কবিতা ব্যক্তি মানুষের সৃষ্টি কিন্তু যে সমাজ-সময়ে কবির অধিবাস, যাপিত জীবন, চারপাশের কলস্বর, স্বপ্ন ও কল্পনার বহুবর্ণিল ভাব-প্রভাবের রূপভাষ্য হয়ে ওঠে কবিতা। শব্দালঙ্কার, অর্থালঙ্কারের চকিত-চমক, এক অবিস্মরণীয় আবেগ-আকাক্সক্ষার পত্র-পল্লবে পুষ্পিত হয় কবিতা। এখানেই কবিতার আর্ট বা শিল্পত্ব, অন্য অর্ট ফর্ম থেকে আলাদা, মন্ময় রূপে রূান্বিত। শিশুতোষ কবিতা রচিত হয় মূলত শিশু-কিশোরদের মনোরঞ্জনের জন্য। যোগেন্দ্রনাথ সরকার ১৮৯৯ সালে খুকুমনির ছড়া নামে প্রথম শিশুতোষ কবিতার সংকলন প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থেও ভূমিকায় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ছড়াকে সাহিত্যের অন্যতম একটা শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। রবীন্দ্রনাথ সংকলিত ছেলে ভুলোনো ছড়া, সুকুমার রায়ের ছড়া সংকলন করে শিশুতোষ-কবিতাকে সাহিত্য-শাখার একটা স্থায়ী ভিত্তি দান করেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-

‘সেই কৈলাস মুখুজ্যে শিশুকালে অতিদ্রুতবেগে মস্ত একটা ছড়ার মত বলিয়া আমার মনোরঞ্জন করিত। ছড়া শুনিতে শুনিতে তাহার চিত্রটিতে মন ভারি উৎসুক হইয়া উঠিত। বালকের মন যে মাতিয়া উঠিত এবং চোখের সামনে নানাবর্ণে বিচিত্র আশ্চর্য মুখ”ছবি দেখিতে পাইত, তাহার মূল কারণ ছিল সেই দ্রুত উ”চারিত অনর্গল শব্দ”ছটা এবং ছন্দের দোলা। শিশুকালের সাহিত্যরস ভোগের এই স্মৃতি এখনো মনে জাগিয়া আছে-‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান’ এই ছড়াটা যেন শৈশবের মেঘদূত।’

শিশু-কিশোর মনোজগত সম্পূর্ণ আলাদা, খোলা, নির্মল, নরম কাদা মাটির মতো। তাদের জন্য লেখা, সাহিত্য জগতও স্বতন্ত্র। শুধু আনন্দের জন্য নয়, শিশু সাহিত্যের মধ্যেমে জ্ঞান-বিজ্ঞান-ইতিহাস, নৈতিকতাবোধ ও বিশ্ব প্রকৃতিকে জানার জন্য আগ্রহী করে তোলার একটা উদ্দেশ্য থাকে। মদনমোহন তর্কালংকার ১৮৪৯ সালে শিশুশিক্ষা গ্রন্থমালা সংকলন করেন। তার বিখ্যাত পংক্তি ‘পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল’ কিম্বা নজরুলের ‘ ভোর হলো দোর খোলো খুকুমনি ওঠরে’ প্রভাত বর্ণনা চিরকালের শিশুকবিতার অংশ হয়ে আছে। ছোটদের চঞ্চল, কল্পনাপ্রবণ ও জিজ্ঞাসু মনকে উসকে দেয়া, হাসি, কৌতুক, রস-রহস্যের অন্তরালে ছোটরা পেয়ে যায় জাগতিক জ্ঞান, বুদ্ধি, যুক্তি ও চিন্তার নতুন উপাদান। শিশু-কিশোর এই সাহিত্য-ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন উত্তরকালে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, উপেন্দ্রকিশোর রায়, সুকুমার রায়, জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামাল. গোলাম মোস্তফা, বন্দে আলী মিয়া, আল মাহমুদ, শাসুর রাহমান, হুমায়ূন আজাদ, রফিকুল হক দাদাভাই, সুকুমার বড়ুয়া, আখতার হুসেন, লুৎফর রহমান রিটন, মাহমুদ উল্লাহ, অমিরুল ইলাম, আনজীর লিটন, আসলাম সানী, সুজন বড়ুয়া, ফারুখ নেওয়াজ, রহীম শাহ, রাশেদ রউফ প্রমুখ।

