ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল ভূস্বর্গ দেখবো একদিন। এরপর বিভিন্ন চ্যানেল এ কাশ্মীরের রূপে মুগ্ধ হতাম। কিন্তু কাশ্মীরে রাজনৈতিক সমস্যা তো লেগেই থাকতো, তাই ইচ্ছে গুলোকে নিজের মধ্যে রেখে দেয়া ছাড়া উপায় নেই।
২০১৯ সালে জানুয়ারী তে মনে হলো এইবার কাশ্মীর দেখবোই। এইবার ইচ্ছেগুলোকে মুক্তি দেব।
উজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে কথা হলো। উনিও সব ব্যবস্থা করে দিলেন। টিকেট কাটা হলো। ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখে । কিন্তু ঘটনা ঘটে গেলো সম্ভবত ১৫ তারিখ। কাশ্মীরে বোমা বিস্ফোরণ-
স্বপ্ন ভঙ্গ ۔۔আর যাওয়া হবে না ۔۔নিশ্চয় বর্ডার সিল করে দেবে।

কিন্তু টিকেট ক্যান্সেল করতে হলো না। উজ্জ্বল ভাই সমানে সাহস দিয়ে যাচ্ছিলেন।
সারাদিন অফিস করে সন্ধ্যায় ঢাকা। পরেরদিন ঢাকা থেকে কলকাতার ফ্লাইট। ভোরে কলকাতা থেকে দিল্লি । ফ্লাইট ডিলে হয়েছিল। ঐদিকে কাশ্মীরের প্লেইন অপেক্ষা করছে। আমরা অনেকখানি নার্ভাস। আমাদের নাম এনাউন্স হচ্ছে। দৌড়োচ্ছি আর দৌড়োচ্ছি । শেষে প্লেইনে এসে বসলাম। সবার বিরক্তিকর দৃষ্টি আমাদের উপর। ১০ মিনিট চলে গেলো আমাদের জন্য ।
কাশ্মীরের আকাশ থেকে দেখতে পাচ্ছি অপূর্ব সেই দৃশ্য। বরফে আচ্ছাদিত পাহাড়ে সূর্যালোক ঠিকরে পড়ছে।
শ্রীনগরে নেমেই বুঝতে পারলাম এই ঠান্ডার সাথে আমার পরিচয় নেই। হাত পা জমে যাচ্ছে কোথায় উঠবো? কী করবো ?আগে থেকে কিচ্ছু ঠিক করিনি। ওখানে নেমেই কয়েকজনের সাথে কথা বলে স্থির করলাম, ডাল লেকে বজরাতে থাকবো। অন্যরকম অভিজ্ঞতা। ভাবতেই রানী রানী একটা ভাব খেলে গেলো মনে।
শ্রীনগরের বিকেলটা খুব সুন্দর কাটলো। শালিমার গার্ডেন ,ডাল লেকের আশেপাশে ঘুরলাম, নবাবদের বিভিন্ন ফোর্ট ঘুরে ঘুরে দেখলাম। শুরু হলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।
রাত বাড়ছিল সাথে ঠান্ডাও। জাভা মাউন্টেইন এর বরফ গলা জল এর উপর বজরা ষ জমে যাচ্ছিলাম যেন। হিটার ও কমাতে পারছিলো না তীব্র ঠান্ডা।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে রওনা দিলাম পেহেলগামের উদ্দেশ্যে। বাইসরাইন পর্বতে উঠবো ঘোড়ার পিঠে চড়ে। ওঠার আগে বুঝিনি ঘোড়ার পিঠে একটানা দুই ঘন্টা থাকা যে কী মধুর। অভিজ্ঞতার কিন্তু শেষ নেই।
উঠলাম সাহস করে। বরফের মধ্যে ঘোড়ার পা দেবে যাচ্ছিলো বার বার। নিচের দিকে ভয়ে তাকাচ্ছিনা। একটু এধার ওধার হলেই ছিটকে নীচে। জীবন কাশ্মীরেই শেষ। গাইড নিজেই ঘোড়া সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। উঠলাম ۔۔দেখলাম বরফে ঢাকা পর্বতের রূপ। অপূর্ব সেই রূপ।

