ড. মাহবুবুল হক একজন গবেষক, ভাষাবিদ ও অধ্যাপক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ এবং পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। শিক্ষকতায় অসামান্য অবদান রাখার পাশাপাশি প্রায়োগিক বাংলা ও ফোকলোর চর্চা, গবেষণা, সম্পাদনা, অনুবাদ ও পাঠ্যবই রচনা করে তিনি পরিচিতি লাভ করেছেন দেশে ও দেশের বাইরে। বাংলাদেশ, ভারত ও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত হয়েছে চল্লিশটির বেশি বই। ড. মাহবুবুল হক বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ নানা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন বিশেষজ্ঞ হিসেবে। প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে তাঁর। পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮), নজরুল পদক, মধুসূদন পদকসহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। ৩ নভেম্বর ২০২১ তারিখ ড. মাহবুবুল হক পূর্ণ করবেন জীবনের ৭২ বছর। ড. মাহবুবুল হক ১৯৪৮ সালের ৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন ফরিদপুর জেলার মধুখালিতে। তবে তিনি শৈশব থেকে বেড়ে ওঠেছেন চট্টগ্রামে।
বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বইটি বাংলাদেশ ও ভারতের যে-একত্রিশজন ভাষাবিজ্ঞানী-গবেষকের প্রবন্ধে সমৃদ্ধ ড. মাহবুবুল হক তাঁদের অন্যতম। অসীম অধ্যবসায় আর একনিষ্ঠতা নিয়ে ড. রফিকুল ইসলাম ও ড. পবিত্র সরকারের সাথে তিনি সম্পাদনা করেন প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ (২০১৪)। এ সকল রচনায় ভাষাবিজ্ঞানী ড. মাহবুবুল হকের মুক্ত চিন্তার বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। আমাদের সামনে উঠে আসেন একজন বিজ্ঞানমনস্ক ,মাতৃভাষা প্রেমিক ভাষাবিজ্ঞানী । ড. মাহবুবুল হকের পিএইচডি গবেষণার বিষয় আধুনিক বাংলা কবিতা হলেও বিশ শতকেই দুই বাংলায় তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয় তাঁর বাংলা বানানের নিয়ম (১৯৯১) গ্রন্থটি। এর ভূমিকায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেন “: ‘বাংলা বানান নিয়ে বিভ্রান্তি দিনে দিনে বাড়ছে। বানানের নিয়মকানুন যে প্রতিদিন বদলাচ্ছে, তা নয়; বানান আয়ত্ত করার বিষয়ে আমাদের ঔদাসীন্য ও অবহেলা বাড়ছে, বাড়ছে এক ধরনের হটকারিতাও।’ এই হটকারিতা হটাতে ড. মাহবুবুল হক সদা সচেষ্ট। ড. মাহবুবুল হক মাতৃভাষা নিয়ে ভাবেন আবার কাজও করেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাই মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা। সঙ্গত কারণেই বাহাত্তরে প্রণীত সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগের তৃতীয় অনুচ্ছেদে লেখা হয়: ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। অথচ অদ্যাবধি আমরা রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে পারিনি। এর অন্যতম কারণ সম্ভবত বাংলা ভাষার বানান বিভ্রাট।
আমাদের শিক্ষানীতির লক্ষ্য অসাম্প্রদায়িক দেশপ্রেমিক শিক্ষিত জাতি গড়বার। ভাষাবিজ্ঞানী ড. মাহবুবুল হক সেই লক্ষ্যের এক উজ্জ্বল বাতিঘর। শুধু গ্রন্থে ও শ্রেণিকক্ষে নয় ব্যক্তিগত জীবনেও সদাচারণে তিনি অসাম্প্রদায়িক। তিনি তাঁর শিক্ষার্থী-সাথীদের মধ্যেও অসাম্প্রদায়িক ভাষাচর্চার বিস্তার ঘটান প্রতিনিয়ত।
বাংলাদেশ, ভারত ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তাঁর চল্লিশটির বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে: ‘তিনজন আধুনিক কবি’, ‘ইতিহাস ও সাহিত্য’, ‘সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি’, ‘বইয়ের জগৎ: দৃষ্টিপাত ও অলোকপাত’, ‘বাংলা কবিতা : রঙে ও রেখায়’, ‘ভাষার লড়াই থেকে মুক্তিযুদ্ধ’, ফোকলোর ও অন্যান্য’, ‘বাংলার লোকসাহিত্য : সমাজ ও সংস্কৃতি’, ‘বাংলা ভাষা : কয়েকটি প্রসঙ্গ’, ‘বাংলা সাহিত্যের দিক-বিদিক’, ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ ও ‘অন্বেষার আলোয় চট্টগ্রাম’ ইত্যাদি।
প্রাবন্ধিক ড. মাহবুবুল হক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিচিত্র বিষয় নিয়ে লেখালেখি ও গবেষণায় রত। অনেক গবেষকের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবেও তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। বেদনার বিষয় তিনি বর্তমানে কিডনি রোগে আক্রান্ত। তবু তাঁর মন-মনন থেমে নেই প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনায় ও গবেষণায়। এমন নিবেদিতপ্রাণ ভাষা-গবেষককে ৭৪তম জন্মদিনে জানাই প্রাণঢালা শুভেচ্ছা আর অভিবাদন। বাংলা ভাষা,সাহিত্য ও ব্যাকরণ নিয়ে নিরলস গবেষণায় তিনি শতায়ু হোন এই প্রত্যাশা করি।