বাংলা একাডেমির ‘মযহারুল ইসলাম কবিতা পুরস্কার’ এ বছর পাচ্ছেন বাংলা ছড়ার অগ্রণী পুরুষ সুকুমার বড়ুয়া। তিনি ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছিলেন ১৯৭৭ সালে, শিশুসাহিত্যে। বাংলা একাডেমি প্রদত্ত ‘কবীর চৌধুরী শিশুসাহিত্য পুরস্কার’ও পেয়েছিলেন ২০১০ সালে।
ছড়ার যাদুকর, ছন্দের যাদুকর সুকুমার বড়ুয়া। ‘অসময়ে মেহমান/ ঘরে ঢুকে বসে যান/ বোঝালাম ঝামেলার/ যতগুলো দিক আছে/ তিনি হেসে বললেন/ ঠিক আছে, ঠিক আছে/ মেঘ দেখে মেহমান/ চাইলেন ছাতাখান/ দেখালাম ছাতাটার/ শুধু কটা শিক আছে/ তবু তিনি বললেন/ ঠিক আছে, ঠিক আছে’-এরকম অনেক ছড়ার জনক সুকুমার বড়ুয়া। তাঁকে চারণ ছড়াশিল্পী বলা যায় নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশ বানের দেশ, ধানের দেশ, গানের দেশ অথবা বাঙালির গোলায় গোলায় ধান আর গলায় গলায় গান। ছড়া শিশুতোষ রচনা হিসেবে পরিচিত। শিশুর মনোরঞ্জন, অবসরযাপন, জ্ঞান ও নীতিশিক্ষা ইত্যাদি কারণে ছড়ার চর্চা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে লৌকিক ছড়া কেবল শিশুর জন্য রচিত হয়নি, শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবক, বয়স্ক সকল শ্রেণির জন্য সুকুমার বড়ুয়া ছড়া লিখেছেন। তিনি আঞ্চলিক ছড়া রচনা করেছেন।‘চম্পাবতীর জামাইয়ে/ পয়সা দু’য়া কামাইয়ে/ গরম গরম টেঁয়া ঢালি/ টেম্পু দুইয়ান নামাইয়ে’ কিংবা ‘গাছ বাড়িয়ার ব্যাপারি/ গোল মোহাম্মদ রেজা/ নিজের দোষে ক্ষতি হইলে/ পোয়ার মারে গেজা’। গ্রামে গরু-ছাগল ঠিকমতো না বাধলে পাড়া-পড়শির কথা শুনতে হয়। কেননা গরু-ছাগল ছুটে অন্যে খেত নষ্ট করে। ‘বেআক্কইল্যা এত গাধা/ ন শিখিল গরু বাধা/ এতবড় ছৈইয়র ডুয়া/ খাবা ফেলাইয়ে’। ছড়াকে ‘গ্রাম্য কবিতা’ বলা হয়। এটি সৃজনশীল রচনা, এতে ব্যক্তির আবেগ ও কল্পনা বাণীরূপ লাভ করে। সমাজের সমষ্টিগত মানুষের আবেগ ও কল্পনার বাক্সময় রূপ ছড়া। সুকুমারের ছড়ায় বাস্তব ও কল্পিত বিষয়ের মিশ্রণ আছে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ছড়ার অর্ধেক কল্পনার, অর্ধেক বাস্তবের। তিনি ছড়াকে ‘স্বপ্নদর্শী’ মনের সৃষ্টি বলেও উল্লেখ করেন।
সুকুমার বড়ুয়ার জন্ম ১৯৩৮ সালের ৫ জানুয়ারি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার মধ্য বিনাজুরি গ্রামে। তার বাবার নাম সর্বানন্দ বড়ুয়া এবং মা কিরণবালা বড়ুয়া। ব্যক্তিগত জীবনে সুকুমার বড়ুয়া তিন মেয়ে এবং এক ছেলের জনক। বর্ণজ্ঞান থেকে প্রথম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি মামাবাড়ির স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। এরপর বড় দিদির বাড়িতে গিয়ে ডাবুয়া খালের পাশে ডাবুয়া স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু সেই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। অল্প বয়স থেকেই তিনি বিভিন্ন সময় মেসে কাজ করেছেন। জীবিকা নির্বাহের জন্য একটা সময় তিনি ফলমুল, আইসক্রিম, বুট-বাদাম ইত্যাদি ফেরি করে বিক্রি করেছেন। ১৯৬২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে ৬৪ টাকা বেতনে চাকরি হয় তার। ১৯৭৪ সালে পদোন্নতি পেয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হন। ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টোরকিপার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
সুকুমার বড়ুয়ার বিখ্যাত কিছু সাহিত্যকর্ম হলো ‘পাগলা ঘোড়া’, ‘ভিজে বেড়াল’, ‘চন্দনা রঞ্জনার ছড়া’, ‘এলোপাতাড়ি’ এবং ‘নানা রঙের দিন’। তার ১০১টি ছড়া- ‘চিচিং ফাঁক’, ‘কিছু না কিছু’, ‘প্রিয় ছড়া শতক’, ‘বুদ্ধ চর্চা বিষয়ক ছড়া’, ‘ঠুস্ঠাস্’, ‘নদীর খেলা’, ‘আরো আছে’, ‘ছড়া সমগ্র’, ‘ঠিক আছে ঠিক আছে’, ‘কোয়াল খাইয়ে’, ‘ছোটদের হাট’, ‘লেজ আবিষ্কার’ প্রভৃতি। তিনি ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৭ সালে অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য সম্মাননা, ১৯৯৯ সালে আলাওল শিশুসাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১৭ সালে একুশে পদক লাভ করেন।
সুকুমারের ছড়ায় মানুষ, সমাজ, সংসার, প্রকৃতি, বিশ্বলোকের নানা চিত্র প্রতিফলিত। কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, ছন্দ যেন ভিটেবাড়ির প্রজা, যেমন খুশি ব্যবহার করছেন, হাসানোর জন্য, চটানোর জন্য, রাগিয়ে দেওয়ার জন্য, কী কাঁদাবার জন্য। অসম্ভব ক্ষমতা থাকলেই অতো সহজেই সমিল ছড়া ও কবিতা লেখা সম্ভব। মিল খোঁজার জন্য তাঁকে বোধ হয় কোনদিন নিজের চুল ছিঁড়তে হয়নি।…কবি না হলে এমন ছড়া ও কবিতা লেখা কিছুতেই সম্ভব নয়। তাঁর ছড়ার সংখ্যা অগুণতি। তাঁর রয়েছে অনেক রাজনৈতিক ছড়া। এখনো সমানতালে লিখে চলেছেন। শিশু থেকে বয়স্ক পর্যন্ত সকলের কাছে সুকুমারের ছড়া এখনো দোলা দেয়। তিনি এখনো শিশু। অনাগত শিশুর মাঝে বেঁচে থাকবেন।
সুকুমার বড়ুয়া ্অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী, সেসাথে এই পরিশ্রমীও। মেধা ও শ্রমের সংমিশ্রণে তিনি পেয়েছেন লেখালেখির ক্ষেত্রে অসামান্য খ্যাতি। দীর্ঘজীবী হোন ছড়ার জাদুকর, সুস্থভাবে বেঁচে থাকুন সৃষ্টির জন্য।