ঈদ মানে আনন্দ ঈদ মানে খুশি। ঈদ আসলেই ছোট বড় সবাই আনন্দে মেতে উঠি। একটানা এক মাস সিয়াম সাধনার পর যখনই পশ্চিম আকাশে শাওয়ালের চাঁদ দেখা যায় তখনই রেডিও টিভিতে একসাথে বেজে ওঠে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, আপনাকে আজ বিলিয়ে দেওয়ার’। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী এই গানটি এখন সব সম্প্রদায়ের লোকের অন্যতম জনপ্রিয় গান হয়ে উঠেছে। চাঁদ রাতের দিন এই গানের মাধ্যমে ঈদের আনন্দ বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয় সবার মাঝে। পরের দিন ঈদগাহ মাঠে নামাজের পর কোলাকুলির মাধ্যমে শুরু হয় ঈদের প্রথম ভ্রাতৃপ্রথিম শুভেচ্ছা বিনিময়। এরপর ঘরে ঘরে গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময়। যদিও এখন আগের মতো ঘরে ঘরে যাওয়া হয় না। ঈদগাহ মাঠেই শুভেচ্ছা বিনিময় করে শেষ করে দেওয়া হয় এই পর্ব। তবে গ্রামে আগের ঐতিহ্য এখনও আছে। গ্রামের লোকেরা এখনও ঘরে ঘরে যায়। ইট পাথরের শহরে ঘরে ঘরে যাওয়ার রেওয়াজ টা এখন নেই বললেই চলে! একইভাবে নেই বললেই চলে ঈদ কার্ডের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময় ও। আগে ঈদের ১০-১৫ দিন আগ থেকেই বন্ধুদের মাঝে ঈদ কার্ড বিনিময় হতো। এখন সেটাও বিলুপ্ত হওয়ার পথে।
আগে স্কুল কলেজের ছেলে মেয়ে থেকে শুরু করে বড় রাও ঈদ কার্ড বিনিময় করতো। বিশেষ করে যারা সাহিত্য ও সংস্কৃতি মনা ছিল তাদের মধ্যে এই প্রবণতা টা বেশি ছিল। আমিও ছিলাম সেই দলে। বন্ধুদের মাঝে ঈদ কার্ড বিনিময় করতাম। তখন পত্র মিতালীরও যুগ ছিল। আমি পত্র মিতালী ও করতাম। সময়টা ছিল আশির দশকের শেষের দিকে আটাশি সালে। আমি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্র। রোজার মধ্যভাগ থেকে ঈদ কার্ড বিনিময় হতো। এলাকার বন্ধু, স্কুলের বন্ধু, কাজিন বন্ধু থেকে শুরু করে পত্র মিতালীর বন্ধুদের ও ঈদ কার্ড পাঠাতাম। আমার কাছেও আসতো প্রচুর ঈদ কার্ড। একবার এলাকার এক বন্ধুকে ঈদ কার্ড পাঠিয়েছিলাম পোস্ট অফিসের মাধ্যমে। অথচ বন্ধুর বাসা ছিল আমার বাসা থেকে মিনিট পাঁচেক এর দূরত্বে। পোস্ট অফিসের মাধ্যমে দেওয়াটা ছিল একটা সারপ্রাইজ। বন্ধু সেই সারপ্রাইজ পেয়ে খুশিতে উৎফুল্ল। সে ধারনাই করতে পারেনি একেবারে বাসার পাশ থেকে বন্ধু বাই পোস্টে ঈদ কার্ড পাঠাবে। তবে বন্ধু জানতো আমি পত্র মিতালী করতাম। আমার সেই বড় লোক বন্ধু আমার ঈদ কার্ড পেয়ে তার বাসার সবাইকে দেখিয়েছিল। তাদের বাসার সবাই আমাকে ভালোভাবে চিনতো জানতো।
কিন্তু আমি যে এরকম একটা সারপ্রাইজ দিবো তারাও সেটা বুঝে উঠতে পারেনি। পরে বন্ধুর বড় বোন নওশত আপা বন্ধুকে বলেছিল তুইও একটা ঈদ কার্ড পাঠিয়ে দেয় মোখলেস এর কাছে। কিন্তু তখন আর পোস্টের মাধ্যমে পাঠানোর সময় ছিলো না। দুইদিন পরেই ঈদ। তাই চাঁদ রাতের দিন বন্ধু লোক মারফত আমার কাছে পাঠালো হালকা জমকালো এক ঈদ কার্ড। সেখানে কী লেখা ছিল এখন আর মনে নেই। আমি কী লিখেছিলাম তাও মনে হয়। কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে আমাদের দুইজনের ঈদ কার্ড বিনিময়ের কথা।
এছাড়া আরও অনেক বন্ধুদের সাথে ঈদ কার্ড বিনিময় হতো। ঢাকা এবং সিলেটের বন্ধুদের সাথে বেশি ঈদ কার্ড বিনিময় হতো। ঢাকা কমলাপুরের রাসেল, ধানম-ির উন্মে হাবিবা এবং মৌলভীবাজারের মাহবুবা পারভীন এর কথা এই মুহূর্তে বেশি মনে পড়ছে। এখন সবই স্মৃতি। কোনো যোগাযোগ নেই কারো সাথে। দূরের বন্ধুরা কে কোথায় আছে কিংবা আদৌ বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না। শুধু জানি এলাকার সেই বন্ধুটি খুব ভালো আছে মানবতার কাজ নিয়ে। ভালো থাকুক মানবতার ফেরিওয়ালা সেই বন্ধুটিসহ আমার হারিয়ে যাওয়া ঈদ কার্ড বিনিময়ের সকল বন্ধুরা।
আজ খুব মনে পড়ছে সেই সময়ের ঈদ কার্ডের কথা। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের কথা।
এখন ঈদ কার্ড বিনিময় হয় রাষ্ট্রীয় দপ্তরে এবং কর্পোরেট অফিসে। আপামর জনসাধারণের মাঝে ঈদ কার্ড বিনিময় হয় না। আগে পাড়ার অলিগলির দোকানে ঈদ কার্ড বিক্রি হতো। এখন বড় শপিং মলে ও পাওয়া দুষ্কর! যুগ পরিবর্তন হয়েছে, তাই যুগের সাথে ঈদ কার্ড ও হারিয়ে গেছে। এখন ফেসবুকের যুগ। একটা ঈদের শুভেচ্ছা বার্তা লিখে হাজারো বন্ধুর কাছে পাঠানো যায়। কিন্তু আমেজটা একটু ভিন্ন। ভার্চুয়াল ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় আর হাতে লিখে ঈদ কার্ডের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্যে ফের পার্থক্য আছে। ঈদ কার্ডের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্যে হৃদয়তা বেশি। সেই ঈদ কার্ড ফাইলের মধ্যে যতœ করে বছরের পর বছর রাখা যায়। কিন্তু ভার্চুয়াল ম্যাসেজ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে অল্প দিনের মধ্যে চিরতরে হারিয়েও যেতে পারে! অবশ্য দুটোর আমেজ দুই রকম। এখন ইচ্ছা করলেই আগের পদ্ধতিতে ফিরে যেতে পারি না। বর্তমানকে নিয়েই থাকতে হয়। এখন কেবল স্মরণ করতে পারি পুরানোকে।
এই ঈদে এসে খুব মনে পরছে তরুণ কালের ঈদ কার্ড বিনিময়ের কথা। ইচ্ছা করছে আবারও ঈদ কার্ড বিনিময় করি। কিন্তু সব ইচ্ছা তো পূর্ণ হয় না। তাই এটাও না হয় অপূর্ণই থেকে যাক। সবাইকে ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক ।

এস এম মোখলেসুর রহমান : প্রাবন্ধিক ও সংগঠক।