জ্যোতির্ময়ী দেবী “দুর্গা” ঈশ্বরের শক্তির প্রতীক । তিনি দুর্গতিনাশিনী অর্থাৎ এ মহাবিশ্বের যাবতীয় সংকট তথা কষ্টের বিনাশকারী শক্তি। দুর্গম বিপদ ও অশুভ মোচনের জন্য যে কোন সংকটকালে ‘দুর্গাস্তোত্র’ অথবা ‘দুর্গা দুগা’ নাম যপ করলে অর্থাৎ মহাশক্তিময়ী মায়ের আরাধনা করলে অশুভ বিপদ হতে মুক্তি মিলে। শক্তিকে পূজা করতে হয়। শুধু মর্ত্যে নয় দেবলোকে দেবতারাও শক্তির আরাধনা করেন। মহিষাসুরের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যে স্বর্গলোকে দেবতাগণ শক্তির আরাধনা করেছিলেন। দেবতাদের সাধনার সম্মিলিত শক্তি থেকে আবির্ভুত হলেন জ্যোতির্ময়ী মহাজাগতিক শক্তি ‘‘দেবী দুর্গা’’। মর্ত্যওে দুর্গতি নাশ ও মঙ্গল কামনায় নানানভাবে শক্তির পূজা হয়ে থাকে । শক্তিকে পুজা করলে ‘শক্তি’ কিছুই নেন না, বরং ‘শক্তিমান’কে পাইয়ে দেন। ‘শক্তিমান’র চেয়ে ‘শক্তি’র কৃপা বেশী তাই আমরা শক্তিকে নিয়ে বেশী মাতামাতি করি। যেমন ‘চাঁদ’ হল ‘শক্তিমান’ আর ‘জ্যোৎস্না’ হল তার ‘শক্তি’। ‘শক্তি’ অর্থাৎ ‘জ্যোৎস্না’ আমাদের কাছে আসে কিন্তু ‘শক্তিমান’ অর্থাৎ ‘চাঁদ’ আসেনা। তদ্রূপ শক্তিদেবীর শক্তি বিভিন্নভাবে শক্তিমানের মাধ্যমে বিশ্বভ্রম্মান্ডে লীলা করছে, তা বুঝার এবং হৃদয়ে ধারন করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। অসীম গুণ ও ক্ষমতার অধিকারী ঈশ্বর জীব-জগতের বিশেষ প্রয়োজনে দেবতা বা দেবীরূপে নিজের কোন গুণ বা ক্ষমতাকে কোন বিশেষ আকার বা রূপে প্রকাশ করেন বা আবির্ভূত হন। দেব-দেবী-দেবতা ঈশ্বরের গুণ বা শক্তির প্রকাশ।

শক্তির দেবী দুর্গা মঙ্গলকারিণী, দুর্গতিনাশিনী। অর্থাৎ এ মহাবিশ্বেও যাবতীয় কষ্ট বা দুর্গতির বিনাশকারী বলে তিনি দুর্গা। মহর্ষি ঋষিগণের অভিমত, দু:সাধ্য সাধনার মাধ্যমেই কেবল তাঁকে পাওয়া যায় বলে তিনি দুর্গা। তিনি বিশ্বব্যাপিনী চন্ডী, বিশ্বরূপিনী আদ্যাশক্তি মহামায়া। দূর্গতি নাশ হয়ে পরম সুখের আশায় আশীর্বাদ লাভের চেষ্টাই দূর্গাপূজার মূল উদ্দেশ্য। পূজার মাধ্যমে সন্তুষ্টি অর্জন করা গেলে অভীষ্ট লাভ হয়। বিভিন্ন সময়ে জাগতিক প্রয়োজনে এবং জন হিতার্থে মহাশক্তি সম্পন্না দেবী দুর্গার আরাধনার কাহিনী ধর্মীয় শাস্ত্রে বর্ণিত আছে। স্বর্গে ও মর্ত্যে সর্বলোকে দুর্গা পূজা বিশেষ মর্যাদায় সমাদৃত। শক্তির পরিচয়ে ব্যর্থ হয়ে ইন্দ্রের ধ্যানমগ্ন হওয়ায় ব্রহ্মবিদ্যা উমারূপে(দুর্গা) দর্শন দেয়ার গল্প আছে। সেখানে ব্রহ্মার শক্তি হলেন ‘উমা হৈমবতী’ অর্থাৎ ‘দুর্গা’। পূরাণে এই দুর্গা ‘শিবা’ নামে খ্যাত। মহাভারতের যুগেও দুর্গাপূজা হয়েছে। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধের প্রাক্কালে অর্জুনকে বলেছিলেন, “র্দুগাস্তোত্রমুদিরয়”। ত্রেতা যুগে শ্রী রামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য অকালবোধন করে দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণে কথিত আছে পিতৃসত্য রক্ষার জন্য দশরথ পুত্র রাম চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাস গমন করেছিলেন। সহযাত্রী হয়েছিলেন রামপত্নী সীতা আর ভ্রাতাশ্রী লক্ষণ । সেখানে রাবণ সীতাকে হরণ করেছিল। রাবণকে কোনভাবে পরাজিত করতে না পেরে দেবতাদের পরামর্শে শরৎকালে পূজা করেছিলেন রামচন্দ্র। শরৎকালের পূজা অকাল পুজা। তিনি মূলত: ‘অকাল বোধন’ করে মহামায়ার সুপ্তাবস্থায় থাকা কুন্ডলিনী শক্তি জাগ্রত করেছিলেন। অকাল শব্দের অর্থ অসময় আর বোধন শব্দের অর্থ জাগরণ। অকাল বোধন মানে অসময়ে জাগরণ। এ অসময় জাগরণ মানুষের নয় দেবতার। মানুষ এবং দেবতাদের নিদ্রা ও জাগরণের রয়েছে বিশাল পার্থক্য। মানুষ দিনে বার ঘন্টা জাগে আর রাতে বার ঘন্টা ঘুমায় । আর সূর্যের গতিবিধি অনুসারে মাঘ মাস হতে আষাঢ় মাস অর্থাৎ উত্তরায়নে দেবতাদের দিন বা জাগরণের সময় আর শ্রাবণ হতে পৌষ মাস অর্থাৎ দক্ষিণায়নে দেবতাদেও রাত অর্থাৎ নিদ্রার সময়। এ দক্ষিনায়নে শরৎকালে তথা আশ্বিন মাসে শ্রী রামচন্দ্র দুর্গাপূজা করেছিলেন রাক্ষসরাজ রাবণের লঙ্কাপুরী থেকে জনকন›দিনী তথা রামজায়া সীতাকে উদ্ধারের নিমিত্তে। শ্রীরামচন্দ্রের স্তুতি ও তপস্যায় নিদ্রিত জ্যোর্তিময়ী জাগ্রত হলেন এবং সন্তুষ্ট হয়ে রামচন্দ্রকে আশীর্বাদ করলেন। রাম সুপ্রসন্না দেবী দুর্গা সমগ্র শক্তিতে সপ্তমী তিথিতে শ্রীরামচন্দ্রের দিব্য ধনুর্বাণে প্রবশ করলেন, অষ্টমী তিথিতে রাম-রাবণের মহাযুদ্ধ ও অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের দশ মাথা মাটিতে লুিটয়ে দিলেন। দশমীতে শ্রীরামচন্দ্র বিজয়োৎসব করলেন। দেবীর আশীর্বাদে রামচন্দ্র রাবন বধ করে সীতাদেবীকে উদ্ধার করলেন। দুর্গার আরাধনায় রামের মহাবিপদ কেটে যাওয়ায় দুর্গাপূজার ষষ্টীর নাম হল মহাষষ্ঠী, সপ্তমীর নাম হল মহাসপ্তমী, অষ্টমীর নাম হলো মহাঅষ্টমী, নবমীর নাম হলো মহানবমী। রামচন্দ্রের এ অকালবোধনকে অনুসরণ করেই শরৎকালের দুর্গাপূজাই বিশ্বের হিন্দু সম্প্রদায় শ্রেষ্ট পূজা হিসেবে প্রচলিত আছে। আবার রাজা সুরথ ও সাধক সমাধি উভয়ে নিজ নিজ দুর্গতি থেকে মুক্তি লাভের জন্য বসন্তকালে দেবীর পূজা কওে দেবীর কৃপালাভ করেছিলেন বলে এ‘পূজাকে ‘‘বাসন্তী পূজা’’ বলা হয়। দেবীর জাগ্রত অবস্থায় যে পূজা অর্থাৎ বাসন্তী পূজা আমাদের ধর্তব্য বটে। পুরাণে বলা হয়েছে, “ পূজিতা সুরথেনাদৌ দুর্গা দুর্গতিনাশিনী।/ মধুমাসসিতাষ্টম্যাং নবম্যাং বিধিপূর্বকম।।”
