ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পুরুষের সাথে নবজাগ্রত নারীদের গৌরবময় অংশীদারিত্ব ছিল। বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে স্ত্রী শিক্ষা সম্পর্কে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও কুসংস্কার ধীরে ধীরে অপসৃত হওয়ার সাথে সাথে নারী প্রগতি বিস্তার লাভ করে এবং নারী সমাজ সচেতন হয়ে উঠে। এসব প্রগতিবাদী নারীদের মধ্য থেকে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র প্রকাশিত হয় রাজনৈতিক গগনেও। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে নারীরা নিজেদের কিভাবে বিকশিত করে তুলেছিলেন তা গভীর ও তাৎপর্যমন্ডিত। যদিও ইতিহাসে বর্ণিত বড় বড় ঘটনার দাপটে চিরকালই চাপা থেকেছে নারীদের প্রকৃত অংশগ্রহণের বিষয়টি। যেভাবে লেখা হয়েছে পুরুষের বীরত্ব গাঁথা আত্মত্যাগ ও কৃতিত্বময় জীবন যাপনের চিত্র সে তুলনায় পুরুষদের দাপটে আড়াল হয়ে গেছে নারীর কৃতিময় গৌরবাম্বিত কর্মসমূহ। বাঙালি নারীর ইতিহাস এক্ষেত্রে আরো বেশি উপেক্ষিত। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নারী সংগঠক মণি কুন্ডলা সেনের মন্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য “ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ বিশে^র যে কোন মুক্তি সংগ্রামের চেয়ে ব্যাপক। কংগ্রেসি ঐতিহাসিকরা এই অংশগ্রহণকে তুলে ধরেননি ॥” যে কারণে স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের নাম তেমন ভাবে উঠে আসেনি। যারা ছিলেন কাছাকাছি বা দৃষ্টিসীমার মধ্যে দৃষ্টি নেপথ্যে যারা। সমাজের জীবন প্রবাহে —— তাঁরা অখ্যাত, অনামী,” ।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মাষ্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে যুব বিদ্রোহ স্ফুলিঙ্গের ন্যায় ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়কে আলোকিত করেছে। ব্রিটিশ বিরোধী স্বসস্ত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের গৌরবময় উপস্থিতিতি লক্ষ্যনীয়। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা যোশী, নেলী সেনগুপ্তা, ইন্দুমতি সিংহ সহ অনেকের সরব উপস্থিতি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নারীদেরকে করেছে গৌরবদীপ্ত।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তীতে সামাজিক আন্দোলন সহ জীবন সংগ্রামে যারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম শিশিরকণা গুহ ওরফে শবনম খান শেরওয়ানী।
পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে যুগে যুগে এগিয়ে আসা নাম জানা ও অজানা অনেকে ইতিহাসে তাদের স্থান করে নিয়েছেন। কিন্তু শবনম খানের ন্যায় অসংখ্য নাম বিস্মৃতির অন্তরালে এবং ইতিহাসের পাতায় এবং গবেষকদের প্রাপ্ত তথ্যের বাইরে রয়ে গেছে।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন সংগ্রামী নারী স্ফুলিঙ্গের মতোই বিকশিত নানা গুণে গুণাম্বিত, মহীয়সী এক নারীর নাম হলো শিশিরকণা গুহ বা শবনম খান শেরওয়ানী।
অনেক ঐতিহাসিক লোকমান খান শেরওয়ানীর ব্যক্তিত্বের আড়ালে শবনম খান শেরওয়ানীকে হারিয়ে যেতে দিতে উৎসাহিত। কিন্তু আমার মতে, শবনম খান শেরওয়ানী নিজস্ব যোগ্যতা, দক্ষতা, মেধা ও যোগ্যতার নিরিখে স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরী করে নিয়েছেন। সে হিসেবে আমি আমার নিজস্ব চিন্তা চেতনায় শবনম খান শেরওয়ানীর আলাদা বৈশিষ্ট্য ও চেতনাকে সামনে নিয়ে তাঁকে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছি। লোকমান খান শেরওয়ানীকে নিয়ে লিখতে গিয়ে তথ্য উপাত্ত নিয়ে খুবই হিমসিম খতে হয়েছে। লোকমান খান শেরওয়ানীর পরিবার বিশেষ করে আমেরিকা প্রবাসী মেয়ের জামাই আসাদ ভাই এবং ছোট ছেলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ্ ড. বদরুল হুদা খানের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং তথ্যে সংগ্রহের বিষয়ে সহযোগিতা আমাকে এবিষয়ে লোকমান খান শেরওয়ানীর বিষয়ে লিখতে আগ্রহী হয়ে লিখতে পেরেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের নিকট ঋণি। লোকমান খান শেরওয়ানর বিষয়ে লিখতে গিয়ে জানা যায় বিপ্লবী শিশিরকণা গুহ বা শবনম শেরওয়ানীর কথা। লোকমান খান শেরওয়ানীর স্ত্রী বিপ্লবী শিশিরকণা গুহের বিষয়ে তথ্য নির্ভর তত্ব ও তথ্য পাওয়ার আরো কষ্টকর। এ বিষয়ে অসাধ্য সাধনের চেষ্টা করেছেন শিক্ষাবিদ্ গবেষক ড. আনোয়ারা আলম। আনোয়ারা আলমের তথ্য ও তত্ব হতে সহযোগিতা নিয়ে চেষ্টা করেছি শিশিরকণা গুহকে কিছু লেখার।
শিশিরকণা গুহ বা শবনম খান শেরওয়ানীর জন্ম সালের সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও ধারণা করা যায় তিনি ১৯১৫ বা ১৯১৬ এর দিকে জন্মগ্রহণ করেন। সময়টা ছিল বিশে^র এবং ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে রূপান্তরকল। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ, রুশ বিপ্লব বা বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কার, সাহিত্য সংস্কৃতিতে নব দিগন্তের ছোয়ার হাতছানি, স্বদেশী আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ রদ সব মিলিয়ে রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মহা পরিবর্তনের এক বৈপ্লবিক পরিবেশ।
অভিজাত পরিবারে জন্ম শিশিরকণা গুহের পিতার নাম-রজনীকান্ত গুহ এবং মা- মোনরমা গুহ। বরিশালের রজনীকান্ত গুহ আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা। বংশ পরিচয়ে তাঁরা খুবই উচ্চ বংশীয় ও শিক্ষিত পরিবার। শিশিরকণা ঐতিহ্যগতভাবে পিতা ও মাতার আভিজাত্যময় অতীতকে লালন ও ধারণ করেছেন।
শিশিরের জন্ম সম্ভবত নানার বাড়ি বিক্রমপুরের কাজীর পাগলা গ্রামে। শৈশব কেটেছে পদ্মা নদীর তীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্নিগ্ধ পরিবেশে। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের লালখান বাজারের চানমারি লেইনে নিজস্ব ভবনে বেড়ে উঠা শিশির কণা ডা. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। এ স্কুল হতে তিনি মেট্রিক পাশ করেন। সাথে সাথে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত, “চট্টগ্রাম আর্য্য সংগীত একাডেমিতে” সুরেন্দ্রনাথ দাসের নিকট সংগীতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী ছিলেন বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্ত সহ আরো অনেকে। স্বল্প সময়ে এখানে শবনমের প্রতিভার বিকাশ ঘটে। প্রতিভাময়ী শিশিরের সাথে এখানে বিপ্লবী কল্পনা দত্তের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। প্রীতিলতা এবং কল্পনা দত্ত ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা মাষ্টারদা সূর্যসেনের শিষ্য