হুমায়ুন আজাদ আমার এক প্রিয় সাহিত্যিক। আমার বিশ্বাসই হয় না যে, আমার অস্থিমজ্জার সাথে যে নামটি জড়িয়ে আছে, আমার রক্তকণিকায় যিনি মিশে আছেন অকৃত্রিমভাবে এবং আমার শিরা-উপশিরার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যাঁর সৃষ্টি-আভা প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে- তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই! তিনি চলে গেছেন অন্যলোকে সবার হৃদয়ে হাহাকারের ঝড় তুলে। তাঁর মৃত্যু মানে এক ‘জাদুকরের মৃত্যু’। তাঁর মৃত্যু মানে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার, প্রগতিশীলতার, উজ্জ্বল আলো প্রসারিত করার প্রশস্থ রাস্তার গতিরোধকতা। দার্শনিক সরদার ফজলুল করিমের ভাষায়, ‘এমন মৃত্যু কি আছে, যে মৃত্যু ব্যক্তিকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে, সরকারকে আত্মজিজ্ঞাসা, জবাবদিহিতা এবং দীনতায় একাকার করে?’ হুমায়ুন আজাদের মৃত্যু মানে সে রকমই মৃত্যু। হুমায়ুন আজাদ মৃত্যুর পরও অমর; মৃত্যুঞ্জয়ী। তাঁর আমৃত্যু ঋজু-ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছায়া আমাদের চোখের সামনে ভাসবে, অবিরাম-অবিরল। তাঁর সৃষ্টি সম্ভার আমাদের নিয়ে যাবে আলোর পথে। তাঁর দৃঢ়তাপূর্ণ চরিত্র, জীবনযাপন ও পা-িত্য আমাদের প্রভাবিত করবে নিরন্তর।
২.
হুমায়ুন আজাদ এক বিরল প্রতিভা। ‘বহুমাত্রিক লেখক’, ‘জ্যোতির্ময়ী ব্যক্তিত্ব’, ‘প্রথাবিরোধী লেখক’ ইত্যাদি বিশেষণে তাঁকে ভূষিত করা হলেও আমি জানি – এসব বিশেষণ থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে। তাঁর মতো জ্ঞানী, সৃষ্টিশীল, মননশীল, উদার, নীতিবোধসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব এ বাংলায় দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে কিনা আমার সন্দেহ। সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ, গবেষণা, কিশোরসাহিত্য, ভাষাচিন্তা ও সমালোচনা-সাহিত্যে তিনি যে অবদান রেখেছেন, তা এক-কথায় অতুলনীয়। তাঁর অসামান্য অবদানের কথা জাতি কখনো ভুলবে না। তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকর্মের মধ্যে মানবিকতা, আদর্শবোধ ও সত্যপরায়নতা যেমন প্রচ্ছন্ন হয়ে ধরা দেয়, তেমনি অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে একটা স্পষ্ট প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়-কখনো উচ্চৈঃস্বরে, কখনো নীরবে। তাঁর অকুণ্ঠচিত্ত মনোভাব তাঁকে ‘অদ্বিতীয়’র মর্যাদা দিয়েছে, তাঁর ভাষাজ্ঞান ও পা-িত্য তাঁকে পরিণত করেছেন ‘মহীরূহে’, সুন্দরের প্রতি তাঁর মুগ্ধতা, তাঁর আবেগ, তাঁর প্রকাশ তাঁকে করে তুলেছে প্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে। যুক্তিহীনতার যুগে বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠার অকৃত্রিম পাঠ আমরা আর কার কাছ থেকে পাবো? কে জানাবে- ‘যত উপরে যাই নীল আর যত গভীরে যাই মধু?’ ‘লাল নীল দীপাবলী’র দেশে কে বোঝাবে ‘কতো নদী সরোবর?’ ‘অলৌকিক স্টিমারে’ চড়ে তিনি চলে গেলেন সেই শহরে, যে ‘শহরে একদল দেবদূত’ তাঁর সঙ্গী হয়ে আছেন।
৩.
