“অন্তর মম বিকশিত করো অন্তর হে,
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো,
সুন্দর করো হে”।
সারাবিশ্ব বর্তমানে কোভিড ১৯ এর কবলে বিপর্যস্ত, বিপন্ন দেশের অর্থনীতি। আমাদের দেশের অবস্থাও খুবই করুণ। প্রতিদিন মরছে মানুষ। আয় রোজগার মানুষের নেই বললেই চলে। করোনার কারণে গরীবের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। মহা দুর্যোগকালীন এ সময়ে দ্বিতীয় বছরের ন্যায় আমাদের মাঝে হাজির হয়েছে কোরবানীর ঈদ।
আমাদের দেশ বাংলাদেশে। শিক্ষা সাংস্কৃতি ও ধর্মীয় মিলন বন্ধনের এক অপার সৌন্দর্য্যরে মেলবন্ধনের এদেশ। আদিকাল হতে এদেশে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান বিভিন্ন ধর্মের গোত্রের মানুষের বসবাস। প্রত্যেকে তাঁদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে উৎসব পালন করে থাকে। এদেশেই সম্ভব সদন্তে উচ্চারণ “ধর্ম যার যার উৎসব সবার”।
সময়ের ধারাবাহিকতায় আজ আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছে মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় উৎসব “ঈদুল আযহা” যেটি কোরবানী ঈদ হিসেবে সমধিক পরিচিত।
ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে সম্প্রীতি, ঈদ মানে ভ্রাতৃত্বের অটুট বন্ধন। ঈদের আগমনে মুছে যাক সকল পাপ, পঙ্কিলতা কালিমা, নিভিয়ে দিক সকল প্রকার হিংসা, বিদ্বেষ, কাম, লোভ, লালসা আর ক্ষোভের আগুন। শান্তি, সম্প্রীতি ভ্রাতৃত্বের সাম্যের গান গেয়ে ঈদকে সামনে রেখে নিজেকে বিলিয়ে দেবার চেষ্টায় ঈদের আনন্দ। করোনাকালীন সময়ে সমাজের অসহায় মানুষেরা যেন ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারে, সেজন্য দানের হাত প্রসারিত করাই হলো ঈদের নীতি, আদর্শ ও শিক্ষা।
সীমিত পরিসরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে যতটুকু সম্ভব একটুখানি ভাল খাবার, একটা নতুন কাপড় আর কিছু টাকা দান করে ঈদের আনন্দকে সমভাবে উদযাপনের মধ্যে দিয়েই ঈদের আনন্দের যথার্থতা খুজে পাওয়া যায়। ঈদকে সামনে রেখে যে প্রস্তুতি তা যুগে যুগে আমাদের সমাজব্যবস্থার এক অলিখিত নিয়মের বন্ধন।
আদিকাল হতে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় আমরা দেখেছি, কোরবানী ঈদের চাঁদ দেখার পর হতে শুরু হয় এর প্রস্তুতি। হলুদ, মরিচ, মসলা শুকিয়ে ভাঙ্গানোর ব্যবস্থা। চাউল শুকিয়ে ভাঙ্গিয়ে গুড়ি করা এবং কোরবানীর জন্য গরু, ছাগল ক্রয়ে উৎসব উৎসব ভাব। বন্ধু বান্ধব নিয়ে বাবা চাচাদের সাথে মিলে বাজারে গিয়ে গরু কিনে তা দল বেঁধে বাড়িতে নিয়ে আসার যে আনন্দ তা আমাকে এখনো উদ্বেলিত করে।
ঈদের দিন সকালে নামাজ সেরে গরু ছাগল জবেহ করে পাড়ার সকলে মিলে তা কেটেকুটে যারা কোরবানী দিতে পারেনি তাদের তালিকা করা, মাথায় করে বিতরণ করা এবং রান্না করা মাংস পাড়াপড়শি সকলে এক সাথে বসে চাউলের রুটি দিয়ে খাওয়া যে কি আনন্দ তা সত্যি ভাবনাতীত। এখানে গরীব ধনীর মাঝে কোন বিভেদ থাকেনা। সকলে মিলে এক সাথে একাকার। এটি যেমন সামাজিক মেল বন্ধনের যে সংস্কৃতি তাঁর একটি বাস্তব চিত্র তেমনি ধর্মীয় শিক্ষা এবং ত্যাগের প্রভাবও এখানে লক্ষ্যণীয়।
“ভোগ নয় ত্যাগ এবং অন্যের জন্য নিজের ধন, মান, অহংকারকে পদদলিত করে সাম্য ভালবাসা ও শান্তির যে বার্তা নিয়ে সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সেটির ও একটি বিরাট ইতিহাস রয়েছে যা হাজার বছর ধরে আমাদের সমাজে অন্ধকার হতে আলোতে পথ দেখিয়ে চলছে। এখানেই ধর্মীয় ব্যবস্থার সৌন্দর্য্য লক্ষ্যণীয়।
নিজের আমিত্ব, পশুত্ব, লোভ, লালসা ও অহংকারকে কোরবানী দেয়া অর্থাৎ জবেহ করে শান্তির মেলবন্ধন তৈরী করাই “কোরবানী ঈদের” শিক্ষা। ত্যাগের মহীমায় উদ্ভাসিত করে সমাজব্যবস্থার যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন তিনি হলেন সকল ধর্মের আদিপিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) যিনি বাইবেলে আব্রাহাম বা আরাম (মহাপিতা), হিন্দু ধর্মে ব্রহ্মা। তাঁকে যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন সর্বসম্মতভাবে তিনি হলেন আমাদের ধর্মীয় সমাজব্যবস্থা নির্মাণের আদিপিতা বা আদিপুরুষ। খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় ২০০০ সালে অথবা আজ হতে ৪০২১ বছর পূর্বে “আহওয়ায়” প্রদশের “সুস” নামক স্থানে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন। সে সময়কালের সমাজব্যবস্থার যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় তিনি মেহমানদারিতে খুবই প্রসিদ্ধ ছিলেন। যার কারণে তঁাঁকে “আবুদ-দায়ফীন” অর্থাৎ মেহমানদের পিতা বলে আহ্বান করে সম্মানীত করা হতো।
ইতিহাসবিদ্দের মতে, সে সময়ে পরাক্রমশালী এক বাদশাহের রাজত্ব ছিল। তিনি হলেন মহাপরাক্রমশালী বাদশাহ নমরুদ ইবনে কূশ মতান্তরে কিনাল ইবনে কূশ। ধর্মীয় গ্রন্থ এবং ইতিহাসবিদ্দের মতে, তাঁহার দুই স্ত্রী হযরত সারাহ (রাঃ) এবং হযরত বিবি হাজেরা (রাঃ)। বিবি সারাহ (রাঃ) গর্ভে হযরত ইছহাক (আঃ) এবং বিবি হাজেরার (রাঃ) গর্ভে হযরত ইসমাইল (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর পিতা আজর একজন কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। মূর্তি বানিয়ে বাজারে বিক্রি করাই ছিল তাঁর পেশা। ইতিহাসে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর পুত্রদের মধ্যে হযরত ইসমাইল এবং হযরত ইছহাক ছাড়াও আরো ১১ জন সন্তানের সন্ধান পাওয়া যায়।
হযরত ইব্রাহীম এবং তাঁর সন্তান হযরত ইসমাইল (আঃ) এর আত্মত্যাগ, ধৈর্য্য, একাগ্রচিত্ততা এবং সৃষ্টিকর্তার উপর অটল বিশ্বাসের যে ইতিহাস তৈরী হয়েছে সে শিক্ষা ব্যবস্থাকে অনুসরণই হলো আমাদের আজকে “ঈদুল আযহা” বা কোরবানীর ঈদ।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এবং হযরত ইসমাইল (আঃ) এর আত্মত্যাগ এবং মাতা হযরত হাজেরা (রাঃ) এর ধৈর্য্য পরবর্তীতে পৃথিবীর একটি সভ্যতা, একটি নগর ও একটি শহর উপহার পেয়েছে যা ইতিহাস প্রসিদ্ধ “মক্কা নগরী” এবং যা আরবী সভ্যতা হিসেবে সমধিক পরিচিত।
সে সময়কাল এবং হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এবং ইসমাঈল (আঃ) এর কোরবানীর শিক্ষাকে মানব সভ্যতার মাঝে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইসমাইল (আঃ) এর বংশ হতে আগত সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মানবতার পথ প্রদর্শক বিশ্বের জন্য আলোর দিশারী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর মাধ্যমে তা ধর্মীয় শিক্ষার সাথে ধর্মীয় কালচার বা সংস্কৃতির মাঝে স্থান করে নিয়েছে। আজকে বিশ্বের দু’শত কোটির অধিক মানুষ শ্রদ্ধার সাথে এ ব্যবস্থাকে পালন করে আসছে। এছাড়া হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এবং হযরত ইসমাইল (আঃ) ও হযরত হাজেরা (রাঃ) এর সে সময়কার ত্যাগ ধৈর্য্য ও কষ্টসহিষ্ণুতাকে স্মরণ করে ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হজ্বের আনুষ্ঠানিকতার মাঝে অনুসরণ করার যে নিয়ম প্রবর্তিত্ত হয়েছে নিয়মিত তাঁদেরকে সম্মানের সাথে স্মরণ করা হয়।
আদি ধর্মীয় দৃষ্টির বাইরেও বাংলার সমাজব্যবস্থায় আদিকাল হতে কোরবানী ঈদের যে সৌন্দর্য্য তা ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে সর্বজনীনতার শিক্ষা হিসেবে আমাদের সমাজব্যবস্থার অংশ হয়ে রয়েছে। আজকে আমাদের সমাজে যে মৌলবাদের তান্ডব, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প এবং জঙ্গীবাদের হিংস্রতা সমাজব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। কোরবানীর শিক্ষার মাঝে এত্থেকে পরিত্রানের পথ নিহিত রয়েছে।
করোনাকালীন সারাবিশ্ব এ কঠিন সময়ে চারিদিকে মৃত্যুর মিছিল। এখন ধর্মীয় শিক্ষা বাস্তবায়ন, মানবতার উন্নত আদর্শ প্রদর্শনের সময়। সকল হিংসা, দোষ, লোভ, লালসাকে পরিত্যাগ করে মানুষ মানুষের জন্য এ শিক্ষার বাস্তবায়নে সমাজের স্ব্চ্চল লোকদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন করোনাকালীন এ সময়ে। আমরা যদি কোরবনীর প্রকৃত শিক্ষাকে অনুধাবন করে এ শিক্ষাব্যবস্থাকে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুকরণ ও অনুসরণের শিক্ষা দিতে পারি তবেই আমাদের ভিতরে জমে থাকা পশুত্ব, লোভ, অহংকার, আত্মম্ভরিতা, মিথ্যা এবং সাম্প্রদায়িকতা হতে অবশ্যই মুক্ত হতে পারব। ভালবাসা, শান্তি, নিরাপত্তা, পরম সহিষ্ণুতার শিক্ষাই আমাদেরকে শান্তির পথ দেখাবে। সকলের প্রতি ভালবাসা, কারো প্রতি ঘৃণা নয়। এ হোক আজকে ঈদে আমাদের অঙ্গীকার।
ইসলামের সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়েই আমার একটি সুন্দর সহাবস্থানের সমাজব্যবস্থা প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে পারব। আবারো বলব, “ধর্ম যার যার উৎসব সবার” এ শ্লোগানই হোক আমাদের আজকের কোরবানী ঈদের শিক্ষা।