কবি জাফরুল আহসান। জন্মস্থান কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া দ্বীপে। তবে বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম শহরে। চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুল,চট্টগ্রাম কলেজ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবনের পাঠ চুকিয়েছেন। একসময় খুব লিখতেন, তারপর চুয়াল্লিশ বছরের বিরতি। অবশেষে ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ। কাব্যগ্রন্থের নাম ‘অসীম রেখেছি সীমিত সবুজে’।

 

কাব্যগ্রন্থটির নামকরণের দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি সীমাহীনকে কবি সীমানায় বাঁধতে চেয়েছেন। আর এই ‘সীমিত সবুজ’ শব্দ দুটো ব্যঞ্জনাময়। হতে পারে তা আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ,কিংবা এমনও হতে পারে সীমিত সবুজ দিয়ে তিনি আমাদের চিরনবীন মনকে বুঝিয়েছেন। এ কাব্যগ্রন্থে মোট ৬৪টি কবিতা। ভিন্ন ভিন্ন ভাবে,ভিন্ন ভিন্ন ছন্দে, ভিন্ন ভিন্ন শব্দচয়নে কবি এখানে তৈরি করেছেন কবিতার মায়াজাল। সেই মায়াজালে জড়িয়ে পড়ে আমরা কবির মনোজগতকে যেন প্রত্যক্ষ করি প্রতিটি কবিতার চরণে চরণে। সেই মনোজগতকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা কখনো পাই প্রেমতৃষ্ণায় কাতর এক কবিকে,কখনো বা আত্মতৃপ্ত এক মানবকে,কখনো বা সমকালের যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট এক কবিসত্তাকে। কবিতাগুলোর ভাববৈচিত্র্য আমাদের মুগ্ধ করে,মুগ্ধ করে কবির ছন্দ কুশলতা। ছন্দ এবং শব্দ নিয়ে কবি অনায়াসে খেলেছেন এ কাব্যগ্রন্থে। কবিতাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমি আমার বক্তব্যের যথার্থতা পাঠকের কাছে তুলে ধরবো।

এ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা “অন্তরীণ প্রতিদিন”। কবি এ কবিতায় জনকোলাহল থেকে নিজেকে লুকোতে চেয়েছেন। ধুসর সময় কবির মনকে আলস্যে ভরিয়ে দিয়েছে। সময়ের গতির সাথে পাল্লা দিতে কবিমন অপারগ। তাই তিনি বলেন–

বেলা বাড়ে অবেলায় বেশ ঢিমেতালে
অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায় ঘুমের উৎসব
কী এমন যায় আসে সময় হারালে
কর্মহীন চর্মসার নিরীহ নীরব।

সময়ের বৈরীপনায় কবি একা হয়ে গেছেন। একাকীত্বের যন্ত্রণা কবিকে কষ্ট দেয়। যদিও স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে,তবুও যাপিত সময় কবিকে হতাশ করে। কবি বলেন–

আকাশের অপেক্ষায় মাটি
ইশারায় ফিসফাস কী জানি কী হয়
মেঘে মেঘে বয়ে গেছে বেলা
ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে কি লাভ? শুধু অপচয়।
(একা)

এই একাকীত্ব ঘোচাতে কবি চান দয়িতার সঙ্গ। কিন্তু কবির দয়িতা কবির কাছ থেকে নিজেকে আড়ালে রাখে। তাই দয়িতার কাছে কবির প্রশ্ন—

কতটা আড়াল চাও তুমি?
কতটা আড়াল আমি মেনে নিতে পারি?
নিজেকে মুড়েছো খুব, নিশ্ছিদ্র কঠিন,
শিরস্ত্রাণে ঢাকা চুল, নেকাবে অচিন
কিভাবে ঠেকাবে তুমি,অব্যর্থ শিকারি?
(কতটা আড়াল চাও তুমি)

কিন্তু দয়িতা নিজেকে আড়ালে নিলে কী হবে,কবি তো মনোজগতে তার সঙ্গেই থাকেন।তাই কবি উচ্চারণ করেন–

তুমি আমি নদী মোহনায় যদি উথাল-পাথাল ঢেউ
তুমি কতদূরে আমি ভবঘুরে জ্বলে পুড়ে ছাই কেউ
তুমি আমি নই আমরা একই দুটো দেহ এক সুতো
মিলেমিশে লীন এককে বিলীন খুঁজে মরি ছলছুতো।
(পূর্ণিমা)

কবি তাঁর দয়িতাকে নিয়ে ভালো থাকতে চাইলেও সমকালীন অস্থিরতা কবিকে উৎকণ্ঠায় রাখে। কবি তা এড়িয়ে যেতে পারেন না। নারীজাতির প্রতি বর্বর পুরুষদের বিষাক্ত থাবা কবিকে কষ্ট দেয়। কবি বলেন–

পুরুষ, তুমি আজ কেন কাঠগড়ায়?
প্রবল শক্তির দম্ভ কাল হলো কার ধৃষ্টতায়?
তুমি কেন শত্রু হলে সভ্যতার?
সুন্দরের মুখে কেন ছাইভস্ম তোমার লিপ্সার?
(রোজনামচা)

চারপাশের দম বন্ধ করা অসুস্থ পরিবেশ কবিকে বিষণ্ন করে তোলে। কবিরা সুন্দরের আরাধনা করেন। তাই অসুন্দরকে কবিরা মেনে নিতে পারেন না। কবি বলেন–

প্রতি পদে পদে বিপদে আপদে কোথাও ফেরার নেই
ঠিকানাবিহীন বিবর্ণ দিন মৃতপ্রায় খাঁচাতেই।
সুতো কাটা ঘুড়ি পদাহত নুড়ি ভাটির কচুরিপানা
না ঘর না ঘাটে অতিথির কাটে মাটি ছুঁয়ে দেখা মানা।
(খাঁচা)

এ দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে কবির প্রয়োজন তাঁর দয়িতাকে। তিনি মনে করেন তাঁর প্রেয়সীই একমাত্র তাঁর জীবনে রাতের অন্ধকার কাটিয়ে ভোর এনে দিতে পারেন। তাই কবির দৃপ্ত কণ্ঠস্বর–

তুমি ফিরে এলে,বাঁচা মরা ঠেলে পুলসিরাতের ঘোর;
তুমি তাকালেই ঘাড় বাঁকালেই ঘোর আকালেই ভোর।
তুমি বললেই ছুটে চললেই মন গললেই খাঁটি
পাতা মর্মর নদী খরতর জলে উর্বর মাটি
(ফিরে এলে)

কবি মনে করেন সমকালীন সমাজে যে অনাচার বাসা বেঁধেছে তার থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন সমাজের মানুষের পারস্পরিক আত্মিক বন্ধন। সেইসাথে প্রয়োজন স্রষ্টার নিকট অনুগত হওয়া। তাই কবি বলেন-

আত্মার বন্ধন খুব প্রয়োজন ভাঙা ও গড়ায়
পৃথিবীটা তৈরি হোক ভালোবাসায়
সমাগত স্বপ্নভূমে পরস্পর প্রতিশ্রুত সহমর্মিতায়
সবাই নিবিষ্ট হোক স্রষ্টা ও সৃষ্টির নিষ্ঠায়।
(এক মোহনায়)

এক অদ্ভুত জীবাণুর দাপটে বর্তমান বিশ্ব বিপর্যস্ত। এই বিপর্যস্ততা কবিকেও আক্রান্ত করেছে। ক্ষুদ্র এক জীবাণুর কাছে মানবতার এমন অপমান কবিকে আহত করেছে। তাই কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হয়–

কিম্ভুত জীবাণু এক জাতি ধর্ম ভেদে
অনিবার্য আয়োজন পণ্ড করে দিতে
সটান দাঁড়িয়ে আছে বেপরোয়া জেদে
জীবনমৃত্যুর খেলা কে হারে কে জিতে।
(ফোরাতের তীরে)

অশান্ত মনে কবি সান্ত¡না খোঁজেন এই ভেবে যে, হয়তো মানুষেরই পাপে আজ প্রকৃতি এমন রুষ্ট।কারণ মানুষ তাঁর স্বজাতিকে ফাঁকি দিতে পারলেও প্রকৃতিকে তো ফাঁকি দিতে পারবে না। তাই কবি বলেন—

প্রকৃতি কাতর প্রেমে,মানুষ ব্যাকুল
জন্মাবধি পুষে রাখে আজন্মের পাপ
অন্যায্য স্বপ্ন দেখে ভুলের মাশুল
মুগ্ধতা মারমুখী হলে ছড়ায় উত্তাপ।

প্রকৃতি মানুষ চেনে, প্রায়শ হারামী
সর্বভুক, আত্মগত, ভণ্ড, বহুগামী।
(মুগ্ধতা মারমুখী হলে)

সাম্প্রদায়িক হানাহানি কবিকে কষ্টের সাগরে ভাসায়। একই স্রষ্টার সৃষ্ট মানবকুল যখন সম্প্রদায়গত কারণে পরস্পরকে বিধ্বংস করতে উদ্যত, তখন কবি বলেন–

ম-পের মূর্তি ভেঙে লাভ?
সৌভ্রাতৃত্ব ল-ভ- চ-বুদ্ধি লুটেরা স্বভাব?
বিষলক্ষ্যা ভুলের বিন্যাস?
ক্ষয়িষ্ণু দাঁতের ক্রোধ সূর্য প্রীতি বানর বিলাস?
(সম্প্রীতির শ্রেষ্ঠ উপমায়)

কবি কামনা করেন সব বিভেদ, সব আত্মমগ্নতা ভুলে এ দেশের সব মানুষ আবার একত্র হবে।ভুলে যাবে তারা সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ। তাই কবি উচ্চারণ করেন–

এসো আজ প্রাণে প্রাণে মাখামাখি হোক
অভিন্ন মিছিলে থাক টুপি ও ত্রিশূল
দূর হোক জড়বুদ্ধি নিষেধের শ্লোক
ঘৃণার শ্যাওলা আর অন্তরের ঝুল।
(এই শরতে)

সমাজ এবং দেশ নিয়ে কবি ভাবনায় কাতর হলেও প্রেয়সীকে কিন্তু ভুলতে পারেন না। কারণ কবিপ্রিয়ার দুটো চোখ সারাক্ষণ কবিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কবির ভাষায়–

চোখের ধাঁধায় চোখ ডুবেছে জলে
মেঘের ডাকে হাওয়ায় ভাসে চাঁদ
মগ্ন দানে চোখ জুড়ানোর ছলে
পথ রুখেছে চোখের আর্তনাদ।
(চোখ)

কবি ভালোবাসায় একনিষ্ঠ। শত প্রলোভন, শত বৈরিতা কবিকে তার দয়িতাকে পাশে চাওয়ার আকুতি থেকে সরাতে পারে না। কবির সাহসী উচ্চারণ–

তোমাকে চাই শর্ত ছাড়া চাই তোমাকে
তোমাকে চাই চড়াই উৎরাই ঘূর্ণিপাকে
তোমার প্রেমের অভ্রভেদী উচ্চতাকে
আমার বুকে উস্কে রেখো জটিল বাঁকে।
(তোমাকে চাই)

তাই বলে কবি প্রেয়সীকে নিয়ে স্বার্থপরের মতো দেশ সমাজ ছেড়ে একা থাকতে চান না। তিনি সমাজসচেতন। তাই সমাজের অসংগতি তাঁকে কষ্ট দেয়। সমাজপতিদের মিথ্যাচার তাঁকে বিক্ষুব্ধ করে। তারই প্রকাশ ঘটে এভাবে—

মিথ্যে তুমি, নেতা
মিথ্যে আদিখ্যেতা
এমন তোমার মিথ্যে অভিনয়
মিথ্যেটাকেই সত্যি মনে হয়।
(মিথ্যে তুমি নেতা)

নানা অসংগতি, দুরাচার, অনিয়মের ভারে কখনো কখনো কবি খুব বিষণ্ন হয়ে পড়েন। বিষাদ তাঁকে আচ্ছন্ন করে। ক্লান্ত স্বরে কবি বলেন–

এ কেমন বিষণ্নতা, এ’কেমন স্বেচ্ছানির্বাসন
নৈঃশব্দের অন্ধকূপে, এ’কেমন মুখ গুঁজে থাকা
শীতল সন্ন্যাসে দীর্ণ, এ’কেমন বোবা ক্রন্দন
জনশূন্য চরাচরে, এ’কেমন জলছবি আঁকা।
(আমরা পাশেই আছি)

তবে কবি বিষাদে মগ্ন থাকতে নারাজ। একদিকে যেমন কবির দয়িতা কবিকে বাঁচিয়ে রাখে আশাজাগানিয়া হয়ে,তেমনি আবার কবি আপন আত্মজার ক্লান্ত অবয়ব দেখেও ঘুরে দাঁড়াবার,উঠে দাঁড়াবার শপথ নেন। কবির ভাষায়–
স্রষ্টার শপথ জেনো,অধিকন্তু রক্তের শপথ
ছায়া হয়ে সঙ্গ দেবো, যতদূরে যাই
প্রাণপণে টেনে নেবো জীবনের রথ
ঝড় ঝাপটা যত থাক,চলো পা বাড়াই।

বেড়ে উঠো, ঋদ্ধ হও, আত্মজা আমার
তোমাতেই রেখে যাবো উত্তরাধিকার।
(ভালোবাসা-১)

এভাবে কবি এ কাব্যে বিভিন্ন কবিতায় তাঁর মনোজগতকে তুলে ধরেছেন। একেকটি ভাবকে কবিতায় তুলে ধরতে গিয়ে কবি বিভিন্ন ছন্দে অপূর্ব পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। উপর্যুক্ত কবিতাগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই কবি অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত এবং স্বরবৃত্তে অত্যন্ত সাবলীল। এছাড়া কবির শব্দভা-ারও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এই আকালের যুগে কবি জাফরুল আহসানের “অসীম রেখেছি সীমিত সবুজে” কাব্যগ্রন্থটি ভাববৈচিত্র্য,শব্দচয়ন ও ছন্দকুশলতায় বিশিষ্টতার দাবী রাখে। কবির নিয়মিত কবিতাচর্চা বাংলার সাহিত্যাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করবে বলে আমি আশাবাদী।