হুমায়ুন আজাদ তাঁর প্রবচনগুচ্ছের জন্যও একসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। তাঁর অনেকগুলো প্রবচনের মধ্যে আলোচিত প্রবচন ছিল : ‘সেদিন শামসুর রাহমানকে দেখা গেছে টেলিভিশনে এক অভিনেত্রীর সঙ্গে। শামসুর রাহমান জানেন না-কার সাথে পর্দায় যেতে হয়, আর কার সাথে শয্যায় যেতে হয়’। প্রবচনটি প্রকাশের পর পাঠকমহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। যে হুমায়ুন আজাদ শামসুর রাহমানকে বাংলাদেশের ‘প্রধানতম কবি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন, যিনি ‘শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা’ বই লিখে অতুলনীয় কর্মটি সম্পাদন করেছেন, সেই হুমায়ুন আজাদ তাদের প্রিয় কবি সম্পর্কে এ কি মন্তব্য করলেন! সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন শামসুর রাহমানের দিকে : ‘শামসুর রাহমান কী জবাব দেবেন!’ কিন্তু না, শামসুর রাহমান ছিলেন চুপচাপ। তিনি বুঝে নিয়েছেন এখানে তাঁর নামটি প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
এর কিছুদিন পর হুমায়ুন আজাদের আরেকটি প্রবচন সারা দেশে বিতর্কের ঝড় তোলে। প্রবচনটি হচ্ছে : ‘আগে কাননবালারা আসতো পতিতালয় থেকে, এখন আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে’। এটি প্রকাশিত হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ছাত্ররা মিছিল করে, শিক্ষকরা পত্রিকায় বিবৃতি দেন। এমন কি তৎকালীন উপাচার্য তাঁকে ‘উন্মাদ’ আখ্যায়িত করে পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেন। সকলের বক্তব্যের সারসংক্ষেপ এই : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে হুমায়ুন আজাদ কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সম্পর্কে এমন ন্যক্কারজনক মন্তব্য করতে পারলেন? তাঁর শাস্তি হওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হোক। তাদের এ বক্তব্যের সমর্থনে কলম ধরলেন আমাদের আরেক সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। সংবাদ পত্রিকায় তাঁর ‘হৃদকলমের টানে’ কলামে হুমায়ুন আজাদের এই প্রবচনের বিরুদ্ধাচরণ করেন। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেয়ার ব্যাপারটি তিনি সমর্থন করেন নি। এতো মিছিল, এতো বিবৃতি, এতো বিরোধিতা সত্ত্বেও হুমায়ুন আজাদ ছিলেন দৃঢ়। তাঁর বক্তব্যের ব্যাপারে তিনি যেমন অটল ছিলেন, তেমনি ছিলেন আপসহীন। বক্তব্য প্রত্যাহার দূরে থাক, বক্তব্যের সমর্থনেও কোনো কথা বলতে চাননি। কিন্তু ‘হৃদকলমের টানে’ কলামে সৈয়দ শামসুল হকের মন্তব্য প্রকাশের পর সাংবাদিকরা গেছেন ড. আজাদের প্রতিক্রিয়া জানতে। তাঁরা প্রশ্ন করেন, ‘আপনাকে নিয়ে চারিদিকে হই চই, কিন্তু আপনি নীরবতা পালন করছেন। আপনার বন্ধু সৈয়দ শামসুল হকও আপনার বিরুদ্ধে লিখলেন’। তখন ড. আজাদ বললেন, ‘হ্যাঁ, লেখাটা পড়লাম। সৈয়দ হকের মস্তিষ্ক যে এতো নিষ্ক্রিয় তা আগে জানতাম না’। এবার তিনি তাঁর প্রবচনের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিলেন : ‘ঐ প্রবচনে আমি তো প্রগতির কথা বলেছি। উত্তরণের কথা বলেছি। সফলতার কথা বলেছি। আগে সিনেমার নায়িকা করার জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যেতো না। কাননবালাকে ধরে আনতে হয়েছে পতিতালয় থেকে। কিন্তু এখনকার সময়ে সিনেমার নায়িকা হওয়ার জন্য মেয়েরা আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। উচ্চতর শ্রেণীতে পড়ালেখা করা মেয়েরা লাইন ধরে নায়িকা হওয়ার জন্য। এই অগ্রগতির চিত্রটি তুলে ধরা হয়েছে আমার প্রবচনে’।
হুমায়ুন আজাদের এ ব্যাখ্যার পর সব হই চই থেমে গেলো, বন্ধ হলো ঝড়ের তা-ব। এ রকম স্পষ্টচিন্তার মানুষ হুমায়ুন আজাদ। তাঁর মৃত্যু মানে অগ্রচিন্তার অগ্রনায়কের প্রস্থান।

