আমরা যখন ধীরে ধীরে বড় হই তখন পিছনে অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলি। সেটা জিনিস, স্থান বা মানুষ ও হতে পারে। আমার শৈশবে তিনটা গাছ ছিল। ঘরের পেছনে ছিল একটা নারিকেল গাছ।যে গাছের তলায় বসে দুপুরে মায়েরা ঘুমালে আমরা বন্ধুরা মিলে রান্না বাটি খেলতাম। নারিকেল গাছ থেকে ঝরে পড়া ফুল দিয়ে রান্না করতাম। পুকুর পাড়ে ছিল রেইনট্রি ও খেজুর গাছ। এই গাছ দুইটা পাশাপাশি এমনভাবে ছিল যে মাঝখানে বসে গল্প করা যেত। খেজুরের রস ও পাকা খেজুর কত খেয়েছি।রেইনট্রি গাছে বাবুই পাখির বাসা অবাক হয়ে দেখতাম। পুকুরে কত যে সাঁতার কেটেছি।সে সব কিছু এখন হারিয়ে গেল। এখন গাছগুলো নেই, পুকুর নেই,সব ইট, পাথরের দালান।
মায়ের পুরনো তিনটি গল্পের বই ছিল যেগুলো বাবা মাকে কিনে দিয়েছিল, ‘সংসার’, ‘নন্দিনী’, আর ‘অভিনয় নয়’। এই বইগুলো আমি ও পড়েছি। মায়ের এগুলো মুখস্থ ছিল। একটা ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ ছিল যার গল্পগুলো মা বলতো আর আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম।১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বন্যার সময় এই বইগুলো ভিজে নষ্ট হয়ে গেল। বাবার হাতে বানানো কাঠের আলমারিতে ছিল। সেটা ও নষ্ট হয়ে গেল। সেই বইগুলো ও হারিয়ে গেল।
আমার জন্মস্থান যেখানে আমি বেড়ে উঠেছি সেখানে প্রতিবেশী আর আমাদের ঘরগুলো পাশাপাশি লাইন করে ছিল। রান্নাঘর আর শোয়ার ঘরের মাঝখানে ছিল উঠান।সে উঠানে প্রতিবেশী বন্ধুদের সাথে ডাংগুলি, বউচি, লুকোচুরি, মার্বেল আরো নাম না জানা কত খেলায় খেলেছি। উঠানে বসে মা-জ্যাঠিমাদের সাথে পুঁথি পড়েছি। একজনের ঘর থেকে অন্যজনের ঘর দেখা যেত। সবাই কত আপন ছিল সুখে- দুঃখে। এখন দালান আর দালান। কারো সময় হয় না কারো সাথে দেখা করার।যার যার পরিবার নিয়ে ব্যস্ত সবাই। আগের খেলাগুলো কেউ খেলে না। মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। সেই চিরচেনা জায়গা আর মানুষগুলোর আন্তরিকতা কোথায় যেন হারিয়ে ফেললাম। এখন সব অচেনা মনে হয়।
দশবছর যে স্কুলে লেখাপড়া করেছি যাদের সাথে সেই সহপাঠীরা এখন কে কোথায় জানি না। তখন তো আমাদের সময় মোবাইল ছিল না। স্কুল, কলেজের দু’একজন ছাড়া আর কারো খবর জানি না। সেই আনন্দ-উল্লাসে কাটানো স্কুলের দিনগুলি আর চাইলে ও ফিরে পাব না।পাব না সেই শিক্ষকদের আন্তরিকতা মেশানো স্নেহ, শাসন, পাঠদান সেই স্কুল ও এখন অনেক বদলে গেছে। আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল সেই স্কুলজীবন। যেখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা, গান, আড্ডা, প্রতিযোগিতা, ধাপে ধাপে নতুন বছরের পড়া, নতুন বইয়ের গন্ধ, কৌতুহল সবকিছুতে ছিল যেন প্রাণের স্পন্দন। নতুন স্বপ্ন দেখা। সেই দিনগুলো এখন হারিয়ে ম্লান হয়ে শুধু স্মৃতিতে ঘোরাফেরা করে।
আমাদের জীবন ক্ষণস্থায়ী। মৃত্যু একটি পরম সত্য। জীবনের শৈশবের সোনালী দিনগুলো হারিয়ে গেলে ও তা আজীবন স্মৃতিতে রয়ে যায়। অবসরে বা স্বপ্নের ঘোরে তা বারে বারে এসে স্মরণ করিয়ে দেয়। কখনো আবছা ছায়া আবার কখনো উজ্জ্বল হয়ে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে।