বৈশাখ এলেই প্রাণে নতুন সঞ্চার আসে। প্রকৃতি সাজে নবরূপে। নতুন বছরকে আবাহন জানাতে নানারূপী ব্যস্ততা দেখা যায়। পহেলা বৈশাখ উদযাপন কিংবা বাঙালিদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বাঙালিদের সর্বজনীন অনুষ্ঠানের অন্যতম। গ্রামীণ কৃষক সমাজের ঘরে ফসল তোলা আর খাজনা আদায়ের মধ্যে সামঞ্জস্যতা আনয়নের জন্য এই বঙ্গাব্দের শুরু।
ভারতবর্ষে মুঘল শাসনামলে আরবী হিজরী পঞ্জিকা অনুযায়ী কৃষি পণ্যের খাজনা আদায়ের কাজ করা হতো। কিন্তু এই বর্ষপঞ্জি কৃষিকাজের জন্য উপযোগী ছিল না, কারণ চন্দ্র বছরের ৩১ বছর সৌর বছরের ৩০ বছরের সমান। কৃষিকাজ সৌর বছরের হিসাবের ওপর নির্ভর করা সত্ত্বেও চন্দ্র বছরের হিসাবেই কৃষকদের রাজস্ব দিতে হতো। তাছাড়া চন্দ্র বছরের ৩৫৪ দিন আর সৌর বছর ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনের মধ্যে ১১ বা ১২ দিনের ব্যবধান। ফলে রাজস্ব আদায়সহ অন্যান্য কাজকর্মে প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি হতো। ১৫৮৫ সালের ১০ কিংবা ১১ মার্চে মুঘল স¤্রাট আকবর এক ডিক্রি জারির মাধ্যমে প্রবর্তন করেন প্রাথমিক বাংলা সন তারিখ-এ-এলাহী। এই গণনা পদ্ধতির হিসেব কার্যকর হয়েছিল স¤্রাট আকবরের সিংহাসনের অধিষ্ঠিত হওয়ার সময় অর্থাৎ ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে। তিনি একটি কর্মপোযোগী, বৈজ্ঞানিক ও সর্বজনীন বর্ষপঞ্জি প্রণয়নের লক্ষ্যে সে সময়ের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমীর ফতুল্লাহ সিরাজিকে নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরির নির্দেশ দেন। এভাবে রাজস্ব আদায়ের সংস্কারের পটভূমিতে জন্ম নেয় আধুনিক বাংলা সন। প্রথমে ফসলি সন নামে প্রকাশ পেলেও, পরে তা পরিচিতি পায় বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ হিসেবে।
স¤্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের সাথে যুগপৎভাবে শুরু হয় হালখাতার প্রথা। পুরনো বছরের হিসাব গুটিয়ে নতুন হিসাব খোলার খাতাকে নাম দেয়া হয় হালখাতা। ১৬১০ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে তৎকালীন ঢাকার সুবেদার ইসলাম খান চিশতি নিজ বাসভবনের সামনে প্রজাদের মিষ্টি বিতরণ করতেন। খাজনা আদায় ও হিসাব নিকাশের সাথে সাথে চলতো নানান উৎসব ও হালখাতার অনুষ্ঠান।
হালনাগাদের খাতাটি ছিল লাল রঙের লাল সালু কাপড়ের মলাটে মোড়ানো। দুই-তিন ভাঁজ করে তার উপর ফিতা দিয়ে বেঁধে রেখে হাত বিনিময় হতো। এই খাতাটিই ছিলো বিগত বছরের যাবতীয় হিসাবের বিবরণী নথি। তবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় হালখাতা তার জৌলুস হারাতে বসেছে।
পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। এ আয়োজন ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। চট্টগ্রামের ডিসি হিল, সিআরবি, শেখ রাসেল পার্কসহ নানাস্থানে বর্ষবিদায় ও বরণের আয়োজন হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।
বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নববর্ষ উদযাপন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সর্বজনীন উৎসবে। পহেলা বৈশাখের ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আয়োজনে মেতে ওঠে সারাদেশ। ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ/ তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/ যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
বাংলা বর্ষবরণ যেন বাঙালির আত্মপরিচয় ফুটিয়ে তোলে। বর্ষবরণে কবি গান, গাজীর গান, পুতুল নাচ, ভাটিয়ালী, মুর্শীদি, বাউল গান, যাত্রাপালাসহ লাঠি খেলা, বলি খেলা, ষাঁড়দৌড়, ঘৌড়দৌড় ইত্যাদি অনুষ্ঠান যেন বাঙালির ভিতরের মনের প্রকাশ ঘটায়।
পয়লা বৈশাখ আমাদের সকল সঙ্কীর্ণতা, কুপম-ুকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবন-ব্যবস্থা গড়তে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের মনের ভিতরের সকল ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যোমে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়। অন্যদিকে পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি কামনা করা হয়। সামনে ঈদ। ঈদের আনন্দ আর বর্ষবরণের আনন্দ সবার মাঝে যেন ছড়িয়ে পড়ুক।