এবং বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃত্ত। দুই অগ্রজ বান্ধবীর অনুপ্রেরণায় এবং বড় দুই ভাই বিপ্লবী সরোজগুহ এবং এস. কে গুহ (মন্টু গুহ) এর মৌন সমর্থনে জড়িয়ে পরেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। ডা. খাস্তগীর স্কুলের ছাত্রী এবং আর্য্য সংগীতের ছাত্রী হিসেবে রাজনীতির সাথে সম্পৃত্ততার কারণে প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্তের সাথে বিভিন্ন সভা সমিতিতে গোপন ও প্রকাশ্যে রাজনীতিক কর্মকাণ্ডে যোগদেয়া শুরু হয়।
বিভিন্ন গোপন সভায় অংশগ্রহণ ও যাতায়তের কারণে ১৯২৯-৩০ এর দিকে কল্পনা দত্তের সাথে পাঠানঠুলীর খান বাড়িতে দেখা হয় সে সময়কালের রাজনৈতিক নেতা ও অত্যান্ত সুদর্শন সুপুরুষ লোকমান খান শেরওয়ানীর সাথে। যেমন চেহারা তেমনি গৌরদীপ্ত কন্ঠস্বর। ধীরে ধীরে পরিচয়ের দীর্ঘসূত্রিতা মুখ্যত রাজনৈতিক ভাবাদর্শে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বৈপ্লবিক আদর্শে। রাজনৈতিক ভাবাদর্শের পাশাপাশি সুদর্শন লোকমান খানের সাথে শিশির কণার নিবিড় ঘনিষ্টতা জন্মে যা পরবর্তীতে প্রণয়ের দিকে রুপ নেয়। প্রকৃত অর্থে শিশির কণার পরিবার ছিল উদার ও সংস্কতিবান ও মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির অধকারী। সে কারণে শিশির কণার পরিবার এ মেলামেশার ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
১৯৩২ এর ২৩ শে সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ এবং পটাশিয়াম সায়নাইডাইড খেয়ে তাঁর আত্মবিসর্জনের পর ব্রিটিশ বাহিনীর চিরুনি অভিযান শুরু হয়। চারিদিকে ধরপাক চলতে থাকে। যেহেতু প্রীতিলতার সাথে শিশির কণার আন্তরিক সম্পর্ক ছিল সে কারণে ধরপাক হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য এ পরিস্থিতিতে শিশির কণাকে তাঁর এক আত্মীয়ের তত্ত্বাবধানে পাঠিয়ে দেয়া হয় বি.এম কলেজে। সেখান হতে কলিকাতার শান্তি নিকেতনে কিছু দিন সংস্কৃত বিষয়ে নিয়ে লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে কলিকাতা হতে তিনি এম.এ বিটি ডিগ্রী লাভ করেন।
চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহের অনুপ্রেরণা এবং প্রীতিলতার আত্মহুতি থেকে রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে কলকাতায় শিশির কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। সে সময়ে তিনি কংগ্রেসের মহিলা শাখার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। এ সময়ে লোকমান খান শেরওয়ানির আদর্শে তিনি মহাত্মা গান্ধীর একান্ত অনুসারী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৩৯ এ শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ। ৩ মে ১৯৩৯ কলকাতার সদানন্দ পার্কে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় কংগ্রেসের মধ্যে “ফরোয়ার্ড ব্লক” নামে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের সূচনা হয়।
১৯৩৮ সালে লোকমান খান ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির সংস্পর্শে আসে এবং বামপন্থি প্রগতিশীল ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নবগঠিত ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগ দেন। লোকমান খান এবং শিশির দু’জনেই কংগ্রেসের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। শিশির কংগ্রেসের আদর্শে মহাত্মা গান্ধীর অনুসারি হিসেবে আশ্রমের সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৩৯ সালে লোকমান খান এবং শিশিরকণা দু’জনাই সক্রিয় সদস্য হিসেবে ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগদেন।
