল সাহিত্য পত্রকে ঘিরে। এর লেখকবৃন্দ গদ্যে পদ্যে সবদিক থেকেই স্বকীয় কলমী ভাষা ও রচনা ভিন্নতা প্রয়োগে চেতনাভাষ্যের উপযোগিতা প্রণয়নে সাহিত্যকর্মে সতর্ক পা ফেলতে শুরু করে। রবীন্দ্রোত্তর সাহিত্য আপন চরিত্রে ও সত্তায় যেনো চিহ্নিত হয়, তারই প্রয়াস ফুটে ওঠে কল্লোলের লেখকদের কবিতা, গল্প, উপন্যাসে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছায়ামুক্তির পথ ছিলো বড়ো কঠিন। কল্লোলের লেখকেরা দেশবিদেশের নানা দর্শন, মতবাদ, যুক্তিবাদ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কাল, রুশ বিপ্লব ও সাহিত্য-প্রকরণে নিজেদের সাজিয়ে এই ভূমিকা নিতে সাহসী হন।
ওই নব যাত্রাপথকে মসৃণ করতে কিংবা বলা সঙ্গত হবে যে সেই নবতর আন্দোলনকে মুখর করে তুলতে সহায়তাকারী কা-ারীর দায়িত্ব নেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধফেরত কবি নজরুল ইসলাম। এই শুরুর পর্যায়টি তৎকালীন পাঠকসমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেও বিশেষত্ব অর্জনের ঘটনাকা- রচিত হয় আরও পরে বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের দিকে ।
রবীন্দ্রবলয় মুক্তির পর্বটিকে পরবর্তীতে, বিশেষ করে একই শতকের ত্রিশের দশকের দিকে, প্রবল প্রবহমানতা দিয়ে “কল্লোল যুগ” নামাকরণে দাগিয়ে দিয়েছেলেন যারা, তারা হলেন – জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, সমর সেন, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং আরও কেউ কেউ। কাব্যধানুকী অমিয় চক্রবর্তীও এই ধারার অনুসারী রূপে উল্লিখিত হতেন। তবে, তিনি নিজেকে রবীন্দ্রধারার আবর্ত থেকে পুরোপুরি ভাবে সরাতে সক্ষম হন নি বলে ধারণা করেন সাহিত্যভাবুকেরা। বুদ্ধদেব বসুও প্রবল ভাবে রবীন্দ্রছায়া থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সচেষ্ট ছিলেন। কালের প্রবাহে তাঁর সাফল্য নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। রবি অনুগামিতা থেকে তাঁর অবমুক্তির প্রসঙ্গও গবেষকবৃন্দের মধ্যকার মত-পার্থক্যকে বিস্তৃতিতর করে। তা সে যাই-ই হোক, এখানে উল্লেখের বিষয় যা, সেটি হচ্ছে,কল্লোল যুগের লেখকেরা মনোদৈহিক বাসনা ও মানবতাবাদী ভাবনায় বাংলা সাহিত্যকে নবদৃষ্টি দান করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও, ওই যুগের লেখকেরা চিন্তা-চেতনায় যে ধরনের মননশীল ঝড় তুলেছিলো, তাকে স্বাগত জানান। সে যুগের ধারা বদলের ঢেউ তাঁকেও যে শেষ অবধি ছোঁয় নি, তা বলা যাবে না। স্মরণীয় :
প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে –
কে তুমি
মেলে নি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল।
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল
পশ্চিম সাগর তীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় –
কে তুমি ?
পেল না উত্তর।।
কল্লোল সাহিত্য পত্রিকার পৃষ্ঠপোষণায় গড়ে ওঠা সাহিত্য আন্দোলনের কালকে রবীন্দ্র বিরোধিতার যুগ রূপে অভিহিত বা চিহ্নিত করা হয়। তবে, স্পার্ক জেনারেশনের ধারণায় তৎকালীন লেখকদের প্রচেষ্টাটি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচিন্তার বিরোধিতা ছিলো না। এটা ছিলো, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধোত্তর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতির সমীকরণে ঘনায়মান আর একটি বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা এবং জেগে ওঠা সাম্যবাদী বিশ্বের প্রসারতায় মানবমুক্তির আশাবাদী ছোঁয়ায় রবীন্দ্রোত্তর যুগে পদার্পণের সাধনা। এই সাধনার হোমযজ্ঞে আহুতি দিতে গিয়ে একরাশ সৃষ্টিশীল লেখকদের আবির্ভাব সমুৎপন্ন হতে থাকে। জন্ম নেয় নোতুন সাহিত্যের ধারা।
১৯৭৩ সালের ২৩ শে ডিসেম্বরে স্পার্ক জেনারেশন তেমনই সচেতন সৃজনশীল লেখকদের আবির্ভাব আহ্বান করেছিলো বাঙালির স্বদেশে ও সংস্কৃতিকে নিরাপদ রাখার ভবিষ্যতের সংগ্রামী সৈনিক হওয়ার লক্ষ্যে। স্পার্ক জেনারেশন যুগ ছিলো তারই প্রস্তুতিকাল। সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটানোর কাল।
স্পার্ক জেনারেশন লিটল ম্যাগাজিন ও এর প্রকাশনা সংস্থা “সম্পাদক প্রকাশনী”র যাবতীয় কাজকর্ম সম্পন্ন হয়েছে তৎকালীন মফঃস্বল শহর চট্টগ্রামে বসে। চট্টগ্রামের টেরীবাজার কাটা পাহাড়ের শান্তি প্রেস, আলকরণের উদয়ন প্রেস, হাজারী গলির ভেতরের আরেকটি উপগলির কালী মন্দিরের পাশে “সাপ্তাহিক গণরাজ” এবং আরও কয়েকটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ছাপা হতো এমন একটি প্রেসের (নাম মনে পড়ছে না) সহায়তা পেরিয়ে, সর্বশেষের ঘাটি সদরঘাট কালীবাড়ির সামনের চেম্বার প্রেসই ছিলো আমাদের ছাপার নান্দনিকতার সৌকর্য প্রদর্শনের আশ্রয় ও ভরসার স্থল। স্পার্ক জেনারেশন ও সম্পাদক প্রকাশনীর মুদ্রণ সৌন্দর্য সেকালে বাংলাদেশের রাজধানীসহ সব অঞ্চলেরই মুদ্রণ কর্মগুলোর উপর টেক্কা দিয়ে এসেছে। আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল মোমেন ও আমি স্বপন দত্তসহ চারজনের চারটি কাব্যগ্রন্থ এবং বাংলাদেশের ৪৮ জন কবির কবিতা ও কাব্যভাবনার কথামালার সমাহারে প্রকাশিত ” স্বনির্বাচিত ” প্রকাশনায় আজও চট্টগ্রাম নানা সীমাবদ্ধতাকে সাথে নিয়েই মুদ্রণমাধুর্যে ‘ মিথ ‘ হয়ে আছে সারাদেশে।
১৯৮০ সালে আমার কাব্যগ্রন্থ “স্বপ্নের বসতবাটী ও অন্তর্লীন চাষ-আবাদ” চমৎকার শৈল্পিক প্রচ্ছদের জন্যে, সেবার জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের প্রথম পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলো। উল্লেখ করা উচিত হবে, সেবার প্রতি বছরের মতো জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের নির্বাচনে পুরস্কারপ্রাপ্ত বইগুলো নিয়ে কোনো ঘোষণা প্রচার মাধ্যমগুলোতে আসে নি। প্রেস রিলিজ পত্রিকায় পাঠানো হয়েছিলো কিনা কেউ জানে না। সম্ভবত বছর দুয়েক পরে প্রচ্ছদশিল্পী খালিদ আহসান আমার পরামর্শ অনুসারে দৈনিক বাংলার বাণীর রিপোর্টার প্রদীপ খাস্তগীরকে সাথে নিয়ে খোঁজ খবর করতে গেলে রহস্যটা ফাঁস হয়ে যায়।
এ ধরনের মননশীল সাংস্কৃতিক চর্চার অনুশীলনে স্পার্ক জেনারেশন ও সম্পাদক প্রকাশনীর দায়টা ছিলো চট্টগ্রামের অতীত ঐতিহ্যের ধ্বজা সমুন্নত করে রাখা।
সাধারণ্যে একটি ধারণা প্রচলিত, গ্রাম সাধারণত শহরের দিকেই পা বাড়িয়ে চলে। উদাহরণ দিয়ে বলে, এ যাত্রা হলো নদীর সাগরের উদ্দেশে ছোটার মতো। নদীর এমন চির চলমানতার উদাহরণকে তো মেনে নিতেই হয়। ঘটনাটা দৃশ্যতই বাস্তব যে। সে-ই যে গান আছে না – ” নদী যাবেই জানি, সাগরের টানে,/ আমি শুধু একা হবো, চেয়ে রবো মুখ পানে। ”
আবার, ভাষণের ভূষণ তৈরি করতে গিয়ে একই ভাবে বিদ্যাবন্ত জনেরাও প্রচার করে বেড়ান, মফঃস্বল চিরাচরিত নিয়মে শহরের আঁচলের গিটেই বাঁধা। তাই, টানে পড়ে মফঃস্বল ছোটে রাজধানীর বুকে ঝাঁপাতে। হ্যাঁ, তা ছোটে! লায়েক হলে পর বুদ্ধিমন্ত যারা, শিকড় তুলেই হাঁকড়-পাকড় করতে থাকে কোন্ ঠাঁয়ে নোঙর ফেলবে? শহরে, রাজধানীতে অপার ইশারা।আর থাকে, আপনার সৌরভে সুরভিত অনেক পদের আখড়া। নানান ধারার রঙমহলের চমক-ঢমক। আকর্ষণের হাতছানিতেও থাকে ওই জীবনের দুরন্ত সওদাগরির নিত্যনব দিনগুলোতে সওদার আহবান। ক্রমান্বয়ে পারিপাট্যে উপচে-পড়ে ভরভরম্ত হওয়ার পরিচালন, সড়কের লাল-সবুজ-হলুদ নির্দেশনা। এসব পথে প্রচ- ভীড়-ভাট্টা। নানা গলি উপগলি,আর তস্য গলি। এন্তার সুযোগ। কেবল কুড়োতে জানতে হয়। তাই, তার ফন্দি-ফিকিরও নানান কিসিমের। গ্রামগঞ্জের সরলসোজা কিংবা ঈষৎ বাঁক ফেরানো পথের মতো নয়, এ পথ। জৌলুসহীন একঘেয়েমির ভেতরে থেকেই, এখানে জীবনকে ছেনে-সেঁকে রূপরসগন্ধে রাঙিয়ে নির্মাণ করতে হয়।
এই বিনির্মাণের চাষাবাদ কিংবা ইটের পর ইট গেঁথে আকর্ষণীয় মননের মোহন ভুবনম-ল রচনা করা কঠিন কর্ম। এ দায় সকলে নেয় না। হয়তো, বোকাসোকা বুদ্ধুদেরই কেউ কেউ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ফেলে। আমরাও কেউ কেউ খুব সম্ভব এ গোত্রেরই ছিলাম।
এ গোত্রের সদস্যকুলের অসংখ্য কর্মের কিছু মন-পছন্দ্ কাজ কাম একালের পাঠক-কাম বিবেচকবৃন্দের নজরে সামনে নজরানা রূপে পেশ করলাম। হয়তো ভবিষ্যতে কখনও স্পার্ক জেনারেশন ও এর সহযোগী সন্তানরূপী সংগঠনের প্রকাশনাসমূহ গ্রন্থবদ্ধ করে আগামী কালের অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্যে নিবেদন করতে পারবো।