চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য এবং চট্টগ্রামের সাংস্কৃতি ও স্মরণীয় বরণীয় মণিষীদের জীবন বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামের। এক বিবাহের আলোচনায় চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং বিয়েশাদী বিষয়ক পুরোনো ঐতিহ্যের বিষয়ে হালকা রসালাপের সূত্র ধরে আমার এক শ্রদ্ধেয় গুণীজন বললেন, “চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐহিহ্য সংস্কৃতি নিয়ে যখন এতই গর্ববোধ করছ, তখন এবিষয়ে লিখেই ফেল, যাতে প্রজন্মের সন্তানরা চট্টগ্রামের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের বিষয়ে জানতে পারে”। তাঁর কথার যথার্থতা অনুভব করে চট্টগ্রাম সংস্কৃতির হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যের একটি অংশ চট্টগ্রামের বিয়ে-শাদী বিষয়ে লেখার চেষ্টা করছি।
আমার শৈশবকালের বৃহৎ অংশ গ্রামে অতিবাহিত করেছি, পারিবারিক কারণে সময়ের বাধ্যবাধকতায় লেখাপড়ার জন্য আমি শহরের অধিবাসী। কিন্তু গ্রামের প্রতি গ্রাম্য পরিবেশ এবং সাংস্কৃতির প্রতি দূরন্ত কৈশরের সে সময়ের প্রতি চিরন্তন ভালবাসা আমার সবসময়। তাই সময় সুযোগ পেলেই গ্রামের নির্ঝঞ্জাট ও নির্মল পরিবেশে কিছুটা সময় অতিবাহিত করি। যাতে গ্রামের পরিবেশ ও সাংস্কৃতির সাথে পরিচিতি হতে পারি। শুরুতেই চট্টগ্রামের ভৌগোলিক পরিবেশের কিছু সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে তুলে ধরছি।
পাহাড় পর্বত পরিবেষ্টিত ও নীল সাগরের ঢেউবাহিত পানি ও মাটির সমন্বয়ে গঠিত চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের ভৌগলিক অবস্থান ও প্রকৃতি যেমন বৈচিত্রপূর্ণ তেমনি বৈচিত্রময় এদেশের সাংস্কৃতি ও লৌকিক আচার অনুষ্ঠান। যা বাংলার অন্য কোন জেলার সাথে মিলেনা। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রায় প্রত্যান্ত অঞ্চলে ভ্রমন করার সুযোগ আমার হয়েছে। সকল প্রকার লোকজনের সাথে খুব কাছ হতে মেলামেশা ও কাজ করার সুযোগ আমি পেয়েছি। কিন্তু অন্যান্য জেলার সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকে কোন ভাবেই মেলানো সম্ভব হয়নি।
অনেক অনেক কাল ব্যাপী বিভিন্ন নৃতাত্বিক ও ঐতিহাসিক কারণে এবং চট্টগ্রাম বন্দরের কারণে ব্যবসা বাণিজ্যর সুবিধা থাকার নানা বর্ণের ধর্মের ও গোষ্ঠীর মানব স্রোতধারা চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করেছে। স্বাভাবিকভাবে এতে এখানকার জনগোষ্ঠির মাঝে সংকর জাতের উদ্ভব হয়। ফলশ্রুতিতে চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর সামাজিক কাঠামো ও স্তর বিভাগে সৃষ্টি হয় নানারুপ জটিলতা। ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠী পূর্বপূরুষদের সভ্যতা-সংস্কৃতি, সামাজিক আচার- অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি, পোষাক-আশাক, ভাষা ও ভোজ্য দ্রব্যাদির ভালমন্দ অনেক কিছু উত্তারিধকার সূত্রে পাওয়া। ফলে চট্টগ্রামের লোক সমাজেও লৌকিক আচার-অনুষ্ঠানে দেখা যায় বৈচিত্রের সমাবেশ। গবেষকদের মতে চট্টগ্রামের আদিম জনগোষ্ঠীর সাথে আর্য্য রক্ত সংমিশ্রিত হয়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর পূর্ব পুরুষদের আচার-অনুষ্ঠান সমূহ পিতৃ-মাতৃরক্তের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। সেই আদিকাল হতে চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে সংস্কৃতি আচার অনুষ্ঠানের গোড়া পত্তন হয়।
