প্রাণের নদী কর্ণফুলি
আবুল কালাম বেলাল
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। তাই স্বাভাবিক- প্রত্যেক বাঙালির নিজের করে প্রিয় একটি নদী থাকবে। এবং আছেও। কারও পদ্মা, কারও মেঘনা, কারও বা যমুনা, কপোতাক্ষ, ধানসিঁড়ি, তিতাস প্রভৃতি। আমাদেরও একটি নদী আছে। যার নাম কর্ণফুলি। এ নদী প্রাণসঞ্চারী। প্রাণের এ নদী সর্পিল ঢংয়ে- আপন গতিতে নিরন্তর বয়ে চলছে ইতিহাস-ঐতিহ্যবাহী স্মৃতি রচে রচে। জোয়ার-ভাটায় ঢেউয়ের ফুলকি ধারায় প্রতিনিয়ত বিম্বিত করে ছুটছে অগণিত চিত্ররূপ দেখিয়ে কর্ণফুলি। এ নদী এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দিন-রাত পার করছে বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামের বণিকসম্প্রদায় বিকিকিনির খেলা। শশব্যস্ত রাখা নাগরিক মানুষের প্রাণস্পন্দন এ কর্ণফুলি দেশের প্রধান প্রধান নদীগুলোর অন্যতম। এ নদী কেবল আমাদের (চট্টলবাসীর) নয়, দেশের প্রিয় নদীও বটে। হাজার বছরের নদী, হাজার সুখস্মৃতি, দুঃখগাথার নদী-কর্ণফুলি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ সঞ্চালক যেমন, সংস্কৃতির আধার, সামাজিকতার জলধিও।


কর্ণফুলির উৎপত্তি : কর্ণফুলি চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদীও বটে। এর উৎপত্তি ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লুসাই পাহাড় থেকে। উৎস থেকে ১৮০ কিমি. পার্বত্যপথ অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরের সাথে এসে মিশেছে প্রাণে প্রাণে। কর্ণফুলি রাঙ্গামাটিতে এসে একটি দীর্ঘ ও সংকীর্ণ রূপ পরিগ্রহ করে। এরপর আঁকাবাঁকা গতিপথে ধুলিয়াছড়ি ও কাপ্তাইয়ে অপর দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত হয়েছে। রাঙামাটি ও ধুলিয়াছড়ি শাখা দুটি বর্তমানে ‘কাপ্তাই লেক’ এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর জলবিদ্যুৎ বাঁধটি কাপ্তাই শাখার ভিতরে নদী প্রবেশের ঠিক আগে অবস্থিত। কাপ্তাই শাখা থেকে বের হয়ে কর্ণফুলি নদী সীতাপাহাড়ের ভিতর দিয়ে আঁকাবাঁকা গতিপথে চন্দ্রঘোণায় পাহাড়িয়া অঞ্চলকে অতিক্রম করে সমভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এভাবে কর্ণফুলি চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বরকল, গোবামুরা, চিলারডাক, সীতা-পাহাড় ও পটিয়ার পাহাড়িয়া অঞ্চল অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরের সাথে এসে মিশেছে। কর্ণফুলির প্রধান শাখা নদীসমূহ হচ্ছে ডান তীরে-কাসালং, চেঙ্গী, হালদা ও ধরং এবং বাম তীরে সুভলং, কাপ্তাই, রাইন-খিয়াং ও খেগা।
নদীর নামকরণ : কর্ণফুলি নদীর নামকরণের পেছনে একটি প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে। চট্টগ্রামের এক উপজাতি রাজকুমারের প্রেমে আসক্ত হন আরাকানের রাজকুমারী। কোন এক পূর্ণিমা রাতে তাঁরা কর্ণফুলিতে যান নৌবিহারে। পূর্ণিমার জ্যোৎøায় নদীর তরঙ্গমালা শতধা বিভক্ত হয়ে তখন সৃষ্টি করেছিল এক অনুপম, অপার্থিব নৈসর্গিক শোভা। আবেগবিহ্বল রাজকুমারী নদীর পানিতে ঝুঁকে উপভোগ করছিলেন সেই সৌন্দর্য। কিন্তু হঠাৎ তাঁর কানের ওপরে রাজকুমারের গুঁজে দেয়া ফুল নদীর পানিতে পড়ে যায়। রাজকুমারের দেয়া প্রেমের অর্ঘ্য উদ্ধার করতে গিয়ে রাজকুমারী পড়ে যান নদীতে। খরস্রোতা পানির টানে ভেসে যেতে থাকেন রাজকুমারী। রাজকুমারও তৎক্ষণাৎ তাঁকে উদ্ধারের জন্য নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাজকুমারীকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করতে না পেরে মনের দুঃখে রাজকুমারও নদীর জলে আত্মাহুতি দেন। সেই বিয়োগান্তক ঘটনার স্মরণে নদীটির নামকরণ হয় ‘কর্ণফুলি’-এর অর্থ দাঁড়ায় কানের ফুল। তবে মারমা উপজাতি গোষ্ঠীর কাছে নদীটি ‘কিনসা খিয়ং’ নামে পরিচিত।
ঐতিহাসিক পটভূমি ও গুরুত্ব : কর্ণফুলির ইতিহাস দশ হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে প্রবাহিত হয় বলে ধারণা করা হয়। কর্ণফুলির তলদেশের মাটি ও পার্বত্য এলাকার টারশিয়ারী যুগের মাটির মতোই গঠিত বলে ভূতত্ত্ব গবেষণায় প্রমাণিত।
গ্রিক ভৌগোলিক টলেমির উল্লিখিত ‘কেটাবেড়া’ নদীকে প-িত ম্যাকক্রি-ল তার এন্সিয়েন্ট ই-িয়া এস ডেসক্রাইবড বা টলেমি গ্রন্থে কর্ণফুলি নদী বলে চিহ্নিত করেছেন। হিন্দুমতে কর্ণফুলির অপর নাম ‘কাঞ্চি’। কর্ণফুলি একটি পুণ্যতোয়া নদী। এর উৎপত্তিস্থলে নীল পর্বতমালায় নীল কণ্ঠেশ্বর শিব আছেন। একটি ছড়ায় তার প্রমাণও পাওয়া যায়। ‘গঙ্গাদেবী থাকেন যেমন শিবের জটায়;/লুসাই দেবীর খোঁপায় থাকে কর্ণফুলি’ (উত্তম সেন)
ভবিষ্য পুরাণ, ব্রহ্মখ-, চতুর্দশ অধ্যায়ে উল্লেখ আছে,
‘কর্ণফুলী নদীর øান মাত্রেন প্রাণিনাং/বিকাশতে কর্মতেজো বর্দ্ধতে চ দিনে দিনে/কার্তিকে কর্ণফুলায়ং মজ্জবিদ্যান্তি যে জনাঃ/ব্রহ্ম হত্যাষুতা বাপি ষাস্যান্তি সুকৃতাং পদং।’
চট্টগ্রাম শহরের সুলক আল বহর বা সুলকবহর, বাহার সিগন্যাল, চ্যাহেলে শহর বা ষোলশহর, হাওয়ালে শহর বা হালিশহরসহ কয়েকটি স্থান কর্ণফুলি নদী ও চট্টগ্রাম বন্দরের ঐতিহ্যবাহী স্মৃতি ও কর্ণফুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব প্রমাণ করে।
কালের সাক্ষী : কর্ণফুলি আমাদের বাস্তবের সঙ্গী, আনন্দ-বেদনার সাথি। এ নদী শহর ও গ্রাম দুইকে করেছে মেলবন্ধন। এর দুপাড়েই আমাদের বসত। এ নদী কালের নীরব সাক্ষী। তার বুকে জমা আছে কত হাজার লক্ষ ঘটনা, ইতিহাস। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সংঘটিত অপারেশন জ্যাকপট-এর স্মৃতিবাহী বীরত্বগাথাসহ আরো কত কী! এসব অনন্য ভূমিকা ও অনেক মর্মস্পর্শী স্মৃতিকাহিনী বুকে ধারণ করে কর্ণফুলি আজো স্বতন্ত্রবৈশিষ্ট্যে জোয়ার-ভাটায় চপলা চঞ্চলা।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব : দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার অন্যতম সুর কর্ণফুলির ভূমিকা অপরিসীম। এর রয়েছে একদিকে নান্দনিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য; অন্যদিকে তার দুতীরে গড়ে উঠেছে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র, ইপিজেড, জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, সিমেন্ট কারখানাসহ অসংখ্য দেশি-বিদেশি ভারী শিল্প কারখানা। নদীর উজানে রয়েছে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিকলবাহা পিকিং বিদ্যুৎ কেন্দ্র, চট্টগ্রাম মহানগরীর পানির চাহিদাপূরণ, মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্প, ইউরিয়া সার ফ্যাক্টরী, পাশের হালদায় মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রসহ ক্ষুদ্র-মাঝারী-বড় বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান। জাতীয় আয়ের সিংহভাগ যোগান দেয় এ নদীতে গড়ে ওঠা বন্দর। তার পাশাপাশি বিশাল অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এ নদীর তীরে গড়ে ওঠা খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, আছাদগঞ্জও রক্ষা করে চলেছে ব্যবসায়িক ঐতিহ্য।
পর্যটন শিল্পে কর্ণফুলি : পর্যটন শিল্পে কর্ণফুলির অবদান উল্লেখযোগ্য। নদীর মোহনায় পারকি বীচ, শহরের প্রান্তে নতুন করে গড়ে ওঠা মেরিনার্স পার্ক, সাম্পানবিহার, নৌভ্রমণ, উজানে কাপ্তাই হ্রদ, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান, জুম রেস্তোরাঁ, কাপ্তাই ন্যাশনাল পার্ক, কাপ্তাই লেক প্যারাডাইস, রাজবন বিহার, রাঙ্গামাটি মোটেল ও ঝুলন্ত সেতু, জলপ্রপাত ও পাহাড়ি ঝর্না, ডিসির বাংলো, চিরিঙা আইল্যান্ডসহ অন্যান্য পর্যটন স্পট বিশেষ ভূমিকা রাখছে। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা পরিদর্শনে আসছে। আহরিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রাও।
সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কর্ণফুলি : সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও সমুজ্জ্বল কর্ণফুলি। এর রূপ-বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যে মাতাল হয়েছেন আমাদের শিল্পী, কবি, সাহিত্যিকরা। আমাদের ছড়া-কবিতা-গানে, গল্পে, উপন্যাসে, চলচ্চিত্রে, নাটকে প্রবলভাবে প্রবাহিত এ নদীর স্রোতধারা। কর্ণফুলিকে কিংবদন্তি করে রেখেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর পঙক্তিমালায় : ‘ওগো কর্ণফুলি/তোমার সলিলে পড়েছিল কার/কানফুল খুলি’। চট্টগ্রামসহ দেশের স্বনামধন্য কবি-সাহিত্যিকের লেখায়-রেখায় নানাভাবে, নানারূপে কর্ণফুলি চিত্রিত হয়েছে। খ্যাতিমান সঙ্গীতজ্ঞ মলয় ঘোষ দস্তিদারের অমরসৃষ্টি : ‘ছোড ছোড ঢেউ তুলি/লুসাই পাহাড়ত্তুন লামিয়ারে/যারগই কর্ণফুলি’। কবিয়াল রমেশ শীল, মোহাম্মদ নাসির, আবদুল গফুর হালী, শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব, শেফালী ঘোষ, সনজিত আচার্য, কল্যাণী ঘোষসহ অনেকের কণ্ঠে আঞ্চলিক ও আধুনিক গানে কর্ণফুলি গীত হয়েছে এবং হচ্ছে। ভেলুয়া সুন্দরী, কাফেন চোরা, নুরুন্নেছা কবরের কথা, কমল সদাগরের পালা, নছর মালুমসহ বহু প্রাচীন পুঁথিসাহিত্যে কর্ণফুলির বর্ণনা-শোভাবৈচিত্র্য উঠে এসেছে। ‘সাম্পানওয়ালা’ চলচ্চিত্রে জীবন্ত হয়ে রয়েছে কর্ণফুলি। এখনও আধুনিক শিল্প-সাহিত্যে কর্ণফুলি প্রভাববিস্তারি ভূমিকায় বিচিত্রভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে।
কর্ণফুলি এবং বাংলাদেশের জাতীয় নদীর গুরুত্ব : ‘গোটা চট্টগ্রাম অঞ্চলই সামগ্রিকভাবে কর্ণফুলি নদীর সাথে একাত্ম হয়ে মিশে আছে’ বললে খ-িতভাবেই বলা হয়। কেননা এ নদীকে ঘিরে কেবল চট্টগ্রামবাসীর কান্না-হাসি, দিনযাপনের লিপি নয় বাঙালি জাতির জীবনযাপনই এ নদীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। কারণ এর কাছ থেকে দেশ ও জাতি পায় জীবন রসদ-বেঁচে থাকার উপকরণ। এ নদীতে গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান বন্দর। গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশীদারও কর্ণফুলি নদী।
পৃথিবীতে অনেক দেশেই জাতীয় নদী আছে। কিন্তু বাংলাদেশে নেই। দেশের প্রতিটি নদীই গুরুত্বপূর্ণ। তবে দেশের প্রধান প্রধান নদীর মতো অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ নদী কর্ণফুলি। পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষা, ভৌগোলিক গুরুত্ব, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসহ উল্লিখিত বন্দর বিবেচনায় এ নদী জাতীয় নদী হিসেবে দাবিদার। বলাই বাহুল্য, কর্ণফুলি চট্টগ্রামে অবস্থিত হলেও এটি জাতীয় সম্পদ। জাতীয় অর্থনীতিতে এই নদী যেভাবে ভূমিকা রাখছে, সঠিক পরিচর্যা, মর্যাদা পেলে আগামীতে আরো ব্যাপক অবদান রাখতে পারবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। তাই একে ‘জাতীয় নদী’র মর্যাদায় অভিষিক্ত করা সময়ের দাবি। কর্ণফুলির নান্দনিক সৌন্দর্যসুধা আর জীবনরসদ ধারণ করে দেশ সমৃদ্ধ হচ্ছে-এ কথা অমূলক নয়। জাতীয় মর্যাদার দাবিদার কর্ণফুলির মৎস্যভা-ারও পুষ্টির অনন্য যোগানদাতা। জয়তু কর্ণফুলি। চিরচঞ্চল থাকুক প্রাণের নদী।
তথ্যসূত্র
১। ছড়া ও কবিতায় কর্ণফুলি : আবুল কালাম বেলাল
২। ইতিহাস ঐতিহ্যে কর্ণফুলী- আলীউর রহমান
৩। বাংলা পিডিয়া
৪। স্থানীয় পত্র-পত্রিকা