শারদীয়া দুর্গাপূজা বাঙালী জাতির শ্রেষ্ঠ উৎসব। দুর্গাপূজায় আদ্যশক্তি মহামায়া দুর্গা মায়ের পাশাপাশি অনেক গুলো শক্তির পুজা করা হয়। দূর্গা পূজা কেবল মাত্র পুস্পবিল্বপত্রের এবং ঢাক-ঢোলের পূজা নয়; ভক্তি ও শক্তির পুজা। আজ মায়ের মহাষ্টমী পূজা যথানিয়মে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশের রামকৃষ্ণ মিশনসহ বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী মন্দিরে অষ্টমীর মহাতিথিতে এই কুমারী পূজা হয়ে থাকে। চট্টগ্রামে পাথরঘাটার শ্রীশ্রী শান্তনেশ্বরী মাতৃমন্দিরে প্রতিবছর কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মাতৃভাবে কুমারী কন্যাকে জীবন্ত প্রতিমা কল্পনা করে জগজ্জননীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করাই কুমারী পূজার মুল উদ্দেশ্য। মুলত নারীজাতির প্রতি সন্মান ও শ্রদ্ধা করতে এই পূজা করা হয়। সনাতন ধর্মে নারীকে সন্মানের শ্রেষ্ঠ আসনে বসানো হয়েছে। “নিজেদের পশুত্বকে সংযত রেখে নারীকে সন্মান জানাতে হবে”- এটাই কুমারী পূজার মূল লক্ষ্য। বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এ রামের জন্য ব্রহ্মার দুর্গাপূজার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। তখন শরৎকাল, দক্ষিণায়ণ। দেবতাদের নিদ্রার সময়। তাই, ব্রহ্মা স্তব করে দেবীকে জাগরিত করলেন। দেবী তখন কুমারীর বেশে এসে ব্রহ্মাকে বললেন, বিল্ববৃক্ষমূলে দুর্গার বোধন করতে। দেবতারা মর্ত্যে এসে দেখলেন, এক দুর্গম স্থানে একটি বেলগাছের শাখায় সবুজ পাতার রাশির মধ্যে ঘুমিয়ে রয়েছে একটি তপ্তকাঞ্চন বর্ণা বালিকা। ব্রহ্মা বুঝলেন, এই বালিকাই জগজ্জননী দুর্গা। তিনি বোধন- স্তবে তাঁকে জাগরিত করলেন। ব্রহ্মার স্তবে জাগরিতা দেবী বালিকামূর্তি ত্যাগ করে চন্ডকিার্মূতর্ ধারণ করলেন।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মনে করতেন কুমারীর হৃদয়ের সঙ্গেই সব থেকে বেশী একাত্ম বোধ করেন মা দুর্গা। এ ভাবনায় ভাবিত হওয়ার মাধ্যমে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রী জগজ্জননী মা সারদাদেবীকে ষোড়শীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন। তাঁর স্মরণেই বেলুড় মঠে কুমারী পুজোর সূচনা। স্বামী বিবেকানন্দ মাতৃজাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ১৯০১ সালে বেলুর মঠে মা সারদাদেবীর অনুমতিক্রমে কুমারী পূজা প্রচলন করেন। বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গা পুজোর সময়ে এক সঙ্গে অনেক কুমারীর পুজো করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। এখন অবশ্য একজন কিশোরীকেই কুমারী রূপে পুজো করা হয়। ঠিক যে যে ভাবে দুর্গা আরাধনা হয়, ঠিক সেই একই ভাবে বন্দনা করা হয় কুমারীকেও। যা কিছু মা দুর্গাকে অর্পণ করা হয়, সেই সব কিছুই অর্পণ করা হয় ওই কিশোরীকেও।
দর্শনশাস্ত্রবিদের মতে কুমারী পূজা হলো নারীতে পরমার্থ দর্শন। এই ত্রিভুবনে যে শক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত রয়েছে। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। এ সাধনপদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্বজননী কুমারী নারীমূর্তির রূপ ধারণ করে; তাই তার নিকট নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্যা। শ্রীরামকৃষ্ণের কথামৃতে বলা আছে- সব স্ত্রীলোক ভগবতীর এক-একটি রূপ। শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশি প্রকাশ।’
সনাতনধর্মের বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি এবং মাহাত্ম্য বিশদভাবে আমরা দেখতে পায়। ঐ সমস্ত ধর্মীয় গ্রন্হের বর্ণনানুসারে কুমারী পূজায় কোন জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে-কোন কুমারীই পূজনীয়, এমনকি বেশ্যাকুলজাত কুমারীও। গত কয়েক বছর আগে এক মুসলিম মেয়েকেও কলকাতায় পূজামন্ডপে কুমারী জ্ঞানে পূজা করা হয়েছিল। এখানেই সনাতন ধর্মের সার্বজনীন ভাবটি প্রকাশিত। তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যা হলে সবচেয়ে ভালো এবং সর্বত্র প্রচলিত।কারন শাস্ত্রমতে-“সর্বকামনা সিদ্ধির জন্য ব্রাহ্মণ কন্যা, যশোলাভের জন্য ক্ষত্রিয় কন্যা, ধনলাভের জন্য বৈশ্য কন্যা ও পুত্র লাভের জন্য শূদ্রকূল জাত কন্যা কুমারী পূজার জন্য যোগ্য।”এক্ষেত্রে এক থেকে ষোলো বছর বয়সী যে কোনো কুমারী মেযে়র পূজা করা যায়। বয়সের ক্রমানুসারে পূজাকালে এই সকল কুমারীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয় বয়সভেদে। শাস্ত্রমতে এক বছর বয়সে সন্ধ্যা, দুইয়ে সরস্বতী, তিনে ত্রিধামূর্তি, চারে কালিকা, পাঁচে সুভগা, ছয়ে উমা, সাতে মালিনী, আটে কুব্জিকা, নয়ে অপরাজিতা, দশে কালসন্ধর্ভা, এগারোয় রুদ্রাণী, বারোয় ভৈরবী, তেরোয় মহালক্ষ্মী চৌদ্দয় পীঠনায়িকা, পনেরোয় ক্ষেত্রজ্ঞা এবং ষোল বছরে অম্বিকা বলা হয়ে থাকে।
কুমারী দেবী ভগবতীর অতি সাত্ত্বিক রূপ। জগন্মাতা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্ত্রী হয়েও চিরকুমারী। কুমারী আদ্যাশক্তি মহামায়ার প্রতীক। দুর্গার আরেক নাম কুমারী। মূলত নারীর যথাযথ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতেই কুমারী পূজার আয়োজন করা হয়। মাটির প্রতিমায় যে দেবীর পূজা করা হয়, তারই বাস্তবরূপ কুমারী পূজা। কুমারীতে সমগ্র মাতৃজাতির শ্রেষ্ঠ, শক্তি, পবিত্রতা, সৃজনী ও পালনী শক্তি, সকল কল্যাণী শক্তি সূক্ষ্ম রূপে বিরাজিতা।
আমরা দুর্গা পুজোর তাৎপর্য বিশ্লষণ করলে দেখি যে, হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে দেবী দূর্গা ‘দূর্গতিনাশিনী’ বা সকল দুঃখ দুর্দশার বিনাশকারিনী। পুরাকালে দেবতারা মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। শিব, ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু ভক্ত ও দেবতাদের ঐক্যবদ্ধ সংহত শক্তির বলে সৃষ্ট মা দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। শিব, ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু ভক্ত ও দেবতাদের তিন প্রধান, আবার তিনের মিলে পরমব্রহ্ম। আমরা যে ‘অউম্’ (ওঁ) বলি, তার দ্বারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব এ তিনে বিভক্ত ব্রহ্মকেই বুঝি। অর্থাৎ ‘ওঁ’ মানে পরমব্রহ্ম। একতাবদ্ধ অনুশীলন ও ঋদ্ধ নৈপুণ্যের কাছে পরাভূত হয়েছিল বৈরী আসুরিক শক্তি।সকল দেবতার শক্তির সম্মিলনশক্তির কাছে পরাজিত হয়ে বাধ্য হয়েছিল স্বর্গরাজ্য ছেড়ে দিতে। সুতরাং সব শুভশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে নিয়ে অশুভ শক্তির সঙ্গে লড়তে হয়। আবার নিজের দেশের ভেতরে কখনও কখনও অপশক্তি প্রতিষ্ঠা পায়- শুভের পক্ষের শক্তির অসচেতনতা, ভোগ-লালসা বা অনৈক্যের কারণেও। তখন শুভের পক্ষের শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার দ্বারা সত্য প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হতে হয়। এখানেও দুর্গাপূজার প্রতীকী শিক্ষা আমরা দেখতে পায়।
সর্বজনীন দুর্গাপূজা হলো অশুভ, অন্যায়, পাপ, পঙ্কিলতার বিরুদ্ধে ন্যায়, পূর্ণ, সত্য, শুভ ও সুন্দরের যুদ্ধ। দুর্গতি থেকে রক্ষা, বিভেদ, বিবাদ, অনৈক্য, সাম্প্রদায়িকতা, ক্ষুদ্রস্বার্থবোধ ও সংকীর্ণতা প্রভৃতির ঊর্ধ্বে ওঠার জন্য মহাশক্তির বর লাভের নিমিত্তে দেবী বন্দনা। আত্মশক্তির উত্থান, প্রাণশক্তির জাগরণ, ষড়রিপুর গ্রাস থেকে মুক্তির জন্য আদ্যাশক্তি মহামায়ার কৃপালাভের জন্য দুর্গাদেবীর আরাধনায় মেতে উঠবে বিশ্ব চরাচর। দেবীর চরণে কাতর মিনতি এবারের দুর্গোৎসব যেন সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে সৌহার্দ্য, হিংসা, বিদ্বেষ, কলুষতামুক্ত ভালোবাসার স্পন্দনে মথিত ও গৌরাবান্বিত করে তুলুক আমাদের সবার হৃদয়কে ।
লেখক : প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ।