কথা– আমাদের জীবনের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।বাংলা কথা শব্দের মূল উৎপত্তি সংস্কৃত থেকে।মনের ভাবের আদান প্রদানে আমরা কথা বলি।কথার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের পুরো জীবন। আধো আধো বোল দিয়ে কথার শুরু। একে বলে কথা ফোটা।তো মা ও বাবার কী আনন্দ যখন শিশুর মুখে কথা ফোটে। দেরি হলে কতো দুঃশ্চিন্তা আর অনিশ্চিত ভাবনা।সময়ে কথা শুরু না হলে কতো বিপত্তি।
কথার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায় একজন মানুষের আচার-আচরণ বা বংশমর্যাদা বা সুশিক্ষা। কথার মাধ্যমে প্রকাশ পায় একজন মানুষের সার্বিক বহিঃপ্রকাশ।
শৈশবের শিক্ষা শুরু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে। এখানে যদি শিক্ষকের কথায় থাকে কিছু অসংলগ্নতা,তাহলে অনেক শিশুর জীবনে নেমে আসতে পারে মানসিক ট্রমা তথা চরম বিপর্যয়। তাই শিক্ষকের কটুকথা বা কোন মুদ্রাদোষ কিন্তু গ্রহণীয় নয়। এইতো সেদিন এক সভায় একজন সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বক্তব্য রাখতে গিয়ে একটা কথা যেভাবে প্রতিটি বাক্যে ব্যবহার করলেন! তো ভাবছিলাম – তিনি কিভাবে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেন! এই মুদ্রাদোষ! যা কিন্তু অন্যদের জন্য হাস্যকর হয়ে ওঠে।
” কথা দিয়ে জয়, কথা দিয়ে ক্ষয়”।এক টুকরো জিহবা হতে পারে ক্ষুরধার তরবারির মতো। অর্থাৎ কটুবাক্যে কারো মনের মধ্যে এফোঁড়ওফোঁড়। ” কারো মনে দিওনা আঘাত, সে আঘাত লাগিবে কাবা ঘরে “- কবির কথা।কিন্তু কয়জনে বুঝি বা উপলব্ধি করতে পারি।
যে কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান সবার কাছে গ্রহণীয় হতে পারেন শুধু সুন্দর কথা বিনিময় মানে পরিশীলিতভাবে আচার-আচরণে। সবাই হয়ে যান তাঁর আপনজন। কিন্তু আমরা অনেকে বস হয়ে কতো যে কথার অপব্যবহার করে বিরাগভাজন হই, একইসাথে প্রতিষ্ঠানের ভারসাম্য নষ্ট করি। এর পেছনে থাকে অহংবোধ। কষ্ট হয় যখন দেখি অনেক তথাকথিত জ্ঞানী লোকের মাঝেও এই অহংবোধে বিনয়ের তথা কথার কি অপব্যবহার।
কথা দেওয়া বা কথা রক্ষা — এটি হচ্ছে কথার সম্মান মানে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা। তো! প্রেমের ক্ষেত্রে – ” কথা দিলাম “। এটি কয়জন পারেন রক্ষা করতে। আর না পারলে কেউ আজীবন কুমার বা কুমারী, কেউ সুখের সংসারে কেউ আত্মাহননে।
আবার ক্ষমতায় যাওয়ার আগে কতো কথার ফুলঝুরি। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে কেউ রাখি কেউ রাখি না। যাঁরা রাখেন তাঁরা হন বরণীয় ও স্মরণীয়। আর না রাখলে – কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় বলতে হয়-” কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি”।
গুরুজনের কথায়– কথা নাকি বাতাসে ওড়ে।অর্থাৎ এমন কোনো কানকথা কারো নামে সেটা একান ওকান হতে হতে সঠিক ব্যক্তির কাছে যেতে যেতে একেবারে ভিন্নরূপে।তাই বলা হয়- কারো কানকথায় বিশ্বাস করতে নেই। এতে কানভারী হয়, মানুষে মানুষে সম্পর্ক নষ্ট হয়। অনেকে মনের দুঃখে বলেন -” বোবার শত্রু নেই”।
মানে বাকসংযমও একটা বড়ো গুণ। নয়তো আপনার পরিচয় হতে পারে ” বাচাল “।
আবার দেখি টকশো তে কিছু বুদ্ধিজীবীর এতো গভীর কথাবার্তা। কিন্তু প্রয়োগে? অর্থাৎ বাইরে ভেতরে আপনার বা আপনাদের অমিলটা উপলব্ধি করা যায় কথার মাধ্যমে।
কথা তথা বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলি।এর মর্যাদা রক্ষার জন্য কতো আন্দোলন এবং রক্তপাত।অবশেষে আমাদের জয়। কিন্তু এর মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব ও আমাদের। মানে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা বা শেখা মানে দেশপ্রেম। কিন্তু কিছু মিডিয়ায় কিভাবে বাংলা ভাষার অমর্যাদা। ইংরেজি ও বাংলা বা আঞ্চলিক ভাষার মিশেলে এক জগাখিচুরি অবস্থা। এখানেও কিন্তু শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। শুধু কি মিডিয়ায় ব্যক্তি জীবনেও আমরা বাংলার সাথে ইংরেজি মিশিয়ে এমনভাবে কথা বলি যেন এটি এক আভিজাত্যের প্রকাশ। ভুল রে ভাই ভুল। এটি মাতৃভাষার অপমান।
অতএব আসুন আমরা কথার মর্যাদা রক্ষা করে সুন্দর আচরণে কথার সঠিক ব্যবহারে প্রাত্যহিক জীবন যেমন তেমনি মানুষে মানুষে সম্পর্কে খাঁটি দেশপ্রেমিক হয়ে উঠি।
লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