১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ সরকার নেতাজি সুভাষ বসুর রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধকালীন সময়ে বামপন্থি রাজনৈতিক দলের পক্ষে কাজ করার অভিযোগে এবং নেতাজি সুভাষ বসুর সাথে রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে ইংরেজ সরকার লোকমান খান শেরওয়ানীকে বন্দি করে কারাগারে প্রেরণ করেন। প্রথমে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে এবং পরবর্তীতে কলিকাতায় দম দম সেন্ট্রাল জেলে তাঁকে প্রেরণ করা হয়। কলিকাতার দম দম সেন্ট্রাল জেলে ১৯৪৪ এর দিকে কলিকাতায় অবস্থানকারী ভিন্ন ধর্মালম্বী কিন্তু একই আদর্শের ও একই পথের মনমানষিকতায় দুটি মনের মিল থাকায় কারাগারের ইমামের উপস্থিতিতে শিশিরকণার সাথে লোকমান খানের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর শিশিরকণা গুহ তাঁর নাম পরিবর্তন করে নাম রাখেন শবনম খান শেরওয়ানী।
কারাগার জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে কলকাতার কর্পোরেশন ট্রীটের এক অভিজাত এলাকায় তাঁদের যৌথ জীবনের সূচনা হয়। কলকাতায় মেট্রো গ্যারেজ নামে গাড়ীর ব্যবসা ও বিভিন্ন ব্যবসার সাথে লোকমান খান জড়িত হয়ে পড়েন এবং একজন প্রতিষ্ঠিত ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও চেম্বার অব কমার্সের সাথে যুক্ত হয়ে একটি সুখী পরিবার হিসেবে কলকাতার সুখী জীবন অতিবাহিত করেন। কিন্তু ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পূর্বে ভারতবর্ষ ও তৎকালীন বাংলাদেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার এক বিভীষিকা পরিবেশ সৃষ্টি হয়। অনেকে ধনাঢ্য ব্যক্তি রিক্ত হস্ত ও কর্কদকহীন হয়ে পড়েন। সর্বশান্ত হয়ে অনেকে কলিকাতা ত্যাগ করেন। বিভিষিকাময় সে দাঙ্গায় লোকমান খান শেরওয়ানী সপরিবারে কর্পদকহীন অবস্থায় স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে কলকাতা হতে পূর্ববঙ্গে বা চট্টগ্রামে চলে আসেন। অভিজাত এলাকায় এবং সম্পদের প্রাচুর্যে ও সম্মানে বেড়ে উঠা ভিন্ন ধর্মের এক নারী পরবর্তীতে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে একেবারে রক্ষণশীল একটি পরিবারে এসে কপর্দকহীন স্বামীর সাথে শুরু করেন সংগ্রামের আরেক নতুন অধ্যায়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সংগ্রামী নারী শবনমের জন্য এ নতুন পরিবেশ ও সময় খুবই কঠিন সময়।
রাজনৈতিক জীবনের সংগ্রামী যুদ্ধের ন্যায় তিনি এ কঠিন সময়কে মেনে নিয়ে দৃঢ়তার সাথে সংসার যুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ করেছেন। চট্টগ্রামের নিকটা আত্মীয়স্বজন সকলের অসহযোগিতা, সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করে অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দেয়া একটি অসহায় পরিবারকে আগলে রেখে সংগ্রাম করে টিকে থাকা সত্যি অবাক করার মতো।
দেশ ভাগের পর স্বাধীন পাকিস্তানে লোকমান খান মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃত্ত হয়ে পড়েন। সে সময়ে মুসলিম লীগের পূর্ব বাংলা বিদ্বেষী এবং রাষ্ট্র ভাষা বিরোধী অবস্থানের কারণে সক্রিয় রাজনীতি হতে তিনি নিজেকে আস্তে আস্তে গুঠিয়ে নেন। ১৯৬৪ সালে লোকমান খান মুসলিম লীগ কর্মীদের আয়োজিত এক সম্মেলন থেকে বাড়িতে ফিরে আসার সময় মুসাফির খানা ভবনের মুসলিম লীগ অফিসের সামনের রাস্তার ওপর এক মোটর দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন এবং পায়ের হাড় দুই টুকরো হয়ে ভেঙ্গে যায়। মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণে দৃষ্টি শক্তিও কমে যায়। পরবর্তীতে অপারেশন হলেও বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় তিনি আর সুস্থ হয়ে উঠেন নি। দীর্ঘ পাঁচ বছরের পঙ্গু জীবনে চরম আর্থিক সংকট ও চিকিৎসা ও পথ্যের অভাব এবং সংসারে সন্তানদের লেখাপড়া সহ বিশাল এ দূঃসময়ে একাকি জীবন সংগ্রামে শবনম সংগ্রাম করে গেছেন। রাষ্ট্র ও সমাজের এবং আত্মীয় স্বজনের অনাদর ও অবহেলার মাঝে ১৯৬৯ এর ২৭ আগষ্ট মহান বিপ্লবী লোকমান খান শেরওয়ানী নিষ্ঠুর পৃথিবী হতে চিরবিদায় নেন।
স্বামীর মৃত্যু পরবর্তী জীবনে শবনমের নতুন এক বিস্ময়কর জীবন শুরু হয়। শুরু হয় জীবন যুদ্ধে ঠিকে থাকার সংগ্রাম। বিবাহ পরবর্তী জীবনে অতিবাহিত করেছিলেন সুখী ও রাজকীয় জীবন। সে সময় থাকতেন কলকাতার অভিজাত এলাকায়। স্বামীর ছিল ব্যবসা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে ছিল বিশাল কারবার। যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের সাথে। ১৯৪৬ এর দাঙ্গায় সব হারিয়ে কর্মদকশুন্য এবং ১৯৬৯ এর পর হারালেন সবকিছু।
শবনম পারিবারিক ও অর্থের প্রয়োজনে শিক্ষকতা করেছেন এবং লেখালেখির ভূবনে ছিলেন খুবই আন্তরিক। একজন বিপ্লবী নারী সর্বগুণে গুণান্বিত এবং নিরন্তর জীবিকার সংগ্রামে ব্যস্ততার সময়ে তিনি লিখতেন গল্প, রাজনৈতিক জীবন এবং সমাজের অসংগতি নিয়ে আব্দুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সম্পাদিত সাপ্তাহিক কোহিনুর পত্রিকার সহ সম্পাদক ও পরবর্তীতে সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। প্রচুর লিখেছেন। তিনি আকাশবাণী কলকাতায় তালিকাভূক্ত একজন সংগীত শিল্পী ও গীতিকার হিসেবে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে রেডিও পাকিস্তান চট্টগ্রামের একজন নিয়মিত কথক হিসেবে কাজ করেছেন। সুন্দর বাচনভঙ্গী ও কন্ঠস্বরের জন্য তিনি রেডিওতে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেন।
স্বামী লোকমান খান নিজে একজন সৌখিন হোমিও চিকিৎসক ছিলেন। হোমিও চিকিৎসা শাস্ত্র শবনম নিজ উদ্যোগে আয়ত্ত করে নেন। পরবর্র্তীতে নৈশকালীন কোর্সে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় উচ্চতর ডিগ্রি নেন এবং হোমিও চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে শবনমের প্রতিভার উপস্থিতি থাকলেও তথ্য তত্বের অভাবে বা সংরক্ষিত না হওয়ার কারণে অনেক তথ্য হারিয়ে গেছে। এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, তিনি এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব ও মহিয়সী নারী ছিলেন। ১৯৪৭ হতে ১৯৬৪ পর্যন্ত স্বামী সন্তান নিয়ে এককভাবে পারিবারিক জীবনে এর প্রতিটি ক্ষেত্রে আত্মত্যাগ ও আর মর্যদার লড়াইয়ে সংগ্রামে একজন অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধা। শুধু স্ত্রী নন একজন মা হিসেবেও তিনি জীবন সংগ্রামের একজন সফল যোদ্ধা।
নিজ গুণে ও কর্মপদ্ধতিতে তিনি সকলকে আপন করে নেয়ার চেষ্টা করেছেন সব সময়। আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশি সবার কাছে তিনি একান্ত আপনজন ও পরামর্শদাতা ছিলেন। পাড়ার ছেলে মেয়েরা ছুটির দিনে তার সুন্দর উচ্চারণের কথা শুনার জন্য ভীর করে তাঁর কাছে আসতো। তিনি আরবী পড়তেন বাংলায়। মুসলিম আচার অনুষ্ঠান, নামাজ দোয়া নিপুনভাবে সমাধা করতেন। একই সাথে সংসার, শিক্ষকতা, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, রেডিওতে কথক হিসেবে পা-ুলিপি রচনা ও অংশগ্রহণ এবং অসুস্থ স্বামীর সেবা ঠিক যেন সর্ব্ব হারিয়ে দূর্গাদেবীর মতো দায়িত্ব পালন করেছেন সুচারুভাবে যা ছিল এক পরম বিস্ময়ের।
একজন রত্মগর্ভা মা হিসেবে তিনি তার ছেলে মেয়েকে গড়ে তুলেছেন। তাদের অনেকেই আজ স্বমহীমায় উদ্ভাসিত। ছোট্ট ছেলে ড. বদরুল হুদা খান আজ ই-লার্নিং জনক হিসেবে সারা বিশ্বে খ্যাতিমান।
চট্টগ্রাম একাডেমি তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব নিয়ে প্রবর্তণ করেছেন “লোকমান খান শেরওয়ানী সাংবাদিকতা পুরস্কার এবং শবনম খান শেরওয়ানী শিক্ষা বৃত্তি।
আজকে আধুনিক শিক্ষিত মহিলাদের জন্য শিশিরকণা (শবনম খান) একটি আদর্শের নাম। প্রতিকূল সময় ও সমাজের মধ্য দিয়ে শবনমের জন্ম। বৈপ্লবিক আদর্শ ও দেশপ্রেম সত্যনিষ্ঠ ও সততা পরোপকারীতা দায়িত্ববোধ স্বচ্ছতায় ও আদর্শে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে গড়ে নিয়েছেন। বাক সংগ্রাম ও ন¤্রতা, মধুর ব্যবহারে সকলের প্রিয়জন শবনম খানের, ধৈর্য্যশীলতা, বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতা সবকিছু হলো তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অসাধারণ একজন প্রেমিক ও স্ত্রী হিসেবে হয়েছেন আদর্শ। যা অনন্য ও অনুকরণীয়। ভিন্ন এক সংস্কৃতির আবহ থেকে একেবারে চট্টগ্রামের স্থানীয় অধিবাসীদের যে ভিন্ন সংস্কৃতি, আচার আচরণে বা বিভিন্ন নিয়ম কানুন তা তিনি নিবিড়ভাবে অনুশীলন ও অনুধাবন শুধু নয় রপ্ত করেছেন গভীরভাবে।
একেবারে অভিজাত পরিবার ও সংস্কৃতি পরিবেশে বেড়ে উঠা বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে জড়িত বিধুষী সংগ্রামী নারী তাঁর পুরো জীবন বিশাল মহাসাগরের বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো গড়ে তুলেছেন। জীবন সংগ্রামের ও জীবন যুদ্ধের মহান সংগ্রামী জীবন যুদ্ধে বিজয়ী সৈনিক শবনম খান শেরওয়ানী। আমাদের গর্বের স্থান অসাধারণ গুণবতী ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব শবনম খান শেরওয়ানী ১৯৮৪ এর ৬এপ্রিল দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের ইতি টেনে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমাদের প্রজন্মের জন্য শবনম খান শেরওয়ানী বা শিশিরকণা গুহের সংগ্রামী জীবন হতে অনেক অনেক কিছু শিখার ও জানার রয়েছে।
প্রজন্ম তাঁর জীবনকে আদর্শ হিসেবে বেছে নেয়া প্রয়োজন। আমাদের ক্ষুদ্রতম প্রচেষ্টায় চেষ্টা করেছি প্রজন্মকে বিপ্লবী শবনমের বনাঢ্য জীবনকে জানানোর। আমি বিপ্লবী শিশিরকণা গুহ ওরফে শবনম খান শেরওয়ানীর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং তাঁর কর্মময় জীবনকে আরো বৃহত্তর পরিসরে তুলে আনার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।