নামার সময় বুঝলাম কী কঠিন কাজটা করেছি ষ মনে হচ্ছে এই বুঝি মুখ থুবড়ে পড়বো ঘোড়া সহ ষ একটু পর শুনলাম বাচ্চার কান্না – অনুরণিত হচ্ছে মা আর বাচ্চার আহাজারি – ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছিলো – ঘোড়ার স্টেপ উল্টোপাল্টা হওয়াতেই ছিটকে পড়লো বরফে – পায়ে খানিকটা চোট লেগেছিলো।
যাই হোক, নীচে নেমে আসলাম নিরাপদে ।শেষ হলো পেহেলগাম পর্ব-

ডাল লেকের বজরায় ফিরে এসে ইউনুছ চাচার হাতের চমৎকার বিরিয়ানী গোগ্রাসে খেলাম – প্রচন্ড ক্ষিদে ছিল – কনকনে ঠান্ডার আরেকটা সুন্দর রাত কাটালাম লেকের উপর বজরাতে-

পরের দিন ভোরে নাস্তা করে রওনা দিলাম গুলমার্গের উদ্দেশ্যে ষষ রাস্তার দুই পাশে বরফ আর বরফ ষষসেই বছর কাশ্মীরে সব চেয়ে বেশী বরফ জমেছিলো, তাই মন ভরে বরফ ও দেখা হলো – তবে গাদা গাদা শীতের পোশাক গায়ে বহন করে চলাটা খুব অস্বস্তিকর ছিল –
থমথমে পরিবেশ – কিছুদূর যাবার পর দেখলাম জোয়ানরা বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে -সারি সারি যুদ্ধবহর ট্যাংক রাস্তার পাশে – মোড়ে মোড়ে তল্লাশি চলছে – সেইদিন বন্ধ চলছিল কাশ্মীরে – ওদের এক নেতাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল –
সত্যিই ভয় লাগছিলো – যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব চারিদিকে –
আমাদের গাড়িতে গান বাজছিলো কেন, সেই জন্য গাড়ী থামিয়ে ড্রাইভার আব্দুল্লাহকে বের করে অশ্রাব্য গালিগালাজ আর মারছিলো – এতগুলো জোয়ান মারা গেছে আর আমরা পর্যটক হয়ে গান শুনতে শুনতে ঘুরতে যাচ্ছি বিষয়টা দৃষ্টিকটু ছিল ষ পরে বুঝতে পারলাম – তখন ওদের শোক চলছিল ষ আমরা সেইটা অনুভব করতে পারিনি –

আপেল বাগানে আপেল ছিল না, পাতাও ছিল না – বসন্তে কাশ্মীর মারাত্মক সুন্দর – তখন আপেল আর টিউলিপ ফুলে ভরে থাকে বাগান – অপূর্ব সেই দৃশ্য!তাই তিন ঋতুতে তিনবার যেতে হয়, কাশ্মীরের পুরো সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে চাইলে!

কাশ্মীরের ছেলে এবং মেয়েরা কিন্তু খুব সুন্দর -আমার গাইড ও সুপুরুষ ছিল। চারদিন কাশ্মীরে ছিলাম ষ মি: ওমর আমাদের গাইড করেছিল।
বজরা উনার বাবার ষ বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের চেয়ে ওমর দারুন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন ছিলেন – কাশ্মীরের কঠিন সময়ে আমাদের নিরাপদে কাশ্মীর ঘুরে দেখানোর দায়িত্ব নিয়েছিল এবং সেইটা সে সুন্দর ভাবে পালন করেছিল –
শেষ দিন এয়ারপোর্ট অব্দি সে নিজে এসেছিলো এবং শেষ বিদায় জানিয়েছিল – এতটা একেবারেই আশা করিনি।
কাশ্মীর এর রূপ আমি নিজ চোখে যতটা দেখেছি ততটা লিখাই প্রকাশ করতে পারিনি। আজ ও মনের মধ্যে গেঁথে আছে কাশ্মীরের সেই সৌন্দর্য।