৪.
হুমায়ুন আজাদ তাঁর বক্তব্য প্রকাশে যেমন সাহসিকতার পরিচয় দিতেন, তেমনি যে কোনো বিষয়ে মত প্রকাশে ছিলেন দৃঢ় ও নির্ভীক। ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র-কাউকে তোয়াক্কা না করে অবলীলায় উত্থাপন করতেন তাঁর বক্তব্য। তিনিই একমাত্র লেখক-যিনি চলায়, বলায়, লেখায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তাঁর দুর্বলতা কেবল মনুষ্যত্ব ও মানবতার প্রতি। মানুষের উন্নয়নেই তাঁর সকল জয়গান।

 

 

৫.
হুমায়ুন আজাদের আনেকগুলো সত্তা এবং প্রতিটি সত্তাই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটিতেই তিনি সৃজনশীলতা ও মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি সবসময় লিখেছেন সচেতনভাবে। তাই তাঁর লেখার প্রক্রিয়াটি হচ্ছে একটি যৌক্তিক প্রক্রিয়া, তাঁর লেখার প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ ছুটে যায় অভীষ্ট সিদ্ধির দিকে। চূড়ান্তভাবে তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের সমাজকে, সংস্কৃতিকে, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে সর্বোপরি বাংলাদেশের সমগ্র প্রসঙ্গ কাঠামোকে।
হুমায়ুন আজাদ একজন কবি, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক, রাজনীতিক ভাষ্যকার, কিশোরসাহিত্যিক, গবেষক, এবং শিক্ষাবিদ ছিলেন। তাঁর ৭টি কাব্যগ্রন্থ, ১২টি উপন্যাস ও ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৭টি ভাষাবিজ্ঞানবিষয়ক, ৮টি কিশোরসাহিত্য ও অন্যান্য প্রবন্ধসংকলন মিলিয়ে ৬০টিরও অধিক গ্রন্থ তার জীবদ্দশায় এবং মৃত্যু পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। এতোসব সৃষ্টিকর্মের মধ্যে তাঁর কিশোরসাহিত্যসমগ্র অনন্য সম্পদ হিসেবে আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে জ্বলজ্বল করবে। কিশোরসাহিত্যিক তাঁর খ-িত পরিচয় হলেও তাঁর প্রতিভা ও মননের অসাধারণ দিক উন্মোচনকারী কিশোরপাঠ্য বইগুলোর জন্য তিনি দেদীপ্যমান। তাঁর কিশোর সাহিত্যগুলো হলো : লাল নীল দীপাবলি বা বাংলা সাহিত্যের জীবনী, কতো নদী সরোবর বা বাংলা ভাষার জীবনী, ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, আব্বুকে মনে পড়ে, আমাদের শহরে একদল দেবদূত, বুক পকেটে জোনাকি পোকা, অন্ধকারে গন্ধরাজ, আওয়ার বিউটিফুল বাংলাদেশ।
লাল নীল দীপাবলি দিয়েই তাঁর যাত্রা শুরু করেছিলেন হুমায়ুন আজাদ কিশোরসাহিত্য জগতে। এটি বাংলা সাহিত্যের জীবনী। এই গ্রন্থে মোট ছাব্বিশটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে : লাল নীল দীপাবলি, বাঙালি বাঙলা বাঙলাদেশ, বাঙলা সাহিত্যের তিন যুগ, প্রথম প্রদীপ: চর্যাপদ, অন্ধকারে দেড়শ বছর, প্রদীপ জ্বললো আবার: মঙ্গলকাব্য, চ-ীমঙ্গলের সোনালি গল্প. মনসামঙ্গলের নীল দুঃখ, কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র, উজ্জ্বলতম আলো: বৈষ্ণব পদাবলি, বিদ্যাপতি, চৈতন্য ও বৈষ্ণবজীবনী, দেবতার মতো দুজন এবং কয়েকজন অনুবাদক, ভিন্ন প্রদীপ: মুসলমান কবিরা, আলাওল, লোকসাহিত্য: বুকের বাঁশরি, দ্বিতীয় অন্ধকার, অভিনব আলোর ঝলক, গদ্য: নতুন সম্রাট, গদ্যের জনক ও প্রধান পুরুষেরা, কবিতা: অন্তর হ’তে অহরি বচন, উপন্যাস: মানুষের মহাকাব্য, নাটক: জীবনের দ্বন্দ্ব, রবীন্দ্রনাথ : প্রতিদিনের সূর্য, বিশশতকের আলো : আধুনিকতা। এই প্রবন্ধগুলোর মাধ্যমে লেখক তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যের বহু বছরের পর্যায়ক্রমে বিবর্তিত হওয়া ইতিহাস।
কতো নদী সরোবর বা বাংলা ভাষার জীবনী। এটিও অসাধারণ। এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে চাতকচাতকীর মতো, জন্মকথা, আদি-মধ্য-আধুনিক : বাঙলার জীবনের তিন কাল, গঙ্গা জউনা মাঝেঁরে বহই নাঈ, কালিন্দীর কূলে বাঁশি বাজে, হাজার বছন ধরে, ধ্বনি বদলের কথা, ধ্বনি পরিবর্তন, আমি তুমি সে, জলেতে উঠিল রাহী, বহুবচন, আইসসি যাসি করসি, সোনালি রুপোলি শিকি, বাঙলা শব্দ, ভিন্ন ভাষার শব্দ, বাঙলা ভাষার ভূগোল, আ কালো অ সাদা ই লাল, গদ্যের কথা, মান বাঙলা ভাষা : সাধু ও চলতি, অভিধানের ইতিকথা, ব্যাকরণের কথা, যে সব বঙ্গেত জন্মি, বাঙলা ভাষা : তোমার মুখের দিকে।
এতো সহজ সাবলীল ভাষায় বই দুটি রচিত হয়েছে, যা এক কথায় অসাধারণ। বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষার ইতিহাস এতো চমৎকার সহজ করে লেখা বই দেশে আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বলতেই হয়, হুমায়ুন আজাদ বাংলা শিশুকিশোর সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি কিশোর সাহিত্যে এনেছেন নতুন ধারা। তাঁর অনন্য স্বকীয় ঢঙ, মেজাজ আর প্রতিভায় দেশের কিশোরসাহিত্যে এসেছে অনাবিল সৌন্দর্য। শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি যা লিখেছেন, তা এক কথায় অতুলনীয়। সহজ সরল ভাষা, ছোটো ছোটো বাক্য, বর্ণনার সাবলীলতা-সব মিলিয়ে তাঁর সমস্ত রচনা সুন্দর, মধুর, সুললিত ও চিত্তসঞ্চরণশীল।
‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’- হুমায়ুন আজাদের আত্মজৈবনিক স্মৃতিচারণমূলক আরেক চমৎকার গ্রন্থ। উপন্যাসের আদলে তাঁর বেড়ে ওঠা, তাঁর গ্রাম, তাঁর শৈশব অপরূপ হয়ে ধরা দিয়েছে এই গ্রন্থে। কী চমৎকার করে শুরু করেছেন তিনি এই লেখা, ভাবতে গেলেই অবাক হতে হয় : ‘মৌলি, তোমাকে বলি, তোমার মতোই আমি একসময় ছিলাম- ছোট, ছিলাম গাঁয়ে, যেখানে মেঘ নামে সবুজ হয়ে নীল হয়ে লম্বা হয়ে বাঁকা হয়ে। শাপলা ফোটে; আর রাতে চাঁদ ওঠে শাদা বেলুনের মতো। ওড়ে খেজুর গাছের ডালের অনেক ওপরে। যেখানে এপাশে পুকুর ওপাশে ঘরবাড়ি। একটু দূরে মাঠে ধান সবুজ ঘাস কুমড়োর হলদে ফুল। একটা খাল পুকুর থেকে বের হয়ে পুঁটিমাছের লাফ আর খলশের ঝাঁক নিয়ে চলে গেছে বিলের দিকে। তার উপর একটি কাঠের সাঁকো। নিচে সাঁকোর টলোমলো ছায়া। তার নাম গ্রাম… তার কিছুটা তোমাকে শোনাই, হে নাগরিক মৌলি, যে গ্রাম তুমি দেখো নি, পাতায় পাতায় দেখো নি নিশির শিশির…’। আহা! পাতায় পাতায় ঝরে পড়ে সৌন্দর্য। সৌন্দর্যের পর সৌন্দর্যের হাতছানি। ভাষা, শব্দ, ছন্দ আর সঙ্গীতের সুরের মতো অপরূপ হয়ে উঠেছে চারপাশে প্রকৃতি। রাঢ়িখাল গ্রামের ফুলের গন্ধ, আড়িয়ল বিলের জলস্রোত, সবুজের স্নিগ্ধতা, বেদনাবিধূর স্মৃতি ফুটে উঠেছে এই গ্রন্থে। বলা যায়, ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ হুমায়ুন আজাদের শৈশব অনুভূতির সুকোমল অসাধারণ অতুলনীয় স্মৃতিচারণ।
‘আব্বুকে মনে পড়ে’ হুমায়ুন আজাদের অসাধারণ একটি উপন্যাস। এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয় ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। ঘটনার অসাধারণ বর্ণনায় পাঠক অভিভূত না হয়ে পারে না। উপন্যাসের এক অংশে তিনি লিখছেন :
“পাশের বাড়ির একজন চিৎকার ক’রে বললো, ‘ আপনাদের ছাদ থেকে বাঙলাদেশের পতাকা নামান। ওইখানে পাকিস্তানি নিশান উড়ান।’ আব্বুর সাথে আমিও দৌড়ে বারান্দায় গেলাম। দেখি ছাদে ছাদে যেখানে উড়ত বাঙলাদেশের পতাকা সেখানে আবার উড়ছে পাকিস্তানদের চানতারা মার্কা নিশান। কোথাও লাল সূর্য নেই। সূর্যের বাঙলার মানচিত্র নেই।
পাশের বাসার লোকটি আবার বললো, ‘পাকিস্তানের নিশান উড়ানোর হুকুম দেয়া হয়েছে।’
আব্বু তাড়াতাড়ি ছাদে গিয়ে বাঙলাদেশের পতাকাটি নামিয়ে আনলো।
থরথর ক’রে কাঁপছে আব্বু।
আব্বু বললো, ‘এটিকে এখন রাখবো কোথায়’?
কেউ জানে না কোথায় রাখবো? বুকের ভেতরে?
এরপর আব্বু বললো, ‘একটা পাকিস্তানের নিশান না আমাদের ছিল?’
আম্মু বললো, ‘কী যেনো ওটা যে এখন কোথায়!’
আব্বু খাটের নিচে, রান্নাঘরে, ময়লা রাখার জায়গায় খুঁজতে লাগলো। ময়লার ভেতরে পাওয়া গেলো চানতারা মার্কা নিশানটি। কিন্তু এটাতো আর নিশান নেই। ময়লা ত্যানা হয়ে গেছে। কোনো কাজে লাগবে না ভেবে কাকু এটা দিয়ে জুতো মুছেছে। আব্বুও জুতো মুছেছে। ফজিলা ওটাকে দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করেছে। ওটা শেষ হয়ে গেছে। ওটাকে কি ছাদে টানানো যায়? চাঁদ তো ওর ছিঁড়ে ঝুলে পড়েছে; আর তারা খসে পড়েছে কোথায়?
আব্বু বললো, ‘একটা পুরানো সবুজ কাপড় দাও তো।’
ফজিলার একটা পুরানো সবুজ শাড়ি পাওয়া গেলো। পাওয়া গেলো একটা পুরানো শাদা কাপড়।
বানোনো হলো চানতারামার্কা নিশান। নিশানটা উড়তে চায় না। ঝুলে পড়তে চায়।
আব্বু ছাদে টানিয়ে দিয়ে এলো নিশানটি। ঝুলে রইল নিশানটা লাঠির মাথায়। যেনো এটি আর উড়বে না। কাকু নিশানটার গায়ে থুতু ছুঁড়ে দিলো।
আমাদের ছাদে থুতুর দলার মতো ঝুলতো লাগলো পাকিস্তানি নিশানটা।”

পাকিস্তানি চানতারায় ঘৃণা ছোঁড়ার জন্য এর চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনো উদাহরণ হতে পারে না। সেই পতাকা ময়লা ত্যানা হয়ে গেছে। ‘কোনো কাজে লাগবে না ভেবে কাকু এটা দিয়ে জুতো মুছেছে। আব্বুও জুতো মুছেছে।’ আহ, কী চমৎকার!
অসম্ভব আবেগপূর্ণ উপন্যাসটি শুধু ছোটোরা নয়, বড়দেরও উদ্দীপ্ত করবে। বাবার চরিত্রটি এখানে অসম্ভব মানবীয় আর আদর্শবান করে বর্ণনা করা হয়েছে। বইটি পড়তে পড়তে কখন যে চোখে জল চলে আসে, বুঝতেই পারি না। লিখছেন :
“ষোলো বছর ধরে আমি আব্বুর সাথে একা একা কথা বলি। আমার বন্ধুরা ওদের আব্বুকে খুব ভয় পায়। আমি আব্বুকে একটুও ভয় পাই না। সব সময় শুধু আব্বুর মুখোমুখি হই । এ দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় আব্বুর সামনে পড়ি, ঐ দরজা দিয়ে বেরোানোর সময় আব্বুর সামনে পড়ি। বারান্দায় পাশপাশি দাঁড়াই। রিকশা ঠিক করার সময় দেখি আব্বু বারান্দা থেকে হাঁসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ‘আব্বু, আমি যাই ’– আমি বলি। ‘রিকশায় ঠিকমতো বসে যাস’-আব্বু হাত নেড়ে বলে। ‘তুমি ভয় পেয়ো না’, আমার রিকশা চলতে শুরু করে, পেছনে ভাসতে থাকে আব্বুর হাসি। কিন্তু প্রথম বাঁকটি পেরিয়ে রিকশাটি যেই দ্বিতীয় বাঁক নিতে যাবে, দেখি সামনের দিক থেকে ছুটে আসছে আব্বুর রিকশা।…আমার আব্বুর মতো কারো আব্বু আর সবজায়গায় ছড়িয়ে নেই, সব জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই–চতুর্দিকে হাসে না–সারাক্ষণ ধরে কাছে আসে না। আব্বুকে আমার মনে পড়ে। আব্বুকে আমার মনে পড়ে না!”

হুমায়ুন আজাদের সমস্ত কিশোররচনা-লাল নীল দীপাবলি, কতো নদী সরোবর, ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, আব্বুকে মনে পড়ে, আমাদের শহরে একদল দেবদূত ও বুক পকেটে জোনাকি পোকা-এ সবের সবচেয়ে বড় আকষর্ণের দিক হলো লেখকের ব্যঞ্জনাময় সুললিত কাব্যিক ভাষা। গদ্যও যে কবিতার মতো অপূর্ব বাক্সময় হয়ে পাঠকের কাছে ধরা দিতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই বইগুলো। প্রতিটি রচনায় সহজাত কাব্যবোধ মিশে আছে। হাসি, আনন্দ, দুঃখ, কষ্ট, ভালোবাসা, হতাশা, হাহাকার প্রভৃতি মানবিক আবেগের ওঠা-নামা এবং উপমার অপূর্ব প্রয়োগ লেখাগুলোকে প্রাঞ্জল করে তুলেছে।

হুমায়ুন আজাদের গদ্য যেমন অসাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কবিতাও অপূর্ব। তাঁর একেকটি কবিতা যেন একেকটি হীরের টুকরো। ‘শুভেচ্ছা’ কবিতায় তিনি লিখলেন :

ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো
চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো।
ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।
ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।
ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।
ভালো থেকো কাক কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাঁশি।
ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি।
ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।
ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,
ভালো থেকো বক আড়িয়ল বিল,
ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও,ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।

অসাধারণ। প্রকৃতির ছবির পাশাপাশি শৈশবের গ্রামীণ জীবনের অসামান্য ছবিও এ কবিতায় ফুটে উঠেছে, যা সৌন্দর্যে উজ্জ্বল। তাঁর কবিতার বড় বৈশিষ্ট্য কঠিন বিষয়কেও সহজ করে উপস্থাপন। সৌন্দর্য উপস্থাপনার জাদুকর তিনি। বিষয়ে, ভাষায়, সৌন্দর্যের তীব্রতায় ও শিল্পকলাবোধে তিনি অনন্য। তাঁর ভাষা ব্যবহার, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন একান্তই নিজস্ব। তাঁর কাব্যিক ভাষা, আঙ্গিক ও চিত্রকল্পের ব্যবহার অসাধারণ, যা কবিতাকে দ্যুতিময় করে তোলে।

‘বই’ হুমায়ুন আজাদের আরেক অনন্য সৃষ্টি। তিনি লিখলেন :

বইয়ের পাতায় প্রদীপ জ্বলে
বইয়ের পাতা স্বপ্ন বলে।
যে-বই জুড়ে সূর্য ওঠে
পাতায় পাতায় গোলাপ ফোটে
সে-বই তুমি পড়বে।
যে-বই জ্বালে ভিন্ন আলো
তোমাকে শেখায় বাসতে ভালো
সে-বই তুমি পড়বে।
যে-বই তোমায় দেখায় ভয়
সেগুলো কোনো বই-ই নয়
সে-বই তুমি পড়বে না।
যে-বই তোমায় অন্ধ করে
যে-বই তোমায় বন্ধ করে
সে-বই তুমি ধরবে না।
বইয়ের পাতায় প্রদীপ জ্বলে
বইয়ের পাতা স্বপ্ন বলে।

অসাধারণ এই কবিতাটা পড়ে পাঠক বইয়ের পাতায় জ্ঞানের সত্যিকারের আলো খুঁজতে অনুপ্রাণিত হয়। বইয়ের পাতায় প্রদীপ জ্বলে, বইয়ের পাতায় স্বপ্নের কথা বলে। নিজের কবিতা সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, আমি অনেক ক্ষেত্রে ছন্দ মানার জন্য ছন্দ মানিনি, যদি দেখেছি যে ছন্দের কবিতার মধ্যেও মাত্রা মিলিয়ে ছন্দটি কৃত্রিম মনে হচ্ছে, তখন আমি তা মানিনি। স্তবকবিন্যাস, চিত্রকল্প, রচনা পদ্ধতি, রূপক তৈরির পদ্ধতি, ভেতরে তো চেতনা রয়েছেই।

চাঁদ নিয়ে আছে হুমায়ুন আজাদের একটি কবিতা। যেটি আমার পড়া শ্রেষ্ঠ একটি কিশোরকবিতা। কবিতাটি এখানে উল্লেখ করতে চাই :

একটি দোয়েল এসেছিলাম রেখে
হিজল গাছের ডালে,
ইচ্ছে ছিল দেখবো গিয়ে তারে
আবার গ্রীষ্মকালে।
আবার গিয়ে তাকিয়ে দেখি সেই
আমার দোয়েল নেই।

বটের ছায়া এসেছিলাম রেখে
দিঘির কালো জলে,
ইচ্ছে ছিলো দেখবো গিয়ে তারে
আবার সময় হ’লে
আবার গিয়ে তাকিয়ে দেখি সেই
আমার ছায়া নেই।

একটি ফুল এসেছিলাম রেখে
রক্তজবার ডালে,
ইচ্ছে ছিল দেখবো গিয়ে তারে
মেঘলা বর্ষাকালে।
আবার গিয়ে তাকিয়ে দেখি সেই
আমার ফুলটি নেই।

একটি চাঁদ এসেছিলাম রেখে
সন্ধ্যারাতের কাছে,
অনেক মেঘ অনেক রোদের শেষে
দাঁড়াই আমি মাঠের ধারে এসে
দেখতে পাই আমার চাঁদ
আগের মতোই আছে।

অপূর্ব। একটি চিরায়িত কবিতা। গতানুগতিক ধারা ভেঙে তিনি এমন নিটোল কবিতা রচনা করেছেন, যেখানে বক্তব্য, চিত্রকল্প ও ভাষাবিন্যাসে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। শুধু শিশুকিশোর নয়, সব বয়সী মানুষের মনোভঙ্গি, স্মৃতি, দুঃখ-কষ্ট, যাপিত জীবন ঘিরে কবির আগ্রহ। কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের মধ্যে খুঁজে পেতে চেয়েছেন শুভ্রতা। শব্দের সঙ্গে শব্দের মেলবন্ধনে তিনি সৃষ্টি করেছেন সৌন্দর্য, যা আমাদের আলোড়িত করে, অভিভূত করে।
মোট কথা, হুমায়ুন আজাদের সমস্ত কিশোররচনা সৌন্দর্যমুগ্ধতার সমন্বয়ে সৃষ্টি। তাঁর প্রতিটি লেখাই সাবলীল, স্বচ্ছন্দ, আকর্ষণীয়, সুকোমল ও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যেন জাদুকরের আশ্চর্য ক্ষমতায় পাঠকদের উদ্দীপ্ত করছেন। যতই পড়ি, ততই মুগ্ধ হই।

৬.
হুমায়ুন আজাদ আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু আছে তাঁর সৃষ্টি সম্ভার। জাতির নানা দুর্যোগপূর্ণ সময়ে নানাভাবে দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি, এখন দেবে তাঁর রচনাসম্ভার। তাঁর সৃষ্টিকর্ম আমাদের আলোক সন্ধানে যেমন সাহায্য করবে, তেমনি সহযোগিতা করবে আলো বিতরণে। আমরা তাঁর রচনার সনিষ্ঠ পাঠক, আমরা তাঁর আলো ঝলমলে রচনা পড়ে হতে চাই আলোকিত মানুষ।