শৈশবে বাংলা বর্ণমালা শেখাতে গিয়ে শিক্ষকের নানা উপমার ব্যবহার। ‘দ’ মানে হাঁটুভাঙা। কি যৌক্তিক ব্যাখ্যা। মায়ের গর্ভে শিশু থাকে হাঁটু মুড়িয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে। জন্মের পরে শিশুর কান্নার সাথে সবার আনন্দধ্বনি। সম্ভবত দ এর অনুশীলনের যে শুরু তা বুঝেই কান্না। শিশু হাঁটার আগে হামাগুড়ি। ব্যথার শুরু তখন থেকে, তবে তা শারীরিক। স্কুলে পড়া না পারলে শৈশব কৈশোরে কান ধরে হাঁটু ভেঙে দাঁড়িয়ে শাস্তি মানে ‘দ’ হয়ে যাও।এইতো শুরু ‘দ’ এর অনুশীলন। তারুণ্যে বয়সের যা ধর্ম, যদি কাউকে ভালোলাগে, নিবেদনে তরুণকে হাঁটু ভেঙে বলতে হয়-‘ভালবাসি বা আমাকে বিয়ে করবে?’ তবে বিয়ের পরে তরুণীকেই ‘দ’ এর অনুশীলনে বেশি। আমার ক্ষেত্রে আঠারোতে বিয়ে। হায়! নতুন নতুন যে আসেন তাঁকেই সালাম করো পা ধরে। মানে ‘দ’ হয়ে যাও। কিন্তু সময়ের প্রবাহে স্বামীকেই বেশি ‘দ’ হতে হয়।
চাকরি জীবন মানেই ‘দ’ হয়ে থাকা। আপনি বস! আরে বাবা! বস এর উপরে ও কতো যে বস। অতএব! মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
একসময়ে দাস প্রথা ছিল। দাসদের পায়ে শেকল। কাজের সময়ে খুলে দিলেও রাতে আবারও শয়ে শয়ে দাসের এক ছোট্ট বদ্ধ রুমে।হাত পা ছড়িয়ে ঘুমানোর উপায় নেই। গাদাগাদি হয়ে দ হয়ে থাকা। কারাগারের দন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ও একই অবস্থা। একটা সময়ে ব্রিটিশ শাসনামলে পরাধীন জাতিদের অবস্থা দ এর মতো তবে বিভিন্ন সময়ে কেউ কেউ উন্নত মম শির হয়ে বিদ্রোহ করলে সোজা পৃথিবীর ওপারে।
অবশেষে এলো স্বাধীনতা। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান। বাঙালির সাথে পাকিস্তানিদের একমাত্র ধর্ম ছাড়া কোন মিল নেই। আঘাত এলো ভাষা ও সংস্কৃতির উপরে একই সাথে অর্থনৈতিক শোষণ।অতঃপর দ এর আবরণ থেকে বেরিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা আনলো বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর অনেক সাহসী ও অনমনীয় পদক্ষেপে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত এবং পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট আমরা হারালাম পিতাকে।এলো এক অন্ধকার যুগ। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে হতে হল ‘দ’। বিরোধী চক্রের কি দাপট! এলো স্বৈরশাসক। আবারও সংগ্রাম ও রক্তের বিনিময়ে গণতন্ত্রের পুননির্মাণ। কিন্তু হায়! দ এর অনুশীলনে প্রভাবশালীদের কাছে আবারও সমর্পিত হওয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন -শিক্ষকের পায়ের নিচে বসবেন রাজনীতিবিদরা। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আবুল ফজলকে তিনি অনুরোধ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে বসালেন।
সেইদিন হয়েছে গত।এখন উচ্চপদে বসতে গিয়ে তথাকথিত কিছু উচ্চ শিক্ষিতজনদের কি মাথানতের দৃষ্টান্ত। রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার কাছে কতোবার যে ‘দ’ হয়ে যাচ্ছেন। এমনকি সাবেক উপাচার্যের একজনের পায়ে হাত দিয়ে সালাম! কা’কে? একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার কাছে ‘দ’ হয়ে যাওয়া।
আবার কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে গভর্নিং বডির সভাপতি যিনি রাজনৈতিক নেতা, তাঁর কাছে যেমন আবার অনেক সময় ছাত্রনামধারী কিছু অছাত্রের চাঁদাবাজি বা টেন্ডারবাজির কাছেও নত হতে হয়।
আবার দেখুন! নিম্ন বা মধ্যবিত্ত ভোক্তাদের কি অবর্ণনীয় অবস্থা। কিছু ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের কাছে কেমন দ হয়ে থাকা।
হায়! এই একুশ শতকেও বর্ণমালা দ এর অনুশীলনে মনে হয় সততার সাথে জীবনযাপনে ‘দ’ কোথায় যেন লুকিয়ে আছে।
নদীর স্রোত চলতে চলতে একটু বৈচিত্র্য আনতে নিজেই একটা দ সৃষ্টি করে। জগতের নিয়মেও আমরাও মাঝে মধ্যে দুই একটা দ সৃষ্টি করে জটিলতায় জড়িয়ে যায়, ঘুরপাক খেতে খেতে একসময় ছাড়িয়ে নিয়ে চলতে থাকি। হায়– বর্ণমালা ‘দ’।