বসন্তশেষের এই দিনগুলোতে নিমফুল ফোটে। যদিও ফুল হিসেবে নিমফুলের আলাদা কোনো খ্যাতি বা যত্ন নেই।প্রাকৃতিক নিয়মেই এদের বেড়ে ওঠা,ফুলে ফুলে ডাল সাজিয়ে তোলা।
সেদিন শহরের সবচে ব্যস্ততম রাস্তায় হুট করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। গন্ধটা আমার খুব প্রিয়,আমার খুব চেনা। চোখ তুলে তাকাতেই দেখি মাথার ওপর নিমফুল!পশ্চিমের সোনারোদ তখন নিমফুলকে মু্ড়িয়ে নিয়েছে যেনো!
চট করে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। নিমফুলের সুবাস আমার মায়ের খুব প্রিয়!
ছোটোবেলায় অবাক হতাম,এত এত চেনা জানা, নামকরা সুগন্ধি ফুলের ভীড়ে,নিমফুল কেনো মা এতটা পছন্দ করেন।
মাকে জিজ্ঞেস করিনি,উত্তরও পাইনি।
চলতি পথে থমকে দাঁড়ানো আমি দেখলাম নিমফুলে গাছ একেবারে সুসজ্জিত। বৈশাখের তাহলে খুব বেশি দেরী নেই!
চৈত্র সংক্রান্তি খুব সন্নিকটে, নিমফুল তা জানিয়ে দিয়ে গেলো। চৈত্র সংক্রান্তির এই দিনগুলো একটা সময় আমরা খুব উপভোগ করতাম।আসন্ন সংক্রান্তি আর নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর এই রীতি বছরের পর বছর ধরে বহমান। খুব প্রথম থেকেই যদি বলতে হয়, তাহলে বলা যায় পয়লা ফাগুনকে বরণ করে নেয়ার মধ্য দিয়ে আমরা ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করে নিই খুব ভালোবেসে।তিনি ঋতুরাজ,তাই তার প্রতিটি পর্বেই রয়েছে নানা বৈচিত্র্য!
ফাল্গুনের শেষদিন অর্থাৎ সংক্রান্তির দিন গোধু্ূলীবেলায় শুধুমাত্র চৈত্রমাসকে বরণ করে নেওয়ার একটি গ্রাম্য আচার পালন করা হয়।এটি অবশ্য একেক জায়গায় একেক রকম।গ্রামের মেয়ে বউয়েরা গোবরের ওপর পলাশ ফুল গুঁজে দিয়ে বাড়ির প্রবেশদ্বারে একটি গন্ডি এঁকে দেয়।এটাও এক ধরণের রীতি।এভাবেই গ্রামের লোকজন চৈত্রমাসকে স্বাগত জানিয়ে আসছে বছরের পর বছর। এরপর থেকেই শুরু হয় চৈত্র সংক্রান্তির নানা রকম কাজ।
চৈত্রমাসে সবাই ঘরদোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে।
সংক্রান্তির আগের দিন ঘরের দরজায় নিমপাতা আর ফুলের মালা দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। সবুজ নিমপাতার থোকায় সাদাটে
নিমফুল বাতাসে দোল খায়,আর সারা ঘরময় একধরণের হালকা সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ে।
এক ধরণের বিশেষ ফুল দিয়ে সংক্রান্তির দিন ঘরের দরজায় মালা দেয়া হয়।ফুলটি সাদা রঙের রঙ্গন প্রজাতির ফুল। থোকায় থোকায় ফোটে।
বর্তমানে এই ফুল অনেকটাই বিরল। সহজে পাওয়া যায়না। আর যুগের বৈচিত্র্য ও বেড়ে গেছে অনেকটাই। তাই নানাজন নানারকম ফুলের মালা দিয়ে এই রীতি পালন করে।
সংক্রান্তির দিন খুব সকালে গ্রামের লোকজন তাদের গৃহপালিত পশুদের স্নান করায়,তাদের গলায়ও মালা দেয়া হয়।এছাড়া সবাই কাঁচা হলুদের সাথে সাদা সর্ষে বাটা গায়ে মেখে স্নান সেরে নেয়। সেদিনের সকালের জলখাবার হয় খই,কড়ই,নাড়ু মোয়া প্রভৃতি সহযোগে।যুগের পর যুগ ধরে এই রীতি চলে আসছে।যদিও এসবের অনেকটাই এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।
সংক্রান্তির দিন দুপুরের খাবারের তালিকায় থাকে বিশেষ পাঁচন।সব ধরণের সব্জি,ভেষজ লতাপাতা,বড়ি,বড়া,সর্ষে বাটা দিয়ে একটা বেশ বড়সড় পাঁচন রান্না হয় প্রতি ঘরে ঘরে।
বলা যায়,এটি সংক্রান্তির প্রধান আকর্ষণ।
এরই মাঝে সংক্রান্তির আগের দিন সন্ধ্যা বেলা আর সংক্রান্তির দিন সকালে ও সন্ধ্যায় এক বিশেষ এবং অন্যরকম রীতি প্রচলিত আছে গ্রামে। নানা রকম ভেষজ,ঔষধি লতা পাতার মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে তার ধোঁয়া গায়ে লাগানো। সন্ধ্যার আলো আঁধারের মধ্যে বাড়ির উঠোনে আগুন জ্বালিয়ে বাড়ির সদস্যরা এই আগুনের কুন্ডলীকে ঘিরে ঘুরেঘুরে তার ধোঁয়া গায়ে লাগায়। খুব ভোরে আর সন্ধ্যায় এ কাজটি করা হয়।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো,এই প্রত্যেকটা রীতির নেপথ্যে আলাদা আলাদা বিশেষ ব্যাখ্যাও আছে।
সংক্রান্তির দিন নানা রকমের পূজার আয়োজন ও হয় প্রতি ঘরে ঘরে।গৃহদেবতা, কুলদেবতাদের সন্তুষ্ট করে তাঁদের কৃপাদৃষ্টিতে থেকে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়।তবে অনেক স্হানে এইসব পূজা সার্বজনীনভাবে উদযাপন করা হয়।আর তাতে মেলারও আয়োজন হয় বৈকি!
সংক্রান্তির পরদিন পহেলা বৈশাখ। নতুন করে আর বলার অপেক্ষা রাখেনা এই দিনের বৈশিষ্ট্য। হালখাতা খোলা,বিভিন্ন পূজাপার্বণ করে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়।প্রতি ঘরে মানুষজন তাদের সাধ্যমতন ভালো ভালো খাবারের আয়োজন করে থাকে।
নতুন একটা বছরকে স্বাগত জানানোর এই রীতি বাংলায় যুগ যুগ ধরে বহমান।স্থানভেদে এইসব রীতির তারতম্য ঘটে,কিন্তু মূল লক্ষ্য হলো মূলত নতুন বছরকে স্বাগত জানানো।পুরাতনের গ্লানি মুছে নব উদ্যমে জেগে ওঠা।অতীতের যা কিছু ভালো তাকে সাথী করে নতুনের পথে পা বাড়ানো।
বাঙালীদের এই উৎসব যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি পাহাড়েও বেশকয়েকদিন ধরে এই উৎসব পালিত হয়।পাহাড়িদের উৎসব রীতিও বেশ নজরকাড়া।
মূলত বাঙালি হোক আর পাহাড়ি হোক, নতুনকে বরণ করে নেবার এই যে বিশাল পরিধির উৎসব-অনুষ্ঠান—-তাতে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে গোটা দেশ!
বাংলাদেশ এভাবেই জেগে থাকে নানা পালা-পার্বণে।
সবাইকে আসন্ন নববর্ষের শুভেচ্ছা।
শুভ নববর্ষ—১৪৩০।