খ্রীষ্টিয় অষ্টম-নবম শতকে আরবের বণিক শ্রেণী ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে চট্টগ্রামে আসেন। সে কারণে চট্টগ্রামের অনেক লোকালয়ের নাম আরবীতে এবং চট্টগ্রামের লোকদের আচার ব্যবহার ও স্বভাবের মধ্যে আরবীয় সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ্যনীয়। ১৩০০ খ্রীষ্টাব্দে ফখুরদ্দিন মুবারক শাহর চট্টগ্রাম বিজয়ের পর হতে ভাগ্যান্বেষী মুসলমানরা গোড়ীয় এবং পশ্চিম মধ্য এশিয়ার দেশ হতে চট্টগ্রাম এসে বসতি স্থাপন করে। তাদের চারিত্রিক সৌন্দর্য্য ও সাংস্কৃতির প্রভাবে চট্টগ্রামের হিন্দু ও বৌদ্ধ অধিবাসীদের বৃহৎ অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং অনেকে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়। এ সম্পর্কের মিল বন্ধনের কারণে সকলে সম্প্রদায়ের সংমিশ্রনের ফলে চট্টগ্রামে মুসলমান অধিবাসীর উদ্ভব হয় এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। সম্পর্কের এ মেলবন্ধনের কারণে সহজভাবে বলা যায় চট্টগ্রামের মানুষের চারিত্রিক ঐতিহ্যের মধ্যে সর্বধর্মের সম্প্রীতি লক্ষ্যনীয়। স্বাভাবিক কারণে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিে সে কারণে আরবীয় এবং গৌড়ীয় সাংস্কৃতি অনুপ্রবেশ করে এবং তা প্রাধান্য লাভ করে।
ষোলশতক হতে পর্তুগীজ ও ইংরেজ বনিকেরা চট্টগ্রাম আগমন করে এবং আঠার শতকের শেষের দিকে ইংরেজরা ক্ষমতার মসনদের অধিকারী হয়, ইউরোপীয় সাংস্কৃতি চট্টগ্রামের লোকসংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশ করে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এর ভাষায় বলেছেন, “হেথায় আর্য, হেথায় অনার্য, হেথায় দ্রাবিড়, চীন, শাক, হুন দল, পাঠান মোগল এক দেহেলীয় হয়ে চট্টগ্রামের মিশ্র সাংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছে। তার অনুসারীরাই হল চট্টগ্রামের হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলমান অধিবাসী, শুধুমাত্র ধর্মীয় মতাদর্শ তাদের পরস্পরকে পৃথক করে রেখেছে। অন্যথা সকল দিক দিয়ে তারা একই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক”।
চট্টগ্রামের হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলমান অধিবাসীরা সে সময়কালে কেতাবী শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর হলেও সত্য ও ভূয়োদর্শী জ্ঞানে তারা বলীয়ান ছিল বলে জানা যায়। যুগ যুগান্তর ধরে তাদের ব্যবহারিক জীবনের অভিজ্ঞতা লদ্ধ জ্ঞান উত্তরসুরীদের নিকট পুরুষ পরস্পরায় প্রসারিত ও প্রচলিত হয়ে আসছে। চট্টগ্রামের লৌকিক আচার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্র হল, উত্তরে ফেনী নদীর দক্ষিণ তীর হতে দক্ষিণে নাফনদীর উত্তর তীর অবধি ও বিচ্ছিন্ন দ্বীপাঞ্চল সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, মহেশখালী পর্যন্ত ব্যাপ্ত। তবে অঞ্চলভেদে আচার অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিতে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও মূল সুর কিন্তু এক ও অভিন্ন।
চট্টগ্রামের লোক সংস্কৃতি আচার অনুষ্ঠান সমূহ অঞ্চলভেদে চারিভাগে বিভক্ত।
১। দক্ষিণ চট্টগ্রাম।
২। মধ্য চট্টগ্রাম।
৩। উত্তর-পশ্চিম চট্টগ্রাম।
৪। উত্তর-পূর্ব চট্টগ্রাম।
ক) প্রাচীন কাল হতে ১৭৫৬ সাল অবধি দক্ষিণ চট্টগ্রাম আরাকান রাজ্যের অধীনে ছিল। এখানকার সংখ্যাগরিষ্ট অধিবাসীই হল রোয়াইঙ্গা বা রোহিংগা গোত্র ভূক্ত। স্বাভাবিকভাবে এখানকার লৌকিক আচার-অনুষ্ঠানে আরকানী সংস্কৃতির প্রভাব বেশীভাবে লক্ষ্যনীয়।
খ) কর্ণফুলী ও শঙ্ক নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল মধ্য চট্টগ্রাম আরাকানী সামন্ত হিন্দু রাজা জয়ন্দ্রের ১৪৮২-১৫২৩ চক্রশালা রাজ্যে প্রাচীনকাল হতে জ্ঞানী ও সম্পদশালী হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। ফলে এখানকার অধিবাসীদের লৌকিক আচার অনুষ্ঠানে হিন্দু প্রভাব বিদ্যমান।
গ) ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম মোগল সাম্রাজ্যের অধীন হওয়ার পর হতে উত্তর-পশ্চিম চট্টগ্রামের মীরশ্বরাই থানা সম্পূর্ণ ও সীতাকুন্ড থানার উত্তরে দাঁদরা পরগানা তথা ফেনী জেলার বিপুল সংখ্যক মুসলমানও কিছু সংখ্যক হিন্দু অধিবাসী বসতি স্থাপন করে। সেখানকার মুসলমানরা ‘দারাইল্যা’ নামে পরিচিত। এরাই এখানকার সংখ্যাগরিষ্ট অধিবাসী। ফলে উত্তর পশ্চিম চট্টগ্রাম ও তৎসন্নিহিত সন্দ্বীপের লৌকিক আচার অনুষ্ঠান ফেনী জেলার লৌকিক আচার অনুষ্ঠানের প্রভাববেশী।
ঘ) গৌড়ের সুলতান রুকুনদ্দিন বারবক ১৪৫৫-১৪৭৬ খ্রীষ্টাব্দে ও তৎপুত্র সামশুদ্দিন ইউসুফ শাহ (১৪৭৪-১৪৮০) খ্রীষ্টাব্দের রাজত্বকালে অধিকৃত চট্টগ্রামের রাজধানী বা শাসনকেন্দ্র ছিল বর্তমানের হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ২ নং সড়ক ও চট্টগ্রাম রামগড় সড়কের পূর্বদিকস্থ মজলিশ-ই-আলা রাস্তিখার দীঘি ও মসজিদের সন্নিকটবর্তী এলাকা। গৌড়ের সুলতান নুসরাত শাহ ১৫১৯-১৫৩২ অধিকৃত চট্টগ্রামের রাজধানী বা শাসনকেন্দ্র ছিল হাটহাজারী থানার ফতেয়াবাদে।
বন্দর হওয়ার সুবাদে আরব বনিকদের আগমন ঘটে চট্টগ্রামে। আর বণিকদের চট্টগ্রামে আগমনের ফলে মধ্যযুগে চট্টগ্রামের মুসলমান সাংস্কৃতির চরম বিকাশ ঘটে। চট্টগ্রামের মুসলমানদের লৌকিক আচার অনুষ্ঠানে এর প্রভাব লক্ষ্যনীয়। চট্টগ্রামের এসব লৌকিক আচার অনুষ্ঠান সমূহের বিবরণ বিভিন্নভাবে বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিশাল ভান্ডার রয়েছে। এ বিশাল ভান্ডার হতে আমি শুধু মাত্র চট্টগ্রামের বিয়ে-শাদীর যে সংস্কৃতি সে বিষয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করছি। আগে ও পরে প্রচলিত লৌকিক আচার অনুষ্ঠানের সংক্ষিপ্তভাবে এখানে তুলে ধরছি।
চট্টগ্রামের বিয়ে-শাদী বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত তাই আমি ক্রমানুযায়ী বিভিন্ন পর্যায়ের অনুষ্ঠানাদির বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করছি। এতে চট্টগ্রামের অনেক প্রচলিত কিস্তু প্রজন্মের কাছে অজানা এমন অনেক কিছু শব্দের ব্যবহার হয়েছে যা চট্টগ্রামের ইতিহাসের স্বার্থে সংরক্ষণ প্রয়োজন।
১। শুভকাজের মাঙ্গলিক প্রতীক “মঙ্গল ঘট্”
প্রাচীনকাল হতে চট্টগ্রামের বিয়ে শাদী ও শুভকাজের মাঙ্গলিক প্রতীক হিসেবে মঙ্গলঘট চট্টগ্রামের সকল ধর্মের অধিবাসীরা পালন করে আসছে। বাড়ীর প্রবেশ পথের দু’পাশে কলা গাছ পুতে তার গোড়ায় দুটি জলপূর্ণ কলসী মুখে আমের পাতা রেখে তার উপর দুটি ডাব বা নারিকেল দিয়েই মঙ্গল ঘট বসানো হয়। এসব কাজে ব্যবহৃত উপাদান গুলিকে সাধারণত মঙ্গল বা শুভ প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন কলাগাছ ও আমের পাতা দীর্ঘায়ুর প্রতীক, জল জীবনের প্রতীক এবং ডাব বা নারিকেলে প্রজয়ন শক্তির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত। বর্তমানে আধুনিক সভ্যতার আড়ালে এবং সংস্কারের মাঝে এসব বিলুপ্ত হয়ে গেলেও পরিপূর্ণভাবে তা বিলুপ্ত হয়নি। এখনও চট্টগ্রামের অধিকাংশ মুসলমানের বিয়ে শাদীতে বিয়ের দিন বিয়ে বাড়ীর আঙ্গিনায় একটি পানিপূর্ণ কলসী বা কলসীর মুখে আম সরতী দিয়ে মঙ্গলঘট বসানো হয়। আম সরতী বলতে কলসীর মুখে আম পাতাকে বলা হয়ে থাকে।
২। বরণকুলা বা ডালা
চট্টগ্রামে সুপ্রাচীনকাল হতে সকল ধর্মীয় অনুসারীদের মধ্যে বিয়ে শাদী ও শুভ কাজে মাঙ্গলিক প্রতীক হিসেবে বরণকুলা বা ডালার বহুল প্রচলন রয়েছে। বরণকুলা বা ডালার নতুন বর-বঁধুর সামনে স্থাপন করে বর-বঁধুকে বরণ করা হয়। নতুন কুটুম্ব, সম্মানীয় অতিথিকে সম্মান জানানো, নতুন গৃহে প্রবেশ, বিদেশযাত্রা কালে এবং ব্যবসায়ী বা সওদাগরেরা নববর্ষের হালখাতার সময়েও বরণকুলা ব্যবহার করে থাকে। মধ্যযুগে চট্টগ্রামের মুসলমানেরা বরণকুলায় ধান, হলুদ, দুর্বাঘাস, সরিষা তেলে প্রজ্জ্বলিত মাটির সেজদীপ, পানিপূর্ণ মাটির ঘটির মুখে আম সরতি এই ছয় পদ ছাড়াও ধুপ, পিঠা, কলা, শিলা, এই চার পদ উপাদান অতিরিক্ত ছিল। এত্থেকে মনে হয় প্রাচীনকালে চট্টগ্রামের মুসলমানেরা বরণকুলার যে উপাদান ব্যবহার করত তা বর্তমান সময়ে হিন্দু, বৌদ্ধদের বরণকুলার উপাদানের সাথে সামাঞ্জস্য রয়েছে।
প্রাচীনকালের মুসলমান বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে এর কিছু প্রচলিত ও কতিপয় শব্দের সাথে পাঠকদের পরিচয় না থাকাটা স্বাভাবিক। তবুও ইতিহাসের কারণে তা তুলে ধরতে হলো। আমি চেষ্টা করেছি যাতে সহজভাবে বুঝানো জন্য।
মাহাত শব্দের অর্থ হচ্ছে মহল্লা, চট্টগ্রামের কয়েকটি পাড়ার মুসলমান আধিবাসীরা জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে-শাদী, খানা-মেজবানী ও বিপদে আপদে পরস্পরকে সাহায্য করেও একজোট হয়ে বসবাস করত। আঞ্চলিক ভাষায়, তাকে মাহালত বলা হয়। মাহালতের অধিবাসীগণকে মাহালত বা মাহালতী বলা হয় যার অর্থ হচ্ছে সমাজ সদস্য। মাহালতের একজন সর্দার নির্বাচিত হন। যিনি সর্বদিক দিয়ে জ্ঞানে গুনে বংশ মর্যাদায় কুলীন বংশের হয়ে থাকেন।
বিয়ে-শাদী উপলক্ষে বর-কনে উভয় পক্ষের মধ্যে বিয়ের কথাবার্তা শুরু হতে শেষ হওয়া পর্যন্ত যাবতীয় কাজ উকিল বা ঘটক কর্তৃক সম্পন্ন হয়ে থাকে। যাকে চট্টগ্রামী ভাষায় ‘ঘটক’ বলা হয়। চট্টগ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে যা একটি পূন্য কাজ হিসেবে পরিচিত। বিয়ের কথাবার্তার পূর্বে দুই কুলীন পরিবারের মধ্যে বিবাহের সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বে কৌলীন্যের প্রমাণ দেখানোর জন্য নিজ নিজ বংশের সজরা, লাখেরাজ বা তরফের সনদ প্রদর্শন করতে হতো।
এরপর আসে দুলাহ দেখা, দুলাহ পছন্দ হলে দুলাহর বাড়ী ঘর দেখাটা প্রচলিত নিয়ম। উচু ভিটা, পূর্ব মুখী বাড়ীঘর, বাড়ীর সামনে পিছনে পুকুর না থাকলে কুলীনেরা তাদের মেয়ে দিতে সাধারণত রাজী হতেননা। দুলাহর বাড়ীঘর দেখার ফাকে দুলাহ গোপনে কনে দেখে নিত। পরে কনের পক্ষ দুলাহর বাড়ী ঘর দেখার পর মেয়ে দিতে সম্মত হলে আনুষ্ঠানিকভাবে পাত্র পক্ষ নিজস্ব বাঁদী পাঠিয়ে কনেকে দেখে যেত। কনের মাথায় চুল হতে পায়ের নক পর্যন্ত একে একে নিখুতভাবে পরীক্ষা করে দেখা হতো তখন। উভয় পক্ষ বর কনে ও বাড়ী ঘর দেখা শোনার পর পছন্দ হলে বিয়েতে সম্মতি জানিয়ে দেয়া হয়। তখন উভয় পক্ষ সামনাসামনি বসে বিয়ে সম্পর্কিত পরবর্তী কথাবার্তা চুড়ান্ত করার জন্য বৈঠক বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যাকে চট্টগ্রামের ভাষায়, “ঘরনা” কথা বলা হয়।
পরবর্তীতে কনের বাপের বাড়ীতে উভয় পক্ষের আত্মীয় স্বজন ও মাহলতের লোকজন সহ এক আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বিয়ের কথাবার্তা পাকা করে। একে ফুল নিশান বা বউ জোড়া বলা হয়ে থাকে। সেদিন বরপক্ষ কিছু লোকজন নিয়ে কনের বাড়ীতে আসেন, সেখানে কনে পক্ষের মাহালতের সর্দার সহ তাদের আত্মীয় স্বজন উপস্থিত থাকেন। সে মজলিসে কনে পক্ষের মাহালতের সর্দার বরপক্ষকে জিজ্ঞাসা করেন আপনারা কেন কি উদ্দেশ্যে নিয়ে এখানে এসেছেন। তখন বর পক্ষের প্রতিনিধি বিয়ের উকিল বলেন অমুক থানার, অমুক গ্রাম নিবাসী অমুকের ছেলে, অমুকের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। তখন সর্দার একথাগুলো সঠিক কিনা কনের পক্ষকে জিজ্ঞাসা করেন। কনের পক্ষের সম্মতি নিয়ে তাদের মাঝে কোন প্রকার কথাবার্তা হয়েছে কিনা বর পক্ষের উকিলকে জিজ্ঞাসা করেন। উকিল প্রথামত প্রথমে অস্বীকার করলেও পরের বার জবাব দেন, আপনাদের অনুমোদন সাপেক্ষে এবিয়ে হতে পারে। সর্দারের সম্মতি পাওয়া গেলে বর পক্ষের উকিল কাবিন, জেওর সহ যাবতীয় জিনিষের একটি ফর্দ বা তালিকা লিখে কনে পক্ষের হাতে প্রদান করেন। যাতে স্বর্ণের হিসাব, কাবিনের হিসাব, বাতাসা, পান, চুন-সুপারী, নানী, দাদী ও ভাবীর মাইনের ও সাজানোর শাড়ী এবং টুপি প্রভৃতি হিসাব লেখা থাকে। সর্দার সব কিছু দেখে তাদের প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করেন। তখন বরের পিতা একখানি রেকাবি চেয়ে তাতে রুমাল বাঁধা একটি ফুল নিশান স্বরুপ কনের পিতার হাতে দেন। তখন সর্দার বরের পিতাকে জিজ্ঞাসা করে, আপনি কি দিচ্ছেন? বরের পিতা উত্তর দিতেন, অমুকের মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ের ফুল নিশান দিচ্ছি। তারপর কনের পিতাকে জিজ্ঞাসা করা হলে, তখন তাকে উত্তরে বলতে হয়, অমুকের ছেলের সাথে আমার মেয়ের ফুল নিশান নিলাম। অতপর দুই বেয়াই কোলাকুলি করে সালাম বিনিময় করেন। চট্টগ্রামী ভাষায় এ নিশানকে “বউ জোড়া” বলা হয়ে থাকে। সময়ের ব্যবধানে সকল নিয়ম কানুন ঠিক থাকলেও বর্তমানে ফুল দেয়ার পরিবর্তে একপদ স্বর্ণালঙ্কার বা পোশাক পরিচ্ছদ দেয়ার নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। ফুল নিশান বা বউ জোড়ার ২/৩ দিন পর দুলাহর পিতা, চাচা, মামা একবিরা পান, সুপারী, সাদাপাতা, এক হারি বাতাসা এবং ২/৩ সের দুধ নিয়ে কনের পিতার বাড়ীতে দুধ, পান নিয়ে ফুল মাতানি আসেন। এখন এ অনুষ্ঠান ভিন্নআঙ্গিকে আধুনিকতার ছোঁয়া পেলেও এখনও এ নিয়মের প্রচলন দেখা যায়।
নিশান বা জোড়া দেয়া বউকে যদি সহসা বিয়ে পড়ানো না হয়, তবে এর জন্য রয়েছে ভিন্ন রকম আয়োজন। তখনকার দিনে বউ নিশান দেয়ার পর প্রায় বছর দেড় বছর বাপের বাড়িতে রেখে দেয়ার নিয়ম ছিল। তখন নিশান দেয়া বউয়ের বাপের বাড়িতে বড় পক্ষের নিকট হতে বছরের সমস্ত পালা পরব ও মৌসুমের সমস্ত পিঠা, পুলি ও ফল পাকুরাদি একজন লোকের মাধ্যমে বোঝাই করে পাঠাতে হতো। বকরী ঈদে বঁধুর জন্য কোরবানীর গরু বা ছাগল যাবতীয় মশালাপাতি, তেল, ঘি, পিঠার জন্য চাউল, ময়দা, কাপড় চোপড়, তেল সাবান ইত্যাদি সহ পাঠানোর নিয়ম। রমজানে পাঠানো হতো ইফতারী, ঈদুল ফিতরে পাঠাতে হয় সেমাই, চিনি, ঘি, নারিকেল সহ বঁধুর জন্য কাপড়, তেল, সাবান ইত্যাদি। প্রত্যেক পরবের নিয়মানুযায়ী যাবতীয় খাওয়া দাওয়া পাঠাতে হতো সর্বদা। প্রত্যেক মৌসুমে মৌসুমী ফলতো আছেই। চট্টগ্রামের ভাষায় একে “জুইয্যা বউকে কুইয্যা খাওয়ানো” বলে প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে।
কনের পিতার বাড়ী গিয়ে বিয়ের দিন তারিখ সময় ও বৈরাতীর (বর যাত্রীর) সংখ্যা নির্ণয় করে আনাকে লগ্ন আনা বলা হয়ে থাকে। সে সময় বরপক্ষ ঘরে তৈরী পাক্কন নিয়ে কনের বাড়ীতে যান। এখন আধুনিকতার ছোঁয়ার সে স্থান দখল করেছে উষ্ণ মিষ্টান্ন। বিয়ের আগের দিন শেষ বেলা পাত্রপক্ষ পাত্রীর বাড়ীতে বরযাত্রীর রান্না প্রস্তুতকারীদের জন্য ও কনের মেহেদী দেয়া উপলক্ষে মেয়েদের জন্য পান, সুপারী খয়ের ও সাদাপাতা এবং একহাড়ি দুধ বা দই ও মাছ পাঠানোর নিয়ম প্রচলিত ছিল যাকে মাঙ্গলিক চিহ্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিত্তশালী পরিবারগুলো এবং শহরতলীর লোকেরা রাঁধুনী ও মেহেদী দেওয়া পানের সাথে ২/৪ সের ঘি পাঠিয়ে দিত যাকে “ঘিলোয়াই” দেয়া বলে। বিয়ের আগের দিন শেষ বেলা বর কনে উভয় বাড়ীতে মেহেদী পাতা তোলা হয়। বর কনের অবিবাহিত বোন, ভাবী, কনের বান্ধবীরা অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে। মেহেদী তোলায় বিধবারা অংশ গ্রহণ করতে পারেনা। বরণকুলায় একখানী লাল ডোরা দেয়া হয়, একজন কুমারী মেয়ে বরণকুলা মাথায় নেয় এবং অন্যরা তাকে অনুসরন করে পাতা তুলতে মেহেদী গাছের তলায় যায়। একজন পানের বাটা নিয়ে যায়। প্রথমে বরণকুলা হতে লাল ডোরাটি মেহেদী গাছে বেঁধে দিয়ে পাঁচজন মিলে কুলাটি ধরে রাখে অন্যরা পাতা তুলে নেয়। একজন পানের খিলি বানিয়ে সবাইকে দেয়, এইভাবে আমোদ প্রমোদের মধ্যে মেহেদী পাতা তোলা হয়। প্রত্যেক অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উচ্চারনে এক প্রকার গান পরিবেশন করা হয়। যাকে “হলা” বলে। এরপর রয়েছে পাঁচ কুলা ধানের বারা, তারপর পানশল্লা, চট্টগ্রামের যে কোন পরিবারের বিয়ে-শাদী ও খানা মেজবানী সকল কিছুতেই আগের দিন রাত্রে মাহালতের পুরুষদেরকে নিয়ে পরবর্তী দিনের করণীয় এবং অনুষ্ঠান সম্পর্কে শল্লা পরামর্শ করাই হচ্ছে পানশল্লা। সেকালে পানশল্লার প্রাসঙ্গিক বিষয় আলোচনার পর পুঁথি পাঠের আসর বসানো হতো। তখন পুঁথি পাঠ ছিল এক নির্দোষ ও অনাবিল আনন্দদায়ক অনুষ্ঠান।
মেহেদী অনুষ্ঠানে মেহেদী দেয়ার প্রাক্কালে দুলাহর বোন ভাইয়েরা সোহাগ কাটে। দুলাহর আপন বোন বরণকুলা নিয়ে ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তাতে থাকে রুমালের কোনায় বাঁধা আংটি। বোন বরণ কুলা নিয়ে ভাইয়ের মাথার চারিদিকে ঘুরিয়ে প্রথমে দুলাহকে বরণ করে পরে আংটি বাঁধা রুমালটি ভাইয়ের মাথায় এমন করে রাখে যাতে আংটি ভাইয়ের কপালের উপর ঝুলে থাকে। তারপর বোন বরণকুলার সেজদীপের ধোঁয়া হতে ডানহাতের বৃদ্ধা ও অনামিকা আঙ্গুলের সাহায্য কালি নিয়ে ভাই এর দু’চোখের ভ্রুতে কাজলের ন্যায় লাগিয়ে দেয়্। একেই “সোহাগকাটা” বলা হয়ে থাকে। সোহাগকাটা অনুষ্ঠানের পর পর মেহেদী অনুষ্ঠান শুরু হয়।
মেহেদী অনুষ্ঠানে কনে বা বরের আত্মীয় স্বজনরা সকলে একে একে এসে কপালে হলুদ লাগিয়ে আর্শিবাদ করে যায়। এরপর ভাবীরা সকলে মিলে মেহেদী দিয়ে থাকে। এ অনুষ্ঠানে সারারাত ধরে চলে গানের আসর। এখনও এসব অনুষ্ঠানের জন্য ঘুম নষ্ট হয় প্রতিনিয়ত যা একটি আধুনিকতার ছোঁয়ার পালিত হচ্ছে। চট্টগ্রামের বিয়ে শাদীতে তেলোয়াই নিয়ে নাইয়র যাওয়া গৃহস্থ ও নাইয়রী উভয় পক্ষের জন্য অতীব সম্মানীর বিষয় ছিল। এক ভার (দুটুকরী) পাক্কন, ২/৩ বিরা পান সুপারী ও এক বোতল সরষে তেল নিয়ে ঘনিষ্ট আত্মীয় স্বজনের ছেলে বা মেয়ের বিয়ের আগের দিন বিয়ে বাড়ীতে একজন গোলাম দ্বারা নাইয়রীর সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজ তাও প্রায় বিলুপ্ত। চট্টগ্রামের যে কোন অনুষ্ঠানে পাক্কন পিঠা এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। চাউলের গুড়ের সাথে গুড় মিশিয়ে হামি তৈরী করে তেলে ভেজে পাক্কন পিঠা তৈরী করা হয়। বিয়ের আগে বর কনের গাঁয়ে হলুদ দেয়া একটা সুপ্রাচীন প্রথা। মধ্যযুগে চট্টগ্রামের মুসলমান সমাজেও বিয়ে উপলক্ষে কনের গাঁয়ে হলুদ অনুষ্ঠান ছিল একপ্রকার সামাজিক প্রথা।
বর্তমান সময়ে আধুনিকতায় হলুদ অনুষ্ঠানের বিশাল রাজকীয় আয়োজনের বিষয়টা চট্টগ্রামে বসবাসরত সকলেরই চোখে দেখা তাই এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে লেখার কলেবর বাড়াতে চাইনা। বিয়ের দিন সকালে নাপিত আসে দুলাহকে কামাতে, সে সঙ্গে আনে বোতল ও একটি লাই (টুকরি)। পরিবারের যারা বরযাত্রী হবে প্রথমে তারা চুল কামাই করে। এরপর দুলাহ কামানোর ব্যবস্থা করা হয়। দুলাহ কামাতে বসার জন্য একখানি জলচৌকি রাখা হয়। দুলাহর ভগ্নীপতি তাকে সঙ্গে নিয়ে এসে জলচৌকিতে বসিয়ে দেয়। নাপিত দুলাহকে কামাতে বসলেই নাপিতের জন্য “সিধা” (বেগুন, ডাইল, তরকারী, শুটকি, তেল, পানের বিরা ও সুপারী) প্রভৃতি এনে টুকরিতে দেয়া হয়। দুলাহকে মাথা কামানোর পর পাঁচ পুকুরের পানি দিয়ে দুলাহকে গোসল করানো হয়। চট্টগ্রাম শহরের আদি বাসিন্দাদের মধ্যে এ সংস্কৃতি এখনো প্রচলিত রয়েছে। এরপর দুলাহকে সাজানো হয়। ভগ্নীপতি বা বন্ধুবান্ধবরা দুলাহকে বিয়ের পোষাক পড়াতে সাহায্য করে। পোষাক পরা হয়ে গেলে পাঁচজন লোক পরস্পর হাত ধরে মাথায় পাগড়ী পরিয়ে দেয়। দুলাহ সকলকে পান মিঠা খাওয়ানোর পর আত্মীয় স্বজন ও মাহালতের বাসিন্দারা দুলাহর সামনে রাখা পানের বাটায় ‘মাইন’ বা টাকা দেন। যেভাবে সেকালে রাজা বাদশাহর সামনে তাদের সম্মানার্থে নজরানা বা দর্শনী দেয়া হতো। এরপর দুলাহর মায়ের অনুমতি নিতে হয়। ছেলে মায়ের নাড়ি ছেড়া ধন, ছেলে আজ অন্য মেয়ের স্বামী হতে যাচ্ছে তাই নিয়ম মত তাকে মায়ের অনুমতি নিতে হবে। ভগ্নীপতিরা দুলাহকে কোলে করে মায়ের কাছে নিয়ে যায়। কান্নারত মা বরের সাজে সজ্জিত ছেলেকে কোলে নিয়ে চুমু করে এক গ্লাস দুধ খেতে দেয়। সেকালে চাচি, জ্যাঠাইমারা দুলাহকে জিজ্ঞাসা করে কোথায় যাচ্ছ? দুলাহ বলে মায়ের জন্য বাঁদী আনতে যাচ্ছি। কান্নাভরা কন্ঠে তখন মা ছেলেকে আদেশ দেয় আমার ঘরের লক্ষী আনতে যাও। এরপর মা ছেলের বাম হাতের কনে আঙ্গুল কামড়ে ছেলেকে খুতা করে দেয় যাতে তার উপর কারও কুদৃষ্টি না পরে। এখনও কিছু কিছু গ্রামাঞ্চলে এ নিয়মের প্রচলন দেখা যায়।
দুলাহ মায়ের নিকট হতে বিদায় নেয়ার পর ভগ্নীপতিদের কেউ তাকে কোলে নিয়ে তাঞ্জান বা চৌদুলে বসিয়ে দেয়। বর্তমান সময়ে গাড়ীতে বসিয়ে দেয়। গাড়িতে বা তাঞ্জান বা চৌদুলে দুলাহর কোলে একটি শিশুকে বসিয়ে দেয়া হয়। বরের কোলে নিস্পাপ শিশু সৃষ্টিশীলতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত। বরযাত্রী এবং দুলাহর সাথে ঢোল বাদ্য যেত। এখন শহর এলাকায় ব্যান্ড পার্টি যেতেও দেখা যায়। দুলাহ কনের বাড়ীতে যাওয়ার পথে দুলাহ সহ বরযাত্রীদেরকে কনের পিতার বাড়ীর বাইরে পুকুর পাড়ে বা খালি জায়গায় অপেক্ষা করতে হতো। বরপক্ষ উকিল মারফত কনে পক্ষের মাহালতের সর্দারের বাড়ীতে তার সালামী একহারি বাতাসা, একবিরা পান ও একগন্ডা সুপারি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কনে পক্ষের কেউ সর্দারের বাড়ীতে দুলাহর বা বৈরাতী আসার সংবাদ নিয়ে যেতো কোন কোন সময়।
সর্দার এসে “মাহালত্যাদের ডেকে দুলাহকে আগু বাড়িয়ে নিতে আদেশ দিতেন। তখন বর পক্ষের নিয়ে আসা পাল্কি নিয়ে কাহারেরা (পাল্কি বাহকেরা) কনের পিতার ভিতর বাড়ীতে যেতেন। কনের বোনেরা সেই পাল্কিতে চড়ে যেখানে দুলাহ ও বৈরাতীরা অপেক্ষা করছে সেখানে দুলাহকে আগু বাড়িয়ে আনতে যেত। সাথে মাহালাত্যাদের কয়েকজন কনে পক্ষের প্রতিনিধিরুপে তাদের সাথে যেতেন পান সরবত নিয়ে। সেখানে অপেক্ষারত দুলাহকে পান সরবত দিয়ে প্রথমে অর্ভ্যথনা জানানোই নিয়ম। এখনও কোথায় কোথায়ও এ অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে। সেখানে পান মিঠাই খাওয়ানোর পর দুলাহ কনের পক্ষের একজন বয়স্ক লোকের হাতে আগ বাড়িয়ে নেয়ার বকশিশ প্রদান করেন। এসব বকশিশের হিসাব নিকাশের সময় নির্দিষ্ট করে ফর্দে লেখা হয়ে থাকে।
দুলাহর আগ বাড়ানোর অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর তাঞ্জান বা চৌদুল সহ বরযাত্রীরা বিয়ের আসরের দিকে রওয়ানা হয়। তখন কনের পিতার বাড়ীর ঘাটায় মাহালত্যাদের কয়েকজন, বর ও বৈরাতীদের গমনে বাঁধা সৃষ্টি করে। কোথাও কোথাও শালা শালিরা বাঁধা সৃষ্টি করে। তখন বর পক্ষ এক হাড়ি বাতাসার উৎকোচ দিয়ে এ বাঁধা অপসারণ করার চেষ্টা করেন। এখন অবশ্য টাকা দিয়ে এ বাঁধা অপসারণ করা হয়। তখনকার সময় এ উৎকোচ যদি আদায় করা না হতো তবে বর পক্ষকে বিয়ের আসরে বাঁধা দেয়া হতো। সামান্য ব্যতিক্রমের জন্য অনেক সময় কনে পক্ষের জেদের ফলে সেখানে বরযাত্রীসহ দুলাহকে ৬/৭ দিন পর্যন্ত আগু বাড়িয়ে নেয়া হতোনা। পুকুর পাড়ে বা খোলা জায়গায় ধুলা মাটিতে বর সহ বরযাত্রীদের অপেক্ষা করতে হয় কোন আপোষ না হওয়া পর্যন্ত। তখন অপেক্ষামান বরযাত্রীদের জন্য দুলাহর পিতার বাড়ি হতে খাদ্য সরবরাহ করা হয়। এ আগু বাড়ানীর বিষয়ে কোন মীমাংসা না হলে অনেক সময় বিয়ে ভেঙ্গে দেয়া হতো। তখনকার দিনে চট্টগ্রামের মুসলমানের মধ্যে এসব সংস্কৃতি ছিল প্রচলিত অসামাজিক, অমানবিক,জঘন্যতম প্রথা। আজকাল সভ্য সমাজেও এর প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। তবে এখন শালা শালীরাই এসব করে থাকে যা মুরুব্বীদের ফয়সালায় মীমাংসা হয়ে যায়।
সেকালে চট্টগ্রামের এসব বিয়েতে বরপক্ষ কনের দাদী, নানীদেরকে মাইন টুবি (ছোট মাটির হাড়ি বিশেষ) দিয়ে সম্মান করতেন। এ টুবিতে একপোয়া বাতাসা ভর্তি করে কাগজ দিয়ে মুখ বেঁধে তার সঙ্গে আধবিরা পান ও এক গন্ডা সুপারী, এ তিন পদের জিনিষ নিয়ে হল মাইনটুবি। বরযাত্রীদেরকে আগু বাড়িয়ে নেয়ার পর তারা বিয়ের মজলিসে এসে তাদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে আসন গ্রহণ করতেন। সেখানে অন্য পাশে কনে পক্ষের মাহালত্যারা আসন গ্রহণ করে। তখন বরপক্ষ কনের পক্ষের নিকট রেকাবী চেয়ে নিয়ে তাতে বিয়ে উপলক্ষে কনের জন্য আনা সকল অলংকার ও পোষাক পরিচ্ছদ সাজিয়ে রাখে। এছাড়াও থাকে মাহালত্যাদের জন্য আনা পান সুপারী ও বাতাসার হাড়ি। এখানেও বাঁধত ফ্যাসাদ, কনে পক্ষের কাছে বরের পক্ষের দেয়া জিনিষ কম মনে হলে তা বদলিয়ে বেশী করে দিতে হতো। অথবা কনে পক্ষের সাথে আপোষ মীমাংসায় পৌছতে হতো। অন্যথা তা ২/৪ দিন বিলম্ব হয়ে যেতো অথবা বিয়ে ভেঙ্গে যেতো। এসব অনুষ্ঠান শেষে মূল কাজ আক্দ পড়ানোর কাজ শুরু হতো। আক্দ পড়ানোর সময় মৌলবী সাহেবের জন্য আক্দের বাটা দেয়ার নিয়ম। তাতেও সেই একই জিনিষ পান, সুপারী, টাকা ও চিনি ইত্যাদি থাকত। আক্দ পড়ানোর যে নিয়ম আগেরকার সময় প্রচলিত ছিল তা কম বেশী এখনও চালু রয়েছে। এর কোন হেরফের হয়নি। তবে ইদানিং ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী মসজিদে আকদ্ পড়ানো হয়। আকদের পর বউ সাজানো হয়। আজ কাল ক্লাবের অনুষ্ঠানে বউকে আগে হতে সাজিয়ে নিয়ে আসা হয়। এখানে বরের পক্ষ হতে নববধুর জন্য সোহাগ পুইয্যা বা পুরিয়া দিতে হয়। আকদের পর কনেকে হাতে তুলে দেয়ার পালা। নতুন বধু পাল্কি ছড়ে শ্বশুর বাড়ী যাত্রাকালে তার নিকট আত্মীয়দের একজন সাথী হিসেবে পাল্কির খুটি ধরে যেত। তাকে ডুলি ধরা বলা হয়ে থাকে।
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে কনে বধু হয়ে শ্বশুরবাড়ী যাওয়ার প্রাক্কালে পিতার ঘর হতে শাড়ীর কোনায় এক মুঠো চাউল, কাগজের পুটলি করে এক মুঠো ধান, এক মুঠো গরুর ঘরের মাটি, একমুঠো মুরগীর খোয়ারের মাটি, আরেক মুঠো ইদুরের গর্তের মাটি দেয়া হতো। নব বধুর পাল্কি শ্বশুর বাড়ীর উঠানে নামানোর সাথে সাথে বধু ইদুরের গর্তের মাটিগুলো কেউ না দেখার মতো সেখানে ফেলে দিতো।
এখন বধু বরণের পালা, নব বধুকে পাল্কি হতে নামানোর আগে শ্বশুর বাড়ীর দু’জন মেয়ে একখানি তামার রেকাবী ও একটি নোরা, একটি কলসী ভরা পানি নিয়ে আসত। পাল্কির দরজার সামনে রেকাবী খানা রেখে নোরাটি তার উপর রাখত। তারপর বধুকে নোরার উপর দাড় করিয়ে কলসী হতে পানি ডেলে তার পা ধূয়ে দেয়া হতো। তারপর দুলাহর বোন বা ভাবী নব বধুকে কোলে করে নিয়ে ঘরের এক কামরায় বিছানাতে বসিয়ে দেন। বধুর সামনে বরণকুলা রাখা হয়। একজন মেয়ে বধুর শাড়ীর কোনায় বাধা চাউলের মুঠো নিয়ে চাউলের জ্বালায়, ধানের মুঠো গোলায়, গরুর ঘরের মাটি গরু ঘরে এবং মুরগীর খোয়ারের মাটি মুরগীর খোয়ারে ছিটিয়ে দিয়ে আসে। ধান, চাউল, আর মাটি জীবন ও সৌভাগ্যের প্রতীক, নববধু সে সৌভাগ্য নিয়ে শ্বশুরবাড়ী পর্দাপন করল এটি তারই প্রতীক। এরপর একজন মেয়ে এসে একখানা কাথা দিয়ে কিছুক্ষনের জন্য বধুকে ঢেকে দেয়। কিছুক্ষণ পর কাঁথাখানা সরিয়ে নেয়া হয়। যা সাংসরিক জীবনে নববধুর গরম সহ্য করার ক্ষমতাকে বুঝানো হয়ে থাকে। এরপর একজন একটি হাতপাখা পানিতে ডুবিয়ে বধুর চোখে মুখে পাখাখানি ঘুরিয়ে বাতাস দেয় তাতে বধুর চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে পরে। এতে বধুর শীত সহ্য করার ক্ষমতা হয় বলে প্রচলিত আছে। এভাবে লোকাচারের মাধ্যমে বধুবরণ করা হয়। এরপর রয়েছে আরো অনেক অনুষ্ঠানাদি। আমি সংক্ষেপে শুধু নামগুলি বলে যাচ্ছি পরে এসব বিষয়ে আরো বিস্তারিত লেখার আশা রাখি। মধ্যযুগের মুসলমানরা চট্টগ্রামে নব বিবাহিত বর ও কনের প্রথম উপবেশনের জন্য মারোয়া নির্মাণ করা হয়।
বধুবরণের পর বউ দেখার পালা প্রথমে পরিবারের সকলে পরে পাড়া প্রতিবেশী সকলে বউয়ের মুখ দেখতে আসত। এরপর একে একে নতুন জামাইর আড়াইয়া খাওন, দুধপান, জামাইর পাঠ পাক্কন, ওয়ালীমা, নতুন বধুকে পাঁচ তরকারী দিয়ে ভাত খাওয়ানো, বৌভাত, ফুল শয্যা, নতুন বধুকে ফিরে নিয়ে যাওয়া। নতুন জামাইর চোরা বেড়ান, নতুন জামাইর সালামী, দামান্দী বা দাউন্দী খাওয়ানো, বেয়াই বাতা, হাজতি, মানের ভাত, বার মাসের তের ফল দেয়া প্রভৃতি অনুষ্ঠানাদি বিয়ে পরবর্তীতে পালিত হতো। এখনও এসব আচার অনুষ্ঠান চট্টগ্রামের সমাজ জীবনে খুজে পাওয়া যায়।
আমি অতি সংক্ষেপে আদিকালের চট্টগ্রামে মুসলিম সমাজে বিবাহের যে সংস্কৃতি চালু ছিল তা বর্ণনা করার চেষ্টা করছি তারমধ্যে এখনও অনেক নিয়ম কানুন ও সাংস্কৃতি চালু রয়েছে। অনেক কিছুর মাঝে আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে এবং অনেক কিছু কালের গর্বে হারিয়ে গেছে। তবে তখন যে সব নিয়ম কানুন ও সংস্কৃতি চালূ ছিল তারমধ্যে অনেক কিছুই ছিল অমানবিক। তবে তখনকার অনেক প্রচলিত নিয়ম নীতি বর্তমান সময়ের আধুনিক সভ্যতার ঢামাডোলে মাঝে হারিয়ে গেছে। তবু ও চট্টগ্রামের এসব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমূহকে জানা এবং তা সংরক্ষণ করা খুবই প্রয়োজন।
চট্টগ্রামের অনেককে আমি চট্টগ্রামের সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন করেছি তাঁরা এবিষয়ে নিজেদের অজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। আমাদেরকে নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্যর বিষয়ে জানতে হবে এবং বুঝতে হবে এবং প্রজন্মকে তা শিখাতে হবে। অন্যথা এসব একদিন কালের গর্বে হারিয়ে যাবে। ইতিহাসের প্রয়োজনে সংস্কৃতি সন্ধানের প্রয়োজনে এ লেখা।
(তথ্য সূত্র ঃ- আব্দুল হক চৌধুরী রচিত, চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি ডক্টর আব্দুল করিম সম্পাদিত আব্দুল্লাহ সেকান্দার বিরচিত শরীয়ত নামা, স্থানীয় মুরুব্বীদের সাথে আলাপ আলোচনা এবং নিজস্ব অভিজ্ঞতা)