বসন্তকালে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হলেও রামচন্দ্রের শারদীয়া পূজাকেই দুর্গা পূজা বলা হয় এবং শরৎকালে ধর্মীয় চেতনায় মহাধুমধাম ও আনন্দোল্লাসে এ দুর্গাপূজা উদযাপিত হয়। হিন্দু শাস্ত্রেও বিধানে প্রায় প্রতি মাসেই কোন না কোন পূজা রয়েছে এবং সবসময় পূজা চলছে। কিন্তু তার মধ্যে দূর্গাপূজা উৎসবরূপে আখ্যায়িত হয়েছে। কেননা সমগ্র লোকের অংশগ্রহনে এ পূজা উৎসবের আমেজ ধারণ করে অর্থাৎ উৎসব শব্দের অর্থের যথার্থতা দুর্গাপূজায় পরিপূর্ণরূপে প্রতিফলিত হয়। ‘উৎ’ (উপসর্গ), ‘সু’(ধাতু) ও ‘অ’ (প্রত্যয়) যোগে উৎসব শব্দ গঠিত।‘ উৎ’ মানে ‘উৎসারিত, বা ‘উপচে পড়া’ আর ‘সু’ মানে আনন্দ। ‘অপ’ প্রত্যয়যোগে গঠিত সমগ্র শব্দ ‘উৎসব’ মানে উপচে পড়া অনন্দের অনুষ্ঠান অর্থাৎ যে অনুষ্ঠানে আপামর জনসাধারণ– ধনী-দরিদ্র, উচ-নীচ সকল স্তর ও শ্রেনীর মানুষ সমান ভাবে যোগ দিতে পারে। বস্তুতপক্ষে দুর্গাপূজায় ব্রাহ্মণ থেকে মুচি, হাড়ি, ডোম, ধোপী, কামার, কুমার, তাঁতী সকলের অংশগ্রহন প্রয়োজন – এমন কি পতিতার বাড়ীর মাটি পর্যন্ত লাগে। বস্তুত: মায়ের পূজায় অর্থাৎ মায়ের আরাধনায় সকলের অংশগ্রহনের দ্বার উন্মুক্ত। স্বয়ং স্বত:স্ফুর্ততায় সকলে যার যার অবস্থান থেকে মায়ের আরাধনায় সম্পৃক্ত হয়ে আনন্দ উৎসবে শরীক হয়। আবার এ দুর্গাপূজাকে ঘিরে জনজীবনে সর্বস্তরে কর্মব্যস্ততা বাড়ে, বাড়ে বিভিন্ন কাজে উপার্জনের সুযোগ। ফলে মানুষ কর্মানন্দে মেতে উঠে যা পূজার আনন্দকে বহু মাত্রায় রাঙিয়ে তোলে। আনন্দময়ী মায়ের আগমন প্রস্তুতিতে সকলের জীবন আনন্দমূখর হয়ে উঠে। ঘরে ঘরে জ্বলে আনন্দ পূণ্যপ্রদীপ আর আনন্দ কন্ঠে ধ্বনিত হয় —
“এসেছে মা উমা, গিরিরাজ ঘরে/ জুড়ায়ে মায়ের কোল।/ মেতেছে ধরনী গাহে আবাহনী/ পরানে লেগেছে দোল।।
দিকে দিকে ঢাকঢোল আর মধুর গান বাজনায় মহানন্দের মহাধুমধাম। নুতন কাপড় পড়ে শিশু, কিশোর, আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা সকলের ঘুরে বেড়ানোর ছুটাছুটি। ধনী-দরিদ্র সকলেই একই কাতারে পূজা -আরতি আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠে। কিন্তু এত সব আনন্দ আয়োজনের মাঝে পূজা যেন সাত্ত্বিকতা হারিয়ে তামসিক হয়ে না পড়ে সেদিকেও নজরদারি প্রয়োজন। অজ্ঞানতা আর অহংকারে অন্ধ হয়ে মানুষ আসুরিক হয়ে উঠে। মানুষে মানুষে শুরু হয় আসুরিক শক্তির প্রতিযোগিতা। এই আসুরী প্রবৃত্তি জনজীবনকে নানাভাবে কলুষিত করে। হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানিতে সমাজ আজ বিপন্ন প্রায়। অত্যাচারী,ব্যভিচারী আর লুটেরাদেও অনাচার সর্বত্র দৃশ্যমান। এ আসুরিক দ্বন্দ্ব পরিহার করে সকলের মাঝে ভ্রাতৃত্ব ও মমতা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দেবী দুর্গার আরাধনা। দুর্গাপূজা অসুরনিধন ও দুর্গতিনাশের পূজা। মনের মাঝে যে আসুরিক প্রবৃত্তি তা বিনাশ করতে পারলে জীবনের দুর্গতি নাশ হবে। আসুরীপনা তথা পশুত্বকে বিসর্জন দিয়ে দৈবী চেতনা জাগ্রত করতে পারাটাই প্রকৃত বিজয়। দুর্গা পূজায় মায়ের আশীর্বাদ বিজয় সম্ভব হলে বিজয়োৎসব প্রকৃত অর্থে আনন্দমূখর হয়। এতেই দুর্গা পূজার সার্থকতা।