নব্বই দশকের শুরু থেকে সমাজ-পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে শুরু করে, মোবাল, কম্পিউটা, ইন্টারনেট, নানারকম ডিজিটাল কন্টেট হাতের মুঠোয় এসে যাওয়ার ফলে বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোরের মনস্তত্ত্ব মাঠ-ঘাট-নদী-পুকুর-দীঘি-গাছপালা কিম্বা রূপকথার দেও-দানব, রাক্ষস-খোক্কসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই দ্রুত বদলে যাওয়া একুশ শতকের ভাব-কল্পনা, মনস্তত্ত্ব, নতুন যুগের উপাদান, অনুষঙ্গের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কিশোর কবিতা লেখার জন্য চৌকস, বুদ্ধিদীপ্ত বিষয় ও সচকিত ভাষা আয়ত্ত থাকা একান্ত দরকার।

এই বিবেচনাগুলো সামনে রেখেই আমি তিনজন কবির কিশোর কবিতায় আলোচনায় প্রবেশ করতে চাই।

কবি আজিজ রাহমান, দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন, তার কবিতার বিষয় নির্বাচন, শব্দ ব্যবহার চমৎকার, পড়তে পড়তে মনের মধ্যে ভিন্ন এক কল্পনার জগত সৃষ্টি হয়। যেমন- আমার কাছে আসে যারা-

আমার কাছে আসে যদি রবীন্দ্রনাথ চুপি চুপি

নজরুলও তার সাথে আসে জে¦লে দিয়ে আলোর কুপি।

আলাওল ও লালন আসে হাজার কথার পালক নিয়ে

আসে জারি ভাটিয়ালি হাছন বাঊল মন জাগিয়ে।

..

সবার সাথে গর্বে মাতি সবই খুশির মন্ত্রদাতা

এমানতর যা যা আসে সবই আমার মাথার ছাতা।

এই কবিতার মধ্যে সংবেদশীল সব কিশোরের মনকে খুলে-মেলে ধরা হয়েছে। কামরুল-হাশেম-জযনুলের আঁকা ছবির দৃশ্য, রূপকথার পঙ্খিরাজ, শাপলা-দোয়েল পাখির প্রকৃতির স্নিগ্ধতা যেমন কিশোর মনকে মাতিয়ে তোলে, পথের পাঁচলি, অগ্নিবীনা, গীতাঞ্জলি, নকশী কাঁথার মাঠ, বঙ্গবন্ধু, লাল সবুজের পতাকা-এই বিচিত্র, বর্ণাঢ্য দৃশ্যকল্পে সাজানো হয়েছে কবিতার শরীর। এই যে দ্রুত উচ্চারিত শব্দ”ছটা, অন্তমিল অপুর্ব দোতনা সৃষ্টি করেছে, এটাই মুগ্ধতার নিদর্শন। এই কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষার চাইতে যে বাক্প্রতিমা নির্মাণ, তা খুবই অনন্য সাধারণ। যেমন-

‘বাংলা ভাষার সুতোয় বোনা একাত্তরের স্মৃতি বুকে

বীর শহিদেদের সাথে আসে বঙ্গবন্ধু কী উৎসুখে।’

কবির কাছে কারা আসে? এটাই হচ্ছে কবিতার বিষয় কিš‘ এখানে উৎপ্রেক্ষা অলংকার ‘সুতোয় বোনা’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু কী উৎসুখে’ ব্যবহার আমার কাছে দুর্দান্ত মনে হছে।

আজিজ রাহমানের বৃষ্টিরা খুব বলে কবিতায় সংলাপধর্মী কথন ভঙ্গি আলাদা এক জগত নির্মাণ করেছে। যেন একজন কিশোর বৃষ্টিবন্ধুর সাথে কথা বলছে। সেই কথা একান্ত তার নিজের মনের ভেতর লুকানো কথা। না, কোনো মনুষ্য সঙ্গি নয়, নিষ্প্রাণ প্রকৃতি- এভাবে প্রকৃতিকে আপন করে নেয়া, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার অপূর্ব ক্ষমতা, একমাত্র কিশোর মনেরই আছে। বয়স্ক মানুষের মনে থাকে জাগতিক চিন্তা কিন্তু কিশোর মন সরল, নির্মল বলেই বৃষ্টিও মানুষের মতো তার সাথে কথা বলে-

তোমার কথা বৃষ্টিরা খুব বলে

তুমি নাকি তাদের সাথে মিশো কদমতলে।

অসম পংক্তি কিন্তু অপূর্ব তার অন্তমিল। আবার কথনভঙ্গি সবলীল এক পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করেছে। কথা কিন্তু কথা নয়, মনের সুগন্ধিমাখা আলাপন-

বৃষ্টিরা যেই আসবে শোনো

উতলা হও তুমি

যেই না আসে বৃষ্টি তবে

অমনি তোমার বাড়ে দুষ্টমি।

এই ‘দুষ্টমি’টাই হচ্ছে চঞ্চল কিশোর মনের প্রতিচ্ছবি। এই ছবি আঁকার জন্য সাধনা করতে হয় আজিজ রাহমান সেই সাধনায় নিবেদিত একজন কবি। আরেকটি কতিায় তিনি লিখছেন-

তোমাকে একবার পেলে

আকাশে তুলে দেব ঠেলে।

তুমি কি ঘুড়ি হবে

বিমান নাকি তবে

নতুন কোনো যান

ছুটতে সুখটান

এটাও দ্রুত উচ্চাতি শব্দচ্ছটা, যেন মনের গহীনে বেজে ওঠা ধ্বনি। তার অন্য কবিতা ‘যে আমাকে’ এবং ‘থাকবে ঘুড়ি বনের সাথে’ কিশোর কল্পনার দৃশ্যকল্প নিয়ে রচিত। তার কবিতার শব্দ ব্যবহার, ছন্দ মিল চমৎকার কিন্তু বিষয় বৈচিত্রের অভাব রয়েছে। আশা করছি তিনি এবিষয়ে ভবিষ্যতে নজর দেবেন।

কিশোর কবিতার বিষয়-অনুষঙ্গের পরিবর্তন হয়েছে। কারণ আমাদের চারপাশের যাপিত জীবনে এমন সব যন্ত্র-জটিলতা, ডিজিটাল মেথড, আর্টিফিষিয়াল ইন্টেলিজেন্স এসে গেছে যে এখন আর আগের সেই সরল রৈখিক জীবন নেই। অমি না চাইলেও যন্ত্রই বাধ্য করছে যন্ত্রনির্ভর হতে। হাতের ভাঁজে ভেসে ওঠা চতুষ্কোণ, ন্যনো টেকনোলজি কবিতা ও কল্পনার ডিকশন বদলে দিচ্ছে। ইসমাইল জসীমের পাঁচটি কিশোর কবিতা আমাকে কবিতার নন্দন সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে প্রেরণা যুগিয়েছে।

অভিজ্ঞতা আর চিন্তার খোপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একটা প্রয়াস আছে ইসমাইল জসীমের কবিতায়। আকস্মিক চমকের একটা ধাক্কা দিয়ে ইসমাইল জসীম পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেয়। এমন কিছু অভিনব অভিপ্রায় আছে তার কবিতায়। যেমন-

সবুজের সাথে এ-মন মাতাতে আমরা হযেছি জড়ো

হাসি খুশি মন খুশির প্লাবন এক হয়ে ছোটো বড়ো।

করি ছোটাছুটি খায় লুটোপুটি, কোথাও পাই না বাধা

সবুজ ঘাসের বিছানায় শুয়ে মেখেছি শরীরে কাদা।

এই যে মধ্যমিল, অন্তমিলের অনুপ্রাস ‘সবুজের সাথে’ ‘এ-মন মাতাতে’ ‘হাসি খুশি মন’ ‘খুশির প্লাবন’ তৃতীয় পংক্তিতে ‘করি ছোটাছুটি’ ‘খায় লুটোপুটি’ এই ধ্বনি ব্যঞ্জনা কোথায় যেন সুরের দোতক হয়ে উঠেছে। যেটা হয়তো হৃদয়ের গভীরে সঙ্গীতের মতো টান মারে। ইসমাইল জসীমের কিশোর কবিতায় এটা ভিন্ন এক প্রাণশক্তি সঞ্চার করেছে। কবিতাটির শেষ স্তবক আরো প্রাণবন্ত-

কোলাহলময় নগর জীবন কৈশোর নিয়েছে লুটে

সবুজের কাছে দুই পায়ে নেচে মন যায় ছুটে ছুটে।

ছুটে যায় মন, মৃদু সমীরণ জুড়ায় আমার বুক

ইট-কাঠের শুষ্ক নগরীতে বন্দি, কিশোর-কচি মনের এই যে অভিব্যক্তি, ‘বুক জুড়ানোর’ আবেশ পেতে হতে হলে যেতে হবে গ্রামের সবুজ প্রান্তরে। পোড়া শহরে, দগ্ধ নগরে উদার আকাশ আর খোলা মাঠ নেই, যেখানে কোমল কিশোরের মন রঙিন ঘুড়ি হয়ে বাতাসে দোল খাবে।

‘জিনান মনির চাঁদ অভিযান’ কবিতায়ও আমরা দেখি, শহরে বাস করা কিশোর জিনানের হৃদয় আকুতি, শহরের দমবদ্ধ জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। জিনান তাই চাঁদে যেতে চায়-

রকেট হবে দূর আকাশের মেঘের পালক

মামার দেয়া রোবট হবে রকেট চালক

বিনোদনের সঙ্গী হবে নাচের পুতুল

সঙ্গে নেবে বোঝাই করা সখের দুদুল

দুদুল মানে বাবার দেয়া ঘোড়ার গাড়ি

যে গাড়িতে রোবট জিনান দেবে চন্দ্র পাড়ি।

এই যে চন্দ্র-অভিযানের সামগ্রী, বাহন ‘রোবট’ চাঁদে যাওয়ার কল্পনা, এটা শুধু শব্দগুচ্ছ নয়, এর মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক প্রেষণা আছে, বিজ্ঞান চেতনা আছে, যা এযুগের কিশোরদের উপযোগী। পরিবর্তমান যুগের সাথে তালমিলিয়ে কবিতার বিষয় ও অনুষঙ্গ নিয়ে আসা,কবিতার ডিকশনের সংহতি। বস্ত সভ্যতার আজকের চঞ্চল পৃথিবীতে অ্যাবসাট কিছু নেই, সবই ইশারাস্পন্দিত দৃশ্যবস্তু, কসমোলজিক্যাল। ওই ধারণা মাথায় রেখেই ইসমাই জসীম কবিতা লিখছেন।

‘কোথায় পাবো মাঠ’ কবিতায় ইসমাইল জসীম নগরের অধিবসী কিশোর মনের সীমাবদ্ধতা, ক্ষোভ, যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেছেন বিষাদিত কণ্ঠে-

খেলতে যাবে? উপায় তো নেই, কোথায় পাবে মাঠ

কোথায় দিঘির জল টলমল শান বাঁধানো ঘাট?

কোথায় নদীর খেয়া তরী কালো মাঝির ডাক,

আমরা এখন আলট্রামডার্ন ডিভাইস যুগে আছি

ডিভাইস নিয়ে চলাফেরা ডিভাইস নিয়ে বাঁচি।

খেলার মাঠের কী প্রয়োজন মোবাইল ফোনে সব

আমার ঘরে আমি একা চারদিকে উৎসব।

এই নগর-নিঃসঙ্গতা, ঘরবন্দি কিশোর মন, ‘ডিভাইস যুগ’ “আলট্রমডার্ন’ উৎসব আড়ম্বর চারিদিক, তার মধ্যে এক্যুরিয়ামের মাছের মতো, রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্পের ফটিকের হৃদয়ের ছটফট অবস্থা, আমরা কী কিশোর মনের এই বিষাদ-যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করি? নগরের কোনো কিশোরই মনো-দৈহিকভাবে সুস্থ নয়। কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধের কথা অমরা বলছি কিন্তু আমরা কী একবারও ভেবে দেখেছি, এই কিশোর গ্যাংয়ে উৎস কোথায় ? খাল-বিল, নদী-মাঠ সব দখল হয়ে গেছে। আমাদের চোখের সামনে, অধিকাংশ স্কুলে এখন মাঠ নেই। খোলা মাঠে দৌড়ে, ছুটাছুটি কওে দেহ-মনে বিকশিত হওয়ার সুযোগ যদি না থাকে, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা সেটা দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তো এইরকম মানসিক বিকারগ্রস্ত প্রজন্মই তৈরি হবে, হচ্ছেও তাই। কবির কাজ হচ্ছে চোখে আঙুল দিয়ে সেই অন্ধ সমাজকে তা দেখিয়ে দেয়া। ইসমাইল জসীম প্রতিবাদী কবি নন, তবে আত্মসমালোচনা, সমাজ-চেতনা, তার কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছে।

কনিজ ফাতিমা’র ‘আমার আকাশ অনেক বড়’ কবিতাটি মূলত দেশপ্রেমমূলক। জন্মভূমির রূপ-সৌন্দর্যের মুগ্ধ কবি প্রথম স্তবকে সেই রূপের বর্ণনা তুলে ধরেছেন। যদিও সেই বর্ণনার মধ্যে অভিনবত্ব তেমন নেই, খুবই প্রথাগত বিরণ-

ছয় ঋতুতে ছয় রকমের গয়না পরে আমি সাজি

আমার বুকে ঘুমিয়ে আছে সোনার ছেলে শহীদ,গাজী

আমার আছে সোনালী আঁশ, ঢেউ দোলানো ধানের শীষ

লাগলে কারো ভালোবাসা আঁচল থেকে তুলে নিস।

অন্তমিল ঠিক আছে, কিস্তু ছন্দের মাত্রা অসমান। স্বরবৃত্তের চাল অনুযায়ী ৪+৪+২=১০ বা ৬+৬+২=১৪ অথবা ৮+৮+২=১৮ পর্ব ভাগ হওয়ার কথা। মুক্তাক্ষর, বদ্ধাক্ষর যেহেতু স্বরবৃত্তে একমাত্রা হিসেবে গণনা করা হয়, সে হিসেবে মাত্রা কোথাও কোথাও ৩/৫ মাত্রার হয়ে গেছে। আবার শব্দ ব্যবহারেও বিচ্যুতি দৃষ্টি এড়ায় না। যেমন-‘ ‘লাগলে কারো ভালোবাসা আঁচল থেকে তুলে নিস’ এখানে “আঁচল থেকে” না হয়ে ‘আঁচল ‘ভরে’ তুলে নিস’ হলে ভালো হতো।

স্বদেশ প্রেমের কবিতা লেখার জন্য অরূপ সৌন্দর্যে অবগাহন দরকার, রূপের আত্ম-উপলব্ধ দিব্য দৃষ্টি অর্জন করতে হয়। আমি মনে করি কানিজ ফাতিমার তা আছে, কিš‘ তিনি অভিজ্ঞতাকে প্রজ্ঞায় ধারণ করার পরিশ্রমটা করছেন না। আথচ আমরা দেখি, তিনি খুব চমৎকারভাবেই লিখছেন-

‘হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ খ্রীস্টান সবাই আছে মহা সুখে

নানা ধর্মের নানান মানুষ মিলেমিশে আমার বুকে।’

অসাম্প্রদায়িক বালার সমাজের ব্যবহারিক জীবনে নানা ধর্মের মানুষ একসাথে মিলেমিশে আছে। মাঝে মাঝে যে সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনা ঘটে, তা মূলত স্বার্থান্বেষি রাজনৈতিক গোষ্ঠির কারসাজিতে ঘটে। কানিজ ফাতিমার ‘মা তোমাকে ডাকছি’ মাকে নিয়ে লেখা। ‘মা’ এমন একটি শব্দ অতি ক্ষুদ্র কিš‘ পৃথিবী সমান তার ওজন-আয়োতন। রবীন্দ্র-নজরুল থেকে আজ আবধি অজস্র কবি মাকে নিয়ে লিখেছেন অত্যন্ত আবেগঘন উপলব্ধি। কানিজ ফাতিমা লিখেছেন-

মা যদি হয় ফুলের মতো

মা তোমাকে ডাকছি

ফুলের আদর, ফুলের সোহাগ

নরোম গালে মাখছি।

মা যদি হয় মেঘেরর মতো

মা তোমাকে ডাকছি

পাহাড়ি ফুল হয়ে আমি

মেঘকে গায়ে মাখছি।

এই আবেগ, মায়ের প্রতি অকৃত্রিম ভবালোবাসা একান্তই ব্যক্তিক, মৌলিক। ফুলের সাথে মায়ের আদরের উপমা, মেঘের পরশের সাথে মায়ের আদরের উপমা, একটা স্নিগ্ধতার প্রশান্তি ছড়িয়ে দেয়। এই কবিতা কিশোর মনে মায়ের প্রতি গভীর অনরাগ সঞ্চারিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। আমার কাছে কানিজ ফাতিমার যে কিশোর কবিতাটি সবচেয়ে ভালো লেগেছে, সেটার কথা বলে আমি আলোচনা শেষ করবো।

যখন আমি মৌন হয়ে একলা ঘরে বসে থাকি

বদ্ধ ঘরের জানলা খুলে আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন আঁকি

আমার সাথে স্বপ্ন আঁকে মন খোলা এক দূরের পাখি

থরে থরে সাজিয়ে রাখা বইয়ের শুনি ডাকাডাকি

তখন আমায় সঙ্গ দিতে নজরুল আসে চুপি চুপি

সুকুমার আর রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আসে আরোর কুপি।

কিশোর কবিতার ধরণ এরকম হওয়াই প্রত্যাশিত। নাতিদীর্ঘ অথচ সহজ-সাবলীল ভাষা, স্ব”ছন্দ গতি এবং চমৎকার অন্তমিল। কানিজ ফাতিমার কাছে আগমীতে আরো উত্তম কবিতা আশা করি।

কিশোর কবিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্য যে কোনো জেলার থেকে চট্টগ্রামের লেখকরা এগিয়ে। এখানে চট্টগ্রাম একাডেমি গঠিত হওয়ার পর এখানকার প্রাণপুরুষ কবি রাশেদ রউফকে ঘিরে কিশোর কবিতা চর্চার একটা বেগবান ধারা তৈরি হয়েছে। এই ধারার প্রত্যহ নতুন নতুন প্রতিভা যুক্ত হচ্ছে কিশোর কবিতার পাঠ ও পরিচর্চা হচ্ছে, পরিপুষ্টি লাভ করছে কিশোর কবিতার এক সমৃদ্ধ